নিউজ ডেক্স : লোহাগাড়া উপজেলার আধুনগর ইউনিয়নের গ্রাম কূলপাগলী। টিলা, পাহাড় আর জঙ্গল ভেদ করে চলে গেছে কাঁচা-পাকা সড়ক। একটু সন্ধ্যা হলেই ঝিঁঝিঁ পোকা রাতকে আরও গভীর করে। কিন্তু ঝিঁঝিঁ-ডাকা সে গ্রামে শিক্ষার প্রসারে আলোকবর্তিকা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কূলপাগলী প্রাথমিক বিদ্যালয়। আজ থেকে ছয় বছর আগেও সেটা ছিল পরিত্যক্ত জঙ্গল। গ্রামের কাছাকাছি ছিল না কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। গ্রামবাসী ঐক্য, সদিচ্ছা আর সাহস নিয়ে গড়ে তুলেছিল এই স্কুল।
লোহাগাড়া উপজেলার তৎকালীন ইউএনও মোহাম্মদ ফিজনুর রহমানের উৎসাহ ও গ্রামবাসীর স্বেচ্ছাশ্রমে স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয় ২০১৪ সালে। বর্তমানে কূলপাগলী গ্রামের ৩০০ ছাত্রছাত্রী প্রাথমিক শিক্ষা নিচ্ছে।
স্কুল কমিটির সভাপতি নুরুল কবির বলছিলেন পরিত্যক্ত জঙ্গলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার গল্প। ‘আমি এর আগে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটির সঙ্গে জড়িত ছিলাম। ইউএনও ফিজনুর রহমানের সঙ্গে এক দিন কথা বলার সুযোগ হয়। তাকে বলি, আমাদের গ্রামটি অবহেলিত। কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। গ্রামটি দেখতে আসুন। তিনি এক দিন চলে এলেন। তখন জঙ্গলের এক কোণে আমরা ঘর করে একটি ফোরকানিয়া মাদ্রাসা চালাতাম। সেখানে পাটি পেতে তাকে বসতে দিলাম। গ্রামের নারী-পুরুষরা এসে বললেন, স্যার, আমাদের একটি প্রতিষ্ঠান করে দেন।
পরে ইউএনও উপজেলার বিত্তবানদের কাছে স্কুল প্রতিষ্ঠায় আর্থিক সাহায্যের বার্তা পাঠালেন। বিত্তবানরা ইট, সিমেন্ট, বাঁশ, কাঠ, টিন নিয়ে এগিয়ে আসেন। আর শ্রমিক হিসেবে কাজ করি আমরা গ্রামের নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর, এমনকি ৭০ বছরের বৃদ্ধা পর্যন্ত। এক মাসের মধ্যেই উঠে দাঁড়াল গ্রামবাসীর স্বপ্নের স্কুলঘর।’
সরেজমিন জানা যায়, এই স্কুল প্রতিষ্ঠায় বেশি শ্রম দিয়েছেন গ্রামের নারীরা। তারা মাটি কেটেছেন, গাছ লাগিয়েছেন। এমনকি চালায় টিন লাগাতেও হাত দিয়েছেন। রাজমিস্ত্রির কাজ করেছেন পুরুষরা। তাদের সঙ্গে ইট, সিমেন্ট আনায় হাতে হাত রেখেছেন গ্রামের নারীরা। স্কুল প্রতিষ্ঠায় শ্রম দিয়েছিলেন গ্রামের এমন এক বৃদ্ধা বলেন, ‘আমাদের শ্রম ও ঘামের ফসল স্কুলটি। আমরা স্কুলের জন্য সকাল সকাল কাজে লেগে যেতাম। কাজ শুরু করার আগে বড় স্যার (ইউএনও ফিজনুর রহমান) আমাদের জন্য কলা, পাউরুটি নিয়ে হাজির হতেন। আমরা তো বাবা ‘অন্ধ’। তিনি আলো দেখিয়েছেন বলেই আমাদের গ্রামে স্কুল পেয়েছি।’
স্কুলটি হওয়ায় শুধু গ্রামবাসী নয়, এর দক্ষিণ পাশে গড়ে ওঠা আশ্রয়ণ প্রকল্পের দেড়শ পরিবারের সন্তানরাও পড়ালেখার সুযোগ পাচ্ছে। স্কুলটি হওয়ার আগে আশ্রয়ণ প্রকল্পের কোনো ছেলেমেয়ে স্কুলে যেত না। চট্টগ্রাম জেলার তৎকালীন ডিসি মিসবাহ উদ্দীন গ্রামবাসীর স্বতঃস্ম্ফূর্ততায় স্কুলের জন্য সৌরবিদ্যুতের ব্যবস্থা করে দেন। পরবর্তী সময়ে ২০১৯ সালে স্কুলটি সরকারের তালিকাভুক্ত হয় এবং সরকার থেকে একটি দালান দেওয়া হয়। এক একর ১৩ শতকজুড়ে স্কুলের আঙিনা। কিন্তু এর চারপাশে কোনো সীমানা প্রাচীর না থাকায় স্কুলটি অরক্ষিত। কয়েকজন গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা হয়। তারা বলেন, ‘আমরা একটি হাইস্কুল চাই। এই প্রাইমারি স্কুলটি হওয়ার কারণে আমাদের সন্তানরা কলম ধরা শিখছে। এখন একটি হাইস্কুল হলে আমাদের সন্তানরা উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাবে।’ প্রান্তিক অঞ্চলে সবার সহযোগিতায় কীভাবে একটি প্রতিষ্ঠান দাঁড়াতে পারে, এর অন্যতম উদাহরণ কূলপাগলী স্কুল। স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক দিদারুল ইসলাম বলেন, করোনাকালে আমরা শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পড়িয়েছি। বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিক্ষার্থী সংগ্রহ করেছি। এখন গ্রামের সব ছেলেমেয়ে স্কুলে পড়ে।’
তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক মোহাম্মদ ফিজনুর রহমান বলেন, আঁধারে ঢেকে ছিল কূলপাগলী গ্রাম। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগ মানুষের পাহাড়ে বসবাস। শিক্ষা থেকে বঞ্চিত তাদের ছেলেমেয়ে। কূলপাগলী গ্রামের নাম সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ুক- এই ভাবনা থেকেই গ্রামের নামে স্কুলের নামকরণ করি। গ্রামের সবাই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখেছে। স্বেচ্ছাশ্রমে এলাকার মানুষের ঘামে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত। -সমকাল অনলাইন