নিউজ ডেক্স : অপরিচিত এক ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে আকস্মিক একটি ছবি পেলেন কলেজছাত্রী প্রিয়াংকা (ছদ্মনাম)। কিছুক্ষণের মধ্যে পেলেন একটি ভিডিও। ছবি-ভিডিও দেখে বিস্ময়ে আকাশ থেকে পড়লেন তিনি। এগুলো তো নিজের ছবি!
বন্ধুর সঙ্গে একান্তে সময় কাটানোর ছবি-ভিডিও কীভাবে গেল অপরিচিত ওই ফেসবুক ব্যবহারকারীর কাছে?-এমন তথ্য যাচাই করতেই ফোন করলেন বন্ধু ছাত্রলীগ নেতা রবিনকে (ছদ্মনাম)। দুজন কথা বলে বুঝতে পারলেন রবিনের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাকড হয়েছে। হ্যাকার নিজেই প্রিয়াংকার কাছে পাঠিয়েছে দুজনের একান্ত সময়ে তোলা ছবি-ভিডিওগুলো।
ছাত্রলীগ নেতা রবিন ও কলেজছাত্রী প্রিয়াংকা আতঙ্কে অস্থির। হ্যাকারের কবল থেকে কীভাবে রক্ষা পাওয়া যায়। আর কীভাবেই বা ছবি-ভিডিওগুলো উদ্ধার করা যায়। রবিন-প্রিয়াংকা যখন নিজেদের মুক্তির উপায় খুঁজছিলেন, তখন হ্যাকার খুঁজছিল তার পথ। তিনি প্রিয়াংকাকে প্রস্তাব দিলেন ভিডিও কল করতে। এবার শরীরের নানা অঙ্গভঙ্গি করার প্রস্তাব দিয়ে বসলেন। সঙ্গে শর্ত জুড়ে দিলেন, যদি প্রিয়াংকা হ্যাকারের কথা না শুনেন তাহলে বন্ধুর সঙ্গে তোলা সমস্ত ছবি-ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেবেন।
মুহূর্তেই রবিন-প্রিয়াংকার জীবনে অন্ধকার নেমে আসে। রবিন চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের একজন দাপুটে নেতা। বিপুলসংখ্যক অনুসারী তাঁর। নগর ছাত্রলীগের রাজনীতিতে রীতিমত দাপুটে নেতা রবিন এবার ফেঁসে গেলেন হ্যাকারের হাতে। তাঁর ভাবনায় নিজের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার এবং মানসম্মান। বিপুলসংখ্যক অনুসারীর কাছে তিনি ছোট হয়ে যাবেন। মানসম্মান বলতে কিছুই থাকবে না। রাজনৈতিক ও সামাজিক মর্যাদাহানি এড়াতে তিনি আত্মহত্যা করবেন বলে মনস্থির করলেন।
অন্যদিকে রবিনের বান্ধবী কলেজছাত্রী প্রিয়াংকা ভাবলেন, মানসম্মান সব শেষ। রবিনকেও ভুল বোঝলেন তিনি। কেন ম্যাসাঞ্জারে এতোসব ছবি ভিডিও রাখতে গেল রবিন। কেনই বা দুজন ভিডিও চ্যাটিং করল কিংবা একান্ত ব্যক্তিগত ছবিই বা কেন নিজেদের মধ্যে আদান প্রদান করল-এসব নিয়ে। শেষ পর্যন্ত প্রিয়াংকাও মনস্থির করেন আত্মহত্যার।
প্রেমিক যুগলের এমন দুঃসময়ে রবিন গত ২৩ আগস্ট গেলেন নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার (বন্দর) মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর কাছে। নিজের সমস্যার কথা খুলে বললেন এবং হ্যাকারের হাত থেকে রক্ষার আকুতি জানালেন।
ছাত্রনেতার এমন সমস্যার কথা শুনে সহযোগিতায় এগিয়ে এল গোয়েন্দা পুলিশ। উপ-কমিশনার মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁর দলের সদস্যদের দায়িত্ব দিলেন হ্যাকার চিহ্নিত করার কাজ শুরু করতে।
রবিন যখন গোয়েন্দা পুলিশ কার্যালয়ে তখন প্রিয়াংকা হ্যাকারের কবলে। হ্যাকার প্রিয়াংকাকে শেষবারের মতো শর্ত দেয়, ভিডিও কলে হ্যাকার যেভাবে যে ভঙ্গিমায় আসতে বলবে, প্রিয়াংকাকে সেভাবে অঙ্গভঙ্গি করতে হবে। না হলে ছবি-ভিডিও আপলোড করা শুরু করবে। এ বিষয়ে প্রিয়াংকে সিদ্ধান্ত নিতে এক ঘণ্টা সময় বেঁধে দেয় হ্যাকার। এক ঘণ্টার মধ্যেই প্রিয়াংকাকে হ্যাকারের কথা মতো কাজ করতে হবে, অন্যথায় সব ছবি-ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেবে হ্যাকার।
এরই মধ্যে গোয়েন্দা পুলিশকে এক ঘণ্টার সময় বেঁধে দেওয়ার বিষয়টি রবিনের মাধ্যমে জানিয়ে দেন প্রিয়াংকা। তাঁকে অভয় দিয়ে গোয়েন্দা কর্মকর্তা মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ হ্যাকারকে ধরার আশ্বাস দেন।
এক ঘণ্টা সময় পেরিয়ে যায়। হ্যাকার প্রথমে কয়েকটি ছবি আপলোড করে। তাত্ক্ষণিক বিষয়টি গোয়েন্দা পুলিশের নজরে আসে। পুলিশের একটি দল হ্যাকারের সঙ্গে ‘নেটযুদ্ধ’ শুরু করে। হ্যাকার আপলোড করলে গোয়েন্দা পুলিশ সেই ছবি সরিয়ে নিতে সক্ষম হয়। এভাবে বেশ কিছু সময় কেটে যায়। হ্যাকার-গোয়েন্দার নেটযুদ্ধ চলতে থাকে। মধ্যরাতে শুরু হওয়া নেটযুদ্ধ শেষ হয় শেষ রাতে। গোয়েন্দা পুলিশ হ্যাকারকে বার্তা দিতে সক্ষম হয়, তুমি যা করছ, তা অন্যায়। তোমার অবস্থান শনাক্ত করে তোমাকে আইনের আওতায় আনা হবে। পরে হ্যাকার ‘নেটযুদ্ধ’ থেকে অন্ধকারে হারিয়ে যায়।
ঘটনার বিষয়ে গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ‘রাজনৈতিক ও সামাজিক মর্যাদার কথা বিবেচনা করে রবিন ও প্রিয়াংকা এ ঘটনায় মামলা করতে রাজি হননি। তবে হ্যাকারকে ধরতে গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত আছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোনো অবস্থাতেই একান্ত ব্যক্তিগত ছবি, ভিডিও ইত্যাদি রাখা যাবে না। স্পর্শকাতর ছবি-ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আদান-প্রদান না করাই ভালো। আদান প্রদান করলে কিংবা ভিডিও চ্যাটিং করলে তাহলে অ্যাকাউন্ট যদি হ্যাকড হয়, তবে বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা থাকে।’
তিনি জানান, প্রিয়াংকা ও রবিন দুজনকে আত্মহত্যার পথ থেকে সরে আসতে মোটিভেশন করা হয়েছে। এর পর তাঁদের স্ব স্ব পরিবারের সদস্যদের জিম্মায় দেওয়া হয়।
সূত্র : কালের কন্ঠ