ব্রেকিং নিউজ
Home | শীর্ষ সংবাদ | ঈদ উৎসব ও করোনাকালের ঈদ

ঈদ উৎসব ও করোনাকালের ঈদ

মোহাম্মদ ইলিয়াছ : ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানে খুশি, ঈদ মানে উৎসব। বছর ঘুরে ফিরে আসে এই আনন্দ। ঈদ মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। বছরে দু‘বার ঈদ আসে। ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের ভাষায় বলা যায়, রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ। সবার জীবনে কম-বেশি আনন্দ বয়ে আনে এই ঈদে। রোজা শুরু হওয়ার সাথে সাথে ঈদের আনন্দও শুরু হয়ে যায়। আগের দিন সন্ধ্যা থেকে আনন্দের জোয়ার শুরু হয়।। আকাশে চাঁদ দেখার মধ্য দিয়ে খুশীর ঈদ শুরু হয়। পরের দিন ছোট-বড়, ধনী-পরিব সবাই গায়ে নতুন জামা পরে সুগন্ধি দিয়ে মিলিত হয় ঈদগাহে। ঈদের নামাজ শেষে সমবেতভাবে মোনাজাত, কোলাকুলি ও ঈদ মোবারকের মাধ্যমে শুরু হয় ঈদের আনন্দ। ধনী-গরীব সকলে ঘরে তৈরী হয় সবচেয়ে প্রচলিত খাবার সেমাই। প্রত্যেকে প্রত্যেকের বাড়িতে বেড়ানো এবং কিছু খাওয়ার দৃশ্য কতই না আনন্দদায়ক।

কিশোর বয়সে ঈদের স্মৃতি এখনো মনকে নাড়া দেয়। ঐ সময়ের স্মৃতি কখনো ভুলার মত নয়। কখনো মন থেকে ধুঁয়ে-মুঁছে ফেলা যাবে না। এই ঈদ স্মৃতি মনে গেঁথে থাকবে আজীবন-সারাজীবন। রোজা শুরু হওয়া থেকে শুরু হয় নতুন জামা পওিয়ার আকুতি। ঘন ঘন জ্বালাতন করতাম মা-কে। মা ছেলের নতুন জামার জন্য বাবাকে বলতেন। বাবা নতুন জামা সেলাইয়ের জন্য কাপড়ের দোকানে নিয়ে যেত। কেননা কিশোরকালে রেডিমেট গার্মেন্টসের কাপড় ছিল না। দোকান থেকে থান কাপড় কিনে বানাতে হতো নতুন জামা। বাবা থান কাপড়ের দোকানে নিয়ে গিয়ে নতুন জামা একটি শার্ট ও একটা পাঞ্জাবীর জন্য কাপড় কিনলেন। নিয়ে গেলেন দর্জির কাছে। বেশ কয়েটা দর্জির দোকান ঘুরে একটাকে কোনমতে রাজি করানো হল। দর্জি আমার শার্ট ও পাঞ্জাবীর মাপ নিলেন। দর্জি বাবাকে বললেন আপনি “স্যার মানুষ” বলে অর্ডারটা নিলাম। তবে ঈদের সাপ্তাখানেক আগে ডেলিভারী দিতে পারব, এর আগে নয়। বাবা বললেন সাপ্তাখানেক আগে দিলেও চলবে। দেখলাম সব দর্জির দোকান কাপড় আর কাপড়ে ভরপুর। রাতদিন চলছে সেলাইয়ের কাজ। বাবা এলাকার পরিচিত একজন আদর্শ শিক্ষক হওয়াতে দর্জি অর্ডারটা নিলেন। ঈদের দুই-তিন আগে হাতে আসল নতুন জামা। নিজে ধুঁয়ে রোদে শুকাতে দিলাম। মা-বাবার নিষেধ ছিল নতুন জামা ধোঁয়া ছাড়া গায়ে পরা যাবে না। জামা শুকানোর পর লন্ডির কাছে গিয়ে ইস্ত্রি করে ঘরে নিয়ে এসে রেখে দিলাম। এর মধ্যেই ঘনিয়ে এলা ঈদ। ঈদের আগের দিন বাড়ির পাড়ার মসজিদে আসরের নামাজ শেষ করে পশ্চিম আকাশে ঈদের চাঁদ দেখতে ছুটে গেলাম বিলের খোলা জায়গায়। সেখানে দেখলাম ঈদের চাঁদ দেখার জন্য ছেট-বড় বহু মানুষের জমায়েত। সবার দৃষ্টি পশ্চিমা আকাশের দিকে। চাঁদ দেখা পেলে কিনা যে আনন্দ লাগতো। শুরু হয়ে যেত ঈদের পূর্ব প্রস্তুতি। ঈদের আগের রাতেই চুল কাটার জন্য সেলুনের দোকানে যেতাম। দোকানে অপেক্ষা করতে হতো ঘন্টার পর ঘন্টা। এমন ভিড় থাকতো সেলুনের দোকানগুলো। চুল কাটা ও ঈদের প্রয়োজনে অন্যান্য জিনিষ কিনে বাড়িতে চলে আসতাম। ঈদের দিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতাম। গোসল সারতে পুকুরে যেতাম। সেখানেও ছোট-বড় সকলের ভিড় হলে সবার চেহারা যেন হাসি-খুশিতে ভরপুর। গোসল শেষ করে ঘরে এসে মা-এর দেওয়া ঈদের মিষ্টান্ন মুখে দিতাম। তারপর গায়ে নতুন জামা ও মাথায় নতুন টুপি পরে আতর সুগন্ধি মেখে ঈদগাহে যেতাম। ঈদের নামাজ শেষে ঈদগাহেই কোলাকুলি, বাসায় মা-বাবাসহ গুরুজনদের পা ছুঁয়ে সালাম করা এবং কবরস্থানে যাওয়া হতো জেয়ারতের উদ্দেশ্যে। যাওয়া হত আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে। আসা-যাওয়ার পথে ছোট-বড়, ধনী-গরিব ভেদাভেদ ভুল গিয়ে সালাম দেয়ার রেওয়াজ ও কোলাকুলির দৃশ্য আনন্দে মন ভরে যেত।

ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করার জন্য ঈদের সপ্তাহখানেক আগ থেকে স্বজনরা গ্রামের বাড়িতে চলে আসত। ঈদে শহর হয়ে যেত জনশূন্য আর গ্রাম হয়ে যায় মানুষে-মানুষে ভরপুর। শহরের মানুষ গ্রামে ফিরে আসে আপনজনের কাছে। ঈদে গ্রামের বাড়ি থাকে স্বজনদের কোলাহল এবং থাকে নতুনত্ব। ঈদ উৎসবে আনন্দের কমতি ছিল না কোন কালেই। আনন্দ ছিল সেকাল-একাল সবকালেই। ঈদুল ফিতরে আছে ইবাদত, আনন্দ ও একতা। শিক্ষা দেয় শৃঙ্খলাবোধ ও ভ্রাতৃত্ববোধ।। জাগ্রত করে ঐক্য, শান্তি ও প্রগতি। দয়া ও সহানুভূতি, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও উন্নত মানসিকতার শিক্ষা দেয়। অন্যদিকে ঈদে ধনী-গরীবের ব্যবধান কমে আসে। গড়ে উঠে একে অপরের মধ্যে সৌহার্দ্যভাব। সকল শ্রেণির মানুষ এক কাতারে শামিল হয়ে ঈদের আনন্দকে ভাগাভাগি করে নেয়।

করোনাকালের রোজার ঈদ আনন্দময় উৎসবে পরিণত হবে কিনা জানি না। বৈশ্বিক মহামারী করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে রোজার ঈদ উৎসব হোঁচট খেল। কোন কালে ঈদ উৎসবকে কোন মহামারী আক্রমন করেছে কিনা জানা নেই। কিন্তু এবারের ঈদ হচ্ছে করোনাকালের ঈদ। করোনার কারণে দলে দলে মসজিদে জামাতে নামাজ আদায় করার মধ্যে রয়েছে সরকারি বিধি নিষেধ। ১২ ই রমজান পর্যন্ত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে গিয়ে কাতারবন্দী হয়ে আদায় করা এবং কাতারবন্দী হয়ে তারাবীহ-এর নামাজ পড়া যায়নি। মসজিদে ইমাম-মুয়াজ্জিনসহ মাত্র ১২ জন মুসল্লি তারাবীহ নামাজ আদায় করতে পেরেছে। ১৩ ই রমজান থেকে ১২টি স্বাস্থ্যবিধি অনুস্মরণপূর্বক মসজিদে সুস্থ মুসল্লি জামায়াতে নামাজ আদায় করতে হয়েছে।

রমজানের রোজা শেষে আসে ঈদুল ফিতর। ঈদুল ফিতরের নামাজ আদায় করার ক্ষেত্রে এবং ঈদ উৎসব পালনের ক্ষেত্রেও রয়েছে বিধি নিষেধ। ঈদগাহ বা খোলা জায়গায় ঈদের জামাত করা যাবে না। শর্ত সাপেক্ষে মসজিদে ঈদের জামাত আদায় করা। নামজের পূর্বে সম্পূর্ণ মসজিদ জীবানুনাশক দিয়ে পরীক্ষা করে কার্পেট না বিছিয়ে নামাজ আদায় করা। মসজিদের ওজুর স্থানে সাবান ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার রাখা। মাস্ক পরে মসজিদে গমন এবং কাতারে সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ । ঈদের জামাত শেষে কোলাকুলি এবং পরষ্পর হাত মেলানো থেকে বিরত থাকা।

এই অবস্থায় করোনার এই পরিস্থিতি ঈদে গ্রামে গেছেন বহু মানুষ। গ্রামে স্বজনদের সাথে ঈদে সামিল হওয়ার জন্য ঝুঁকি নিয়ে গ্রামে গেছেন। আবার অনেকে যেখানে আছেন সেখানে ঈদ করবেন। যারা গ্রামে গেছেন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে ঈদ করবেন। করোনাকে মোকাবেলায় আপনার স্বার্থে এবাওে এরকম করতে হবে এ ঈদ আয়োজন। এটাকে আমরা বলছি করোনাকালের ঈদ। তাই করোনাকালের ঈদ উৎসব পালন করব স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ঈদের আয়োজন করব। কোলাকুলি করা এবং হাত মেলানো থেকে বিরত থাকব। আমার জন্য এবং আমার পরিবারের স্বার্থে সুস্থ থাকব। যার যার বাড়িতে নিরাপদে থাকব। এবারের করোনাকালের ঈদে উৎসব ঘওে অবস্থান করব এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে করব। এজন্য আমাদেরকে সতর্ক থেকে ঈদ পালন করতে হবে এবং ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে হবে। লেখক: সহ: অধ্যাপক, আলহাজ্ব মোস্তফিজুর রহমান কলেজ, লোহাগাড়া, চট্টগ্রাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!