Home | উন্মুক্ত পাতা | ইসলাম ও ভালোবাসা

ইসলাম ও ভালোবাসা

আবু বকর মুহাম্মদ হানযালা : ভালোবাসা একটি মানবিক অনুভূতি এবং আবেগকেন্দ্রিক একটি অভিজ্ঞতা। বিশেষ কোন মানুষের জন্য স্নেহের শক্তিশালী বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে ভালোবাসা। ভালোবাসা না থাকলে পৃথিবী টিকে থাকত না। সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার অফুরন্ত ভালোবাসা আছে বলেই এত কষ্ট করে তারা সন্তানকে লালন-পালন করে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে গভীর ভালোবাসার কারণেই পারিবারিক বন্ধন আমরণ হয়। ভালোবাসা একটি ঈমানী দায়িত্ব ও ঈমানী দাবিও বটে। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, “মুমিনদের দৃষ্টান্ত তাদের পারস্পরিক সম্প্রীতি, দয়ার্দ্রতা ও সহমর্মিতার দিক দিয়ে একটি দেহের মত। যখন তার কোন একটি অঙ্গ অসুস্থ হয়, তখন তার সমগ্র দেহে তাপ ও অনিদ্রা ডেকে আনে”। (বুখারী,মুসলিম)।

একে অপরকে ভালোবাসার মাধ্যমে ঈমানী স্বাদ পাওয়া যায়, এ ব্যাপারে রাসুল (সা) বলেন, “যে ব্যক্তি ঈমানের স্বাদ পেতে পছন্দ করে, সে ব্যক্তি কেবল সুমহান আল্লাহর উদ্দেশ্যেই অপরকে ভালবাসুক”। অনেকে বলে থাকেন,ইসলাম কঠোরতা নীতি অবলম্বন করে, ইসলামে বিনোদন, ভালবাসা বলতে কিছুই নেই। আসলেই তাদের মন্তব্য যথার্থ, কারণ, তারা বিনোদন, ভালোবাসা বলতে যেসব বেহায়াপনা, অশ্লীলতা ও নগ্ন সংস্কৃতি ও রীতিকে বুঝায় তা ইসলাম কখনো সমর্থন করে না। কারণ, ইসলাম মানুষের চলার পথের সন্ধানদাতা, উন্নত, সুখী ও সমৃদ্ধশালী জীবন এবং আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সন্তুষ্টি অর্জন তথা মানবজীবনের চরম লক্ষ্য অর্জনের একমাত্র পন্থা। এর ব্যাপ্তি জীবনের সর্বক্ষেত্রে। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনের সব ক্ষেত্রেই ইসলামের নিয়ন্ত্রণাধীকার। ইসলাম মানুষের সঠিক পথের দিশারী, দুনিয়া ও আখেরাতের সর্বাঙ্গীন ও পূর্ণাঙ্গ একমাত্র জীবন ব্যবস্থা। সুতরাং, ইসলামে সবকিছুর একটা সুনির্দিষ্ট রূপরেখা রয়েছে। রূপরেখা বহির্ভূত কোনো বিষয় ইসলাম সমর্থন করে না।

কিন্তু আজ ছোঁয়াছে রোগের মতো বিশ্ব ভালোবাসা দিবস নামে একটি দিবস যুবসমাজ অবলীলায় ও মহাসমারোহে পালন করছে। এটি বিজাতীয়, নির্লজ্জ ও নগ্ন সংস্কৃতি। মুসলিম যুবসমাজকে ধ্বংস করার অতীত ষড়যন্ত্রেরই বর্তমান রূপ হচ্ছে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। আজ সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতি, সভ্যতার নামে অসভ্যতা, বেহায়াপনা ও বেলেল্লাপনা দ্বারা পুরো মুসলিম যুবসমাজকে বিপথগামী ও চরিত্রহীন করার জন্য মরণপণ চেষ্টা চলছে। কালের বিবর্তনে আজ আমাদের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিপর্যয় নেমে এসেছে। হারিয়ে যাচ্ছে মুসলিম সমাজের রীতিনীতি, বাঙ্গালি জাতির ঐতিহ্যমন্ডিত সংস্কৃতি। আপন সংস্কৃতি হারিয়ে অন্যদের সংস্কৃতি গ্রহণ করা হচ্ছে। বর্তমানে ভালোবাসা শব্দটি নেতিবাচক শব্দে পরিগণিত হচ্ছে। অচেনাকে অচেনাই ভালোবাসা হলো বর্তমান সমাজে ভালোবাসার সংজ্ঞা। ভালোবাসা নামে চলছে নোংরামি, যুবক-যুবতীর অবাধ মেলামেশা। এক মহাপবিত্র বস্তু আজ অপবিত্রের রূপধারণ। আসুন, আমরা নিজ অবস্থান থেকে প্রতিবাদ জানাই, সচেতন হই ।

রাসুল (সা) হাদিস শরীফে ইরশাদ করেন, “তোমাদের মধ্যে যেকোনো অন্যায়কারীকে দমনে সে যেন হাত দিয়ে প্রতিরোধ করে, যদি তা করতে না পারে তবে সে যেন মুখ দিয়ে প্রতিহত করে। যদি সে মুখ দিয়েও না পারে তাহলে যেন অন্তর দিয়ে ঘৃণা পোষণ করে; আর এটাই দুর্বল ঈমানের পরিচয়”।(বুখারি)। অর্থাৎ নিজ নিজ অবস্থা ও সক্ষমতা অনুযায়ী যেকোনো অন্যায়, পাপাচার প্রতিহত ও প্রতিবাদ করতে হবে। নিজ ঘরের মহিলাদের প্রতি সজাগ ও সচেতন দৃষ্টি রাখতে হবে।

প্রতিবাদ করা এবং শান্তি ও সত্যের দিকে ফিরিয়ে আনতে মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে সুন্দর কৌশল আমাদেরকে শিখিয়ে দিয়েছেন, ইরশাদ হচ্ছে “আপনি মানুষকে হিকমত ও সদুপদেশ দ্বারা আপনার রবের পথে আহবান করবেন এবং তাদের সাথে আলোচনা করবেন সুন্দরভাবে”। (সুরা নাহল,আয়াত:- ১২৫)। অন্যত্রে ইরশাদ হয়, ” তোমরা তাকে নরম কথা বলবে হয়ত সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা ভয় করবে”।(সুরা ত্বহা,আয়াত:- ৪৪)। প্রথমে আমাদের পরিবার থেকে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে,তাহলে সমাজ,জাতি এবং পুরোদেশ এই নির্লজ্জ ও নগ্ন সংস্কৃতি থেকে মুক্তি পাবে। আমাদের সমাজে অনেককে দেখি যারা নামাজে-কালামে অনেক সচেতন,মসজিদে প্রথম সারিতে তার স্থান, মানুষদের প্রতি হেদায়াতের বাণী ছুঁড়ে দেয় কিন্তু তার পরিবারের স্ত্রী -মেয়ের প্রতি কোন খবর নেই। বেপরোয়া এবং বেপর্দা তাদের চলাফেরা। এসব ব্যক্তিদের প্রতি আল্লাহর নবী (সা.) কঠোর হুশিয়ারি দিয়েছেন। তারা জান্নাতের সুঘ্রাণ পর্যন্ত পাবেনা। অতএব যেকোনো অপসংস্কৃতি রোধ পরিবার থেকে রোধ করতে হবে।

আসুন ইসলামে ভালোবাসার গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে জেনে নিই, পরস্পরের প্রতি ভালবাসা একটি স্বভাবজাত বিষয়। মানুষ নিজের প্রয়োজনে, ভবিষ্যতে কারো সাহায্য পাওয়ার জন্য, অতীতে কারো কাছ থেকে সাহায্য পাওয়ার কারণে একে অপরকে ভালবেসে থাকে। কিন্তু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দুনিয়ার কোন স্বার্থ ব্যতীত কোন মুসলিম অন্য মুসলিম ভাইকে ভালবাসা একটি বড় ইবাদত। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য অন্য মুমিনকে ভালবাসা ও একসাথে কাজ করা ঈমানের দাবী । তাছাড়া পরস্পর ভালোবাসা সাহাবিদের বৈশিষ্ট্য। যা রাসুল (সা) এর মদিনা হিজরতে পরিলক্ষিত হয়। মুহাজিরদের প্রতি আনসারদের যে উদারতা, ভালোবাসার ছিলো তাতে স্পষ্টভাবে প্রস্ফুটিত হয়।

পরস্পর ভালোবাসার মাধ্যমে ঈমানী স্বাদ লাভ হয় এবং ঈমানের পূর্ণতা লাভ হয়, রাসুল (সা) বলেন,”যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য কাউকে ভালবাসে, আর আল্লাহর জন্য কারও সাথে বিদ্বেষ পোষণ করে এবং আল্লাহর জন্যই দান-খয়রাত করে আবার আল্লাহর জন্যই দান-খয়রাত থেকে বিরত থাকে সে যেন ঈমান পূর্ণ করল”। (আবুদাউদ,মিশকাত)।

ভালোবাসায় আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন হয়, “এব্যাপারে রাসুল (সা) বলেন,”এক ব্যক্তি তার কোন (মুসলমান) ভাইয়ের সাথে সাক্ষাতের জন্য অন্য গ্রামে রওয়ানা হয়, পথে আল্লাহ তার জন্য একজন ফেরেশতা নিয়োগ করে দেন। অতঃপর তিনি একথা পর্যন্ত হাদীছ বর্ণনা করেন যে, (ফেরেশতা তাকে বলেন) নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাকে এরূপ ভালোবাসেন, যেরূপ তুমি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে অমুক ব্যক্তিকে ভালোবাস”।

পরস্পর ভালোবাসার মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য লাভ হয়, হাদীস শরীফে রাসুল (সা) ইরশাদ করেন, “যে ব্যক্তি কোন মুমিনের দুনিয়াবী বিপদসমূহের কোন বিপদ দূর করে দিবে, আল্লাহ ক্বিয়ামতের দিন তার (কঠিন) বিপদসমূহের কোন একটি বিপদ দূর করে দিবেন। যে ব্যক্তি কোন অভাবগ্রস্ত লোকের অভাব সহজ করে দিবে, আল্লাহ দুনিয়া ও আখেরাতে তার অভাব সহজ করে দিবেন। আর যে ব্যক্তি কোন মুসলিমের দোষ-ত্রুটি গোপন করে, আল্লাহ দুনিয়া ও আখেরাতে তার দোষ-ত্রুটি গোপন রাখবেন। আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে ততক্ষণ পর্যন্ত সহযোগিতা করেন যতক্ষণ সে তার অপর ভাইয়ের সাহায্যে রত থাকে”।(মুসলিম,মিশকাত) উল্লেখিত হাদিস শরীফ পরস্পর ভালোবাসার প্রতি উৎসাহ প্রদান নয় কী? ভালোবাসায় আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য লাভ হয়,সম্মান বৃদ্ধি পায়, হাদীস শরীফে এসেছে, “কোন বান্দা অন্যকে আল্লাহর উদ্দেশ্যে ভালোবাসলে, তার রব তাকে সম্মানিত করেন”।(আহমদ,মিশকাত) কিয়ামতেন কঠিন মুহূর্তে মহান আল্লাহ তাঁর সাতশ্রেণির প্রিয় বান্দাদের আরশের নিচে ছায়া দিবেন, যাদেরকে ” ভিআইপি পারসোন” হিসেবে অভিহিত করা যায়।

তন্মধ্যে অন্যতম হলো, যারা পরস্পরকে ভালোবাসে, রাসুল (সা.) বলেন,”আল্লাহ সাত শ্রেণীর লোককে তাঁর সুশীতল ছায়াতলে স্থান দিবেন, যেদিন তাঁর ছায়া ব্যতীত আর কোন ছায়া থাকবে না। তাদের একশ্রেণী হ’ল ঐ দুই লোক যারা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই একে অপরকে ভালবাসে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়”।(বুখারী,মিশকাত)। পরস্পরের প্রতি ভালোবাসার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মর্যাদা হলো,কিয়ামতের দিন তাদের চেহারা মণি-মুক্তার চেয়েও আলোকিত হবে,হাদীস শরীফে এসেছে, আল্লাহ ক্বিয়ামতের দিন এমন একদল লোকদেরকে পুনরুত্থান করাবেন যাদের চেহারা হবে মণি-মুক্তার চেয়ে নূরানী, যাদেরকে দেখে লোকেরা ঈর্ষা করবে অথচ তারা নবীও নন শহীদও নন।… অতঃপর সে (ছাহাবী) বলল, হে আল্লাহর রাসূল! তাদের বৈশিষ্ট্য বলুন, যাতে আমরা তাদেরকে চিনতে পারি। রাসূল (ছাঃ) বললেন, তারা বিভিন্ন গোত্রের যারা আল্লাহর জন্য পরস্পরকে ভালোবাসতেন এবং তারা বিভিন্ন দেশের যারা আল্লাহকে স্মরণ করার জন্য একত্রিত হতেন’।(সহীহ আত-তারগিব)। অতএব,বুঝা গেলো ইসলামে ভালোবাসার প্রতি উৎসাহ করা হয়েছে। কিন্তু তা হতে হবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে এবং শরীয়তসম্মত।

ভালোবাসা আমাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। কারণ, এটি হৃদয়ের এক শক্তিশালী অনুভূতি, আনন্দ,প্রত্যাশা, আবেগ। পৃথিবীর সবকিছু ভালোবাসার কাছে পরাজিত। পরিবার,সমাজ, জাতি এবং দেশ সৌন্দর্যমন্ডিত,সমৃদ্ধ ও আলোকিত হয় পারস্পরিক সম্প্রীতি, ভালোবাসার মাধ্যমে।

লেখক : শিক্ষার্থী, আরবি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!