মারুফ খান : বুদ্ধি-শুদ্ধি হবার পর থেকে শুনে ও দেখে আসছি লোহাগাড়ায় বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়মেলার আয়োজন হয়। জানুয়ারী মাসে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়মেলার আয়োজন করতে এ পর্যন্ত কোনদিন দেখি ও শুনি নাই। তবে লোহাগাড়া এ অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখিয়েছে। কিছু অসাধু চক্র মুক্তিযুদ্ধের বিজয়মেলা নাম ভাঙ্গিয়ে চালিয়ে যাচ্ছে রমরমা অবৈধ জুয়ারমেলা। যা এখনকার মুক্তিযুদ্ধের বিজয়মেলা ‘মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের’ এক রকম অপমানিত করছে।
মুক্তিযুদ্ধের বিজয়মেলার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে স্বাধীনতা যুদ্ধের সকল বীর সৈনিকদের আত্মত্যাগ ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের বীরত্বপূর্ণ ইতিহাস নিরপেক্ষ ভাবে তুলে ধরা। নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানানো।
কিন্তু বর্তমানে লোহাগাড়ায় মুক্তিযুদ্ধের বিজয়মেলার নামে যে পাপাচার হচ্ছে তা কোনভাবে মেনে নেয়া যায় না। বিজয়মেলা আয়োজকরা নতুন প্রজন্মকে ‘মুক্তিযুদ্ধ’ সম্পর্কে এসব কি ম্যাসেজ দিচ্ছে ? বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়মেলার নামে চলছে আধুনিক ও নিত্যনতুন জুয়া খেলা ও অশ্লীল নাচ-গান। নেই কোন মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠান ও প্রামাণ্যচিত্র। শুধুমাত্র বিজয়মেলা প্রাঙ্গণে ঢুকার মূলফটকে “মুক্তিযুদ্ধের বিজয়মেলা” নাম সর্বস্ব ব্যানারে সীমাবদ্ধ।
অপরদিকে, সকাল থেকে রাত ব্যাপী উপজেলার প্রতিটি ষ্টেশন ও গ্রামে ‘জুয়ার মেলা’র লাকীকুপন বিক্রি করছে মাইক ব্যবহার করে। মাইকিং’র বিরক্তিকর শব্দের উপজেলাবাসী জনজীবন অতিষ্ট হয়ে উঠেছে। উপজেলাব্যাপী ব্যাপক শব্দ দূষণে নানা সমস্যায় ভূগছে স্ব স্ব এলাকাবাসী। এছাড়াও সামনে এসএসসি পরীক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় ব্যাপক বিঘœ ঘটছে। নৈতিক অবক্ষয় হচ্ছে যুবক সমাজের।
ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আশির দশকে চট্টগ্রামে প্রথম ‘মুক্তিযুদ্ধের বিজয়মেলা’ চালু হয়। তখনকার সময়ে বাংলাদেশের সকল শীর্ষ বুদ্ধিজীবি রাজনীতিবিদরা আসতেন চট্টগ্রামের বিজয় মেলায়। বিজয়মেলায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠান হতো। মানুষ চেতনাকে সঠিকভাবে ধারণ করতে পেরেছিল বলে সেই বিজয়মেলা অসম্ভব জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। একসময় সেই বিজয়মেলা সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে যায়। বর্তমানে সারাদেশে যত বিজয়মেলা হয় তার আদি জননী চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজের মাঠের সেই প্রথম বিজয়মেলা। সূচনার সেই বিজয়মেলাটার চেহারা কতটা মহিমাময় ছিল, কতটা মুগ্ধকর ছিল।
আস্তে আস্তে মেলায় নানা উৎপাত যুক্ত হতে থাকে। একসময় বিজয়মেলা তার সাংস্কৃতিক চরিত্রটা হারিয়ে হয়ে গেল যেন তেন একটা মেলা। দায়সারা একটা অনুষ্ঠান মাত্র। যে বিজয়মেলায় সারাদেশ থেকে বিচিত্র সব পণ্যের সমাহার ঘটতো, সেই বিজয়মেলা বাজারী পণ্যে ও জুয়ার মেলা হয়ে গেল। এখনো বিজয়মেলা হয় প্রতিবছর। কিন্তু এই বিজয়মেলা একটা সাইনবোর্ড মাত্র। বিজয় মাসের কোন আমেজ তাতে নেই, সেই চেহারা, সেই গন্ধ, সেই ভাষা, সেই চরিত্র কিছুই নেই।
মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আমার নির্ভেজাল শ্রদ্ধা-ভালোবাসা ছিল, আছে, থাকবে। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়মেলা যেন জুয়ারমেলায় পরিণত না হয় সেদিকে সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়মেলা জিন্দাবাদ, জুয়ারমেলা নিপাত যাক।
লেখক : প্রকাশক, লোহাগাড়ানিউজ২৪ডটকম