নিউজ ডেক্স : দক্ষিণ চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার সবজির রাজ্য হিসাবে খ্যাত ছদাহা, বাজালিয়া, পুরানগড়, আমিলাইশ ও চরতি ইউনিয়নের ফসলি জমিতে তামাকের আগ্রাসনে কমে যচ্ছে সবজির আবাদ। সবজির রাজ্যে হামলা দিয়েছে তামাকের বিষাক্ত থাবা। তামাকের আগ্রাসনের মূল লক্ষ্য উপজেলার নিরক্ষর কৃষক এবং কৃষি জমি। তামাকের আগ্রাসনের বিষাক্ত থাবা প্রসার লাভ করেছে সাতকানিয়ার ফসলি জমি। তামাকের ঝাঁঝাঁলো বিষাক্ত গন্ধে এসব এলাকার এক সময়ের ধান আর রবিশষ্যের ফসলী সুগন্ধ হারিয়ে যাচ্ছে । এখানের কৃষি জমি ক্রমাগত গ্রাস করছে তামাক চাষ। পরিবেশ বান্ধব রবিশষ্যের পরিবর্তে ক্রমান্বয়ে বিস্তার লাভ করছে পরিবেশ ও কৃষি জমির উর্ব্বরা শক্তি বিধ্বংসী তামাক। তামাকের এ আগ্রাসন ত্বরান্বিত করার কাজে অগ্রনী ভূমিকা পালন করছে সিগারেট কোম্পানীগুলো। অধিক আয়ের লোভ দেখিয়ে বিভিন্ন সিগারেট কোম্পানীগুলো সুকৌশলে নিরক্ষর কৃষকদের তামাক চাষে উৎসাহিত করছে। অনেক ক্ষেত্রে কৃষি ঋণ, সার-কীটনাশক ও বীজসহ নানা কৃষি উপকরণ সরবরাহ দিয়ে তামাক চাষে বাধ্য করছে গরীব কৃষকদের। অনেকটা নীলকর বৃটিশ বেনীয়াদের মতই।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, উপজেলার কেঁওচিয়া হরিণতোয়া মাহালিয়া বিলে মেক্তার আহমদ ও এজাহার মিয়া ১২ একর জমিতে তামাকের চাষ করেছেন।
এ সময় তামাক চাষী মোক্তার আহমদ জানান, আমি এখানে ছাড়াও খোর্দ্দকেঁওচিয়া এলাকায় প্রায় ৫ একর একর জমিতে তামাক চাষ করেছি।
তামাক চাষী এজাহার মিয়ার স্ত্রী দিলোয়ারা বেগম বলেন, অগ্রাহায়ন মাসে বীজ সরবরাহ করার পর রোপন করি। পরবর্তী বৈশাখ মাসের শেষে দিকে তামাক কাটা হয়। তিনি আরো জানান, গোল্ডলিপ কোম্পানী প্রথম দিকে আমাদের কাছ থেকে প্রতি কেজি ক্রয় করেছিল ১৫০ টাকায়। গত বছর প্রতি কেজি বিক্রি করেছি ৪৬০ টাকায়। এ বছর দাম আরো বাড়তে পারে। এজাহার মিয়া জানান, ভাল বীজ বপন করে ঠিকমত কীটনাশক ও সার প্রয়োগ করতে পারলে প্রতি একর জমিতে ১৮-২০ মন তামাক উৎপাদন করা যায়।
এসব এলাকার জনগন জানান, বিগত ৩ বছর ধরে উপজেলার উল্লেখিত পাহাড়ী জনপদের আবাদী জমি ও নদী তীরবর্তী চরাঞ্চলের আবাদী জমিগুলোতে তামাকের আগ্রাসন শুরু হয়েছে যার কারনে এসব এলাকায় পরিবেশ বিপর্যয় ঘটছে। বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হচ্ছে জীব-বৈচিত্র্যের। শষ্যের সবুজ বিপ্লব আর সবুজের সমারোহ ধীরে ধীরে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছে। স্বল্প ব্যয় আর অল্প খাঁটুনিতে যেখানে একর প্রতি ধান কিংবা রবিশষ্য চাষে মৌসূমে কৃষকের আয় ২০/৩০ হাজার টাকা, সেখানে সিগারেট বা তামাক কোম্পানীগুলো আরো অধিক মুনাফার জাল ফেলে কৃষকদের তামাক চাষে আকৃষ্ট করছে বলে মন্তব্য করেছেন সচেতন মহল । তামাক চাষে পরিশ্রম বেশী হলেও কৃষকরা অধিক লাভের ফাঁদে পড়ে ক্ষতিকর তামাক চাষের দিকে ঝুঁকছে। তামাক চাষে অতিরিক্ত ইউরিয়া সার ও নানা জাতের বিষাক্ত কীটনাশক প্রয়োগ করতে গিয়ে কৃষকরা ক্যান্সার, লীভার সিরোসিস, হাঁপানী, চর্মরোগ ও জন্ডিসের মত নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। কৃষিবিদরা জানান, জমিতে ফসলের শ্রেনী বিন্যাস বা চক্রমিক চাষ না করার কারনে অর্থ্যাৎ একই জমিতে বারবার তামাক চাষের ফলে মাটির প্রানশক্তি হিউমাস ধ্বংস হয়ে উর্ব্বরতা হ্রাস পাচ্ছে। সাতকানিয়া উপজেলার ছদাহা ও বাজালিয়া ইউনিয়নের হাঙ্গর খালের চরে যেখানে তামাক চাষ হচ্ছে সেখানে প্রয়োগ করা হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত হারে কীটনাশক। যার ফলে হাঙ্গর খালসহ এলাকার বহু শাখা নদীর মিটে পানির দেশীয় প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। অপরদিকে উৎপাদিত তামাক কিউরিং করতে স্থাপন করা হচ্ছে তন্দুর বা চুল্লী। যার অধিকাংশই স্থাপিত হয় জনবসতি ও সরকারী সংরক্ষিত বন বাগানের নিকটতম এলাকায়। চুল্লীর জ্বালানীর জোগান দিতে উজাড় হচ্ছে সংরক্ষিত বনভূমি। এসব এলাকায় সিগারেট কোম্পানীগুলো নিরক্ষন কৃষকদের অধিক লাভের প্রলোভন দিয়ে জমি লিজ নেয় এবং তামাক চাষে উদ্বুদ্ধ করে। ক্ষেত্র বিশেষে কোম্পানীর পক্ষ থেকে চাষের ব্যয় হিসেবে একর প্রতি ২০/২৫ হাজার টাকা লোনও দিয়ে থাকে। উৎপাদন শেষে এ লোন তামাকের বিক্রয়মূল্য থেকে কর্তন করে নেয় কোম্পানীগুলো। এসব এলাকায় বাংলাদেশ টোবাকো, গোল্ডলিপ, আকিজ কোং, আবুল কোং ও আজিজ কোং এর মত নামকরা কোম্পানীগুলো তামাক চাষের জন্য কোটি কোটি টাকা ব্যয় করছে বলে জানা যায়। এসব এলাকায় বেশ কয়েকটি সিগারেট কোম্পানী তামাক চাষে ব্যয় করলেও এ এলাকার জনসাধারনের মুখে গোল্ডলিপ কোম্পানীর নামই বেশী শুনা যায়। হাইব্রিড প্রজাতির এসব তামাক এলাকায় গোল্ডলিপ তামাক হিসেবে পরিচিত। এ ব্যাপারে গোল্ডলিপ কোম্পানীর দক্ষিণ চট্টগ্রামের কৃষক সমন্বয়কারী সুব্রত দাশের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তার মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
সাতকানিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. শোয়েব মাহমুদ বলেন, বছর তিনেক ধরে সাতকানিয়ায় তামাক চাষ শুরু হয়েছে। তামাক চাষীসহ এলাকার অন্যান্য কৃষকদের সাথে আমরা যোগাযোগ করে তামাক চাষের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরার চেষ্টা করছি যাতে তারা তামাক চাষে নিরুৎসাহিত হয়।
ছদাহা ইউপি চেয়ারম্যান মো. মোসাদ হোসেন চৌধুরী জানান, চাষীদের তামাক চাষ নিরুৎসাহিত করা বিষয়ে প্রশাসনের সহযোগিতা পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।