ফিরোজা সামাদ : বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ অবিচ্ছেদ্য ইতিহাস। দেশ এবং দেশের মানুষের প্রতি দেশের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসা কিংবদন্তির মতো প্রবহমান অনন্ত ভবিষ্যতে। বঙ্গবন্ধু অপার এক বিস্ময়ের নাম। বঙ্গবন্ধু সৃষ্টির অনন্য এক উপহার স্রষ্টার তরফ থেকে ।
আমরা বঙ্গবন্ধুর “অসমাপ্ত আত্মজীবনী ” তে দেখতে পাই… জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছিলেন এক উদ্যমী কিশোর, সাহসী যুবক, দৃঢ়চেতা বিচক্ষণ ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন । যার চিন্তা ও চেতনার বৃহৎ অংশ জুড়েই ছিলো দেশের জন্য সাধারণ মানুষের জন্য কল্যাণ ভাবনা। এই কল্যাণ ভাবনা থেকেই তিনি উপলব্ধি করতেন মানুষের সংকট এবং সংকটের গভীরতা। খুঁজতেন মুক্তির উপায় । তাঁর অন্তরের বিশ্বাসকে তিনি প্রকাশ করতেন গভীর উপলব্ধিবোধ থেকে। তরুণ বয়সে তাঁর সেই উপলব্ধি…. “যে কোনো মহৎকাজ করতে হলে ত্যাগ ও সাধনার প্রয়োজন। যারা ত্যাগ করতে প্রস্তুত না তারা জীবনে কোনো ভাল কাজ করতে পারেনি, এ আমার বিশ্বাস ছিল। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, এ দেশে রাজনীতি করতে হলে ত্যাগের প্রয়োজন আছে এবং আমাদের ত্যাগ করতে হবে, পাকিস্তানের জনগণকে সুখী করতে হলে”। (সূত্র: অসমাপ্ত আত্মজীবনী পৃষ্ঠা ১২৮)”
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর উপলব্ধিতে অত্যন্ত স্বচ্ছ মানুষের মনোজগৎ তাদের মানসিকতা, আচার-আচরণ। তরুণ বয়সে মানুষকে ভালোবেসে, তাদের কষ্ট দূর করতে, মানুষকে সুখী করার চিন্তায় তিনি যে লক্ষ্য স্থির করেছিলেন সেই লক্ষ্যে স্থির ছিলেন প্রতি মুহূর্তে । নিজের জীবনকে তিনি অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছিলেন মানুষের জন্য । তাই তো তিনি অকপটে বলতে পেরেছিলেন “আমরা এ দেশের শাসক নই, আমরা এ দেশের সেবক এ কথা মনে রাখতে হবে । জনগণের সেবার জন্যই আমরা নির্বাচিত হয়েছি এবং তাদের সেবাতেই আমাদের আত্মনিয়োগ করতে হবে “। (সূত্র: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান : জীবন ও রাজনীতি, পৃষ্ঠা- ৯২৮)
বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাস এবং এর রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান ছিল বঙ্গবন্ধুর । দারিদ্র্যমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল উদার এক কল্যাণ রাষ্ট্রের স্বপ্নের আলো জ্বালিয়ে ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই আলোর মর্মবাণী যেমন অতীতে ছিলো এদেশের মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসের কেন্দ্রস্থল, তেমনি সেই আলো আগামীরও পথ নির্দেশক।
জাতীয় শোকের মাসে গভীরশ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতার সাথে বিনম্রচিত্তে স্মরণ করছি জাতির পিতাকে। তিনি আমাদের সকলকে স্বাধীন বাংলাদেশের গর্বিত নাগরিক হিসাবে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার মর্যাদা দিয়ে গেছেন। শ্রদ্ধাভরে আরো স্মরণ করছি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শাহাদাত্ বরণকারী সকলকে।
(৩) ঘড়ির কাঁটা ১২টার পর পরই শুরু হয় শোকের মাস। এবছর শোকাবহ আগস্টের প্রথম দিন বুধবার। পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে প্রতিটি বছরই আগস্ট এলেই শোকাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে গোটা বাঙালি জাতি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হন একদল বিপথগামী সেনার হাতে। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট কালরাতে ঘাতকরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি, তাদের হাতে একে একে প্রাণ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিনী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামাল, মেজ ছেলে শেখ জামাল। শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল, শেখ জামালের স্ত্রী রোজী জামালও খুন হন তাদের হাতে। ঘাতকের হাত থেকে রক্ষা পায়নি ছোট্ট শিশুও। সেই রাতে বঙ্গবন্ধুর ছোট ছেলে শেখ রাসেলকেও হত্যা করে ঘাতকরা। বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসেরও রক্ষা পাননি ঘাতকদের হাত থেকে।
আরো হত্যাকাণ্ডের শিকার হন আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মণি ও তার স্ত্রী বেগম আরজু মণি, বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, তার ছোট মেয়ে বেবী সেরনিয়াবাত, ছোট ছেলে আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত আবদুল্লাহ বাবু, শহীদ সেরনিয়াবাত, আব্দুল নঈম খান রিন্টু, বঙ্গবন্ধুর প্রধান নিরাপত্তা অফিসার কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদ।
অসম্ভব সাংগঠনিক ক্ষমতার অধিকারী এই মহান নেতা লক্ষাধিক লোকের চোখের ইশারাকে ঠিকই বুঝে ফেলেছিলেন ৭ মার্চের ভাষণের দিন। ‘মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। তোমাদের কাছে যার যা কিছু আছে,তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।’
বঙ্গবন্ধুর ভাষণে উদ্দীপ্ত হয়েই একাত্তরে স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তি পাগল মানুষ। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের কয়েকজনের বিচারের রায় ইতোমধ্যে কার্যকর করে জাতি কলঙ্কমুক্ত হয়েছে। বাকিদেরও ফিরিয়ে আনবে সরকার।
বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত এই নেতা বেঁচে থাকবেন বাঙালির অন্তরে অন্তরে। পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক দেশটি যতোদিন থাকবে ততোদিন বাঙালি হৃদয়ে বঙ্গবন্ধুর নাম চিরভাস্বর হয়ে থাকবে।বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসায় বঙ্গবন্ধু মৃত্যুঞ্জয় হয়ে আছেন জাতির পিতায় ভূষিত হয়ে।
স্মরণের অমরতায় জড়িয়ে আছে বঙ্গবন্ধুর উদাত্তকণ্ঠের আহ্বান যা পথ নির্দেশ করে ভবিষ্যতের। বঙ্গবন্ধু বলেন…. ” আমাদের কাজ করতে হবে। আমাদের জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। বাঙালি জাতি যে প্রাণ, যে অনুপ্রেরণা নিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছিল সে প্রাণ, সেই অনুপ্রেরণার মতবাদ নিয়ে অগ্রসর হতে হবে, দেশের দুঃখী মানুষকে মুক্তি দেওয়ার জন্য, তাদের মুখে হাসি ফোটাবার জন্য । এ জন্য যারা যেখানে আছেন, যারা দেশকে ভালোবাসেন, সকলকে আমি আহ্বান করবো আসুন দেশ গড়ি । আসুন দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটাই । আসুন দেশের মানুষের দুঃখ দূর করি “। (সূত্র: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: জীবন ও রাজনীতি, পৃষ্ঠা ৯০৬) ।
৪৩ বছর আগে বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু জীবিত অবস্থায় তিনি যেমন দেশের রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন, মৃত্যুর পরও রাজনৈতিক অঙ্গনে তিনি সমভাবে উপস্থিত রয়েছেন। যাঁরা তাঁর অনুসারী কিংবা বিরোধী, সবার বক্তৃতা-বিবৃতি–আচরণে তাঁর প্রভাব ও ছায়া স্পষ্ট । যে দুঃখী মানুষের জন্য বঙ্গবন্ধু রাজনীতি করতেন, সেই দুঃখী মানুষের মনের ভাষাটি তিনি পড়তে পেরেছিলেন। তাদের আবেগঅনুভূতিকে নিয়ে গিয়েছিলেন উচ্চাসনে।
বাংলাদেশের বয়স ৪৭ বছর। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব দেশ শাসনের সময় পেয়েছেন মাত্র সাড়ে তিন বছর। এই সময়ে বঙ্গবন্ধু যে রাষ্ট্রীয় কাঠামো গড়ে তুলেছিলেন, সেই কাঠামো মতোই সবকিছু চলছে। তিনি গরিব কৃষকের খাজনা মাফ করে দিয়েছিলেন। এখনো ২৫ বিঘা পর্যন্ত যাঁদের জমি আছে, তাঁদের খাজনা দিতে হয় না। তিনি যে শিক্ষানীতি করেছিলেন, সেই শিক্ষানীতির চেয়ে উন্নততর কোনো শিক্ষানীতি কোনো সরকার দিতে পারেনি। তিনি যে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি ঘোষণা করেছিলেন, সেটি এখনো উত্তম বলে বিবেচিত। তিনি যে পরিকল্পনা কমিশন করেছিলেন, সেটাই অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে।
১৯৭৫-এর ১৫ অগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের সঙ্গে সঙ্গেই ভিন্ন পথচলা শুরু হয় সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের। মুখ থুবড়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, প্রশাসন থেকে রাজনীতি। সব জায়গায় জেঁকে বসে পাকিস্তানী প্রেতাত্মাদের ভূত। জাতির জনককে হত্যার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বাংলাদেশ বেতার হয়ে গিয়েছিল রেডিও বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধে রণধ্বনী জয় বাংলা বদলে যায় বাংলাদেশ জিন্দাবাদে। বছর না ঘুরতে জেলখানা থেকে স্বদম্ভে বেড়িয়ে আসে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মানবতা বিরোধী অপরাধে জড়িত প্রায় ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধী। যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন, যাঁরা বিশ্বাস করতেন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে, তাঁদের জন্য শুরু হয় অন্ধকার কালান্তর। ১৫ অগস্ট হত্যাকান্ডের পর থেকেই একটানা চেষ্টা চলে বঙ্গবন্ধুকে ভুলিয়ে দেওয়ার। পাঠ্যপুস্তক থেকে মুছে ফেলা হয় বঙ্গবন্ধুর নাম। আওয়ামীলীগসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোর ওপরে চলে ধারাবাহিক নির্যাতন। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার সময়ে দেশের বাইরে ছিলেন তার দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। স্বামী-সন্তানসহ ছয় বছর বিদেশে কাটিয়ে ১৯৮১ সালের ১৯ মে দেশে ফিরতে সক্ষম হন তাঁর বড় মেয়ে শেখ হাসিনা। দুই শিশু সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয় এবং সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে লন্ডনে ছোট বোন শেখ রেহানার কাছে রেখে বাংলাদেশের গণতন্ত্র আর প্রগতিশীলতার রাজনীতি ফেরাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশে ফেরেন তিনি।
দীর্ঘ দিন পরে দেশে ফেরা শেখ হাসিনার জন্য যতটা না আনন্দের ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি বেদনার। রাজনীতির ময়দানের মতোই ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ। প্রকৃতিও যেন একাত্ম হয়ে গিয়েছিল শেখ হাসিনা আর বাঙালির আবেগের সঙ্গে। ১৯ মে-র সেই রবিবার সকাল থেকেই ছিল কালবৈশাখীর প্রবল ঝড়ো হাওয়া, বেগ ছিল ঘণ্টায় ৬৫ মাইল। ঝড়-বৃষ্টি মাথায় নিয়েই সেদিন বিমানবন্দরমুখী হয়েছিল লাখো মানুষ। মুষলধারার বৃষ্টি তাদের সরাতে পারেনি বিমানবন্দর থেকে। দীর্ঘ সাড়ে ছয় বছর পর দেশের মাটিতে পা রেখেই আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন শেখ হাসিনা। তাঁকে এক নজর দেখার জন্য কুর্মিটোলা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে শের-এ-বাংলা নগর পর্যন্ত সব রাস্তা সেদিন পরিণত হয়েছিল জনসমুদ্রে। আর দেশের মাটিতে পা দিয়েই শেখ হাসিনা বলেছিলেন, “সব হারিয়ে আমি আপনাদের মাঝে এসেছি; বঙ্গবন্ধু নির্দেশিত পথে তার আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জাতির জনকের হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে আমি জীবন উৎসর্গ করতে চাই।” তাঁর আগমন উপলক্ষে স্বাধীনতার অজেয় ধ্বনী ‘জয় বাংলা’ আবারও লাখো কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল সেদিন। সেদিন সবার কন্ঠে স্লোগান ছিলো- ‘হাসিনা তোমায় কথা দিলাম- পিতৃ হত্যার বদলা নেব’। ১৯৭৫ এর ১৫ অগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর প্রতিকূল পরিবেশে নির্বাসিত প্রবাস জীবন কাটাতে হয় আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। সেই অবস্থাতেই ১৯৮১ সালে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লিগের কাউন্সিলে সর্বসম্মতিক্রমে দলের নেতারা শেখ হাসিনাকে সভাপতি নির্বাচিত করেন। দেশে ফেরার পর তিনি দায়িত্ব নেন মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লিগের। দেশে ফেরার প্রথম দিনেই শেখ হাসিনা ছুটে গিয়েছিলেন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে, যেখানে ঘাতকরা হত্যা করেছিল তাঁর বাবা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, ভাই শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল আর দুই ভাইয়ের স্ত্রীকে। তবে, তৎকালীন জিয়াউর রহমানের সরকার তাঁকে সেদিন ঢুকতে দেয়নি স্বজনের রক্তে ভেজা সেই বাড়ীতে। বাড়ীর সামনে দাড়িয়ে দোয়া পড়ে ফিরে যেতে হয়েছিল তাঁকে। সেদিন শেখ হাসিনার চোখের জল আর বৃষ্টির পানি একাকার হয়ে ভিজেছিলো বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার মাটি।
বঙ্গবন্ধু খুনীদের রক্ষায় বাংলাদেশের সংবিধানে যুক্ত করা হয়েছিল ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ। ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর এই কালো অধ্যাদেশটি জারি করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতার নিয়ন্ত্রন নেন। সে সময় বিচারপতি সায়েম রাষ্ট্রপতি ছিলেন। ১৯৭৬ সালের ২৯ এপ্রিল সায়েম জেনারেল জিয়াউর রহমানের কাছে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব হস্তান্তর করেন। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল সায়েমকে পদত্যাগ করিয়ে রাষ্ট্রপতি হন জিয়াউর রহমান। ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সামরিক আইনের অধীনে দেশে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিতরকিত ওই নির্বাচনে জিয়াউর রহমানের দল বিএনপি দুই-তৃতীয়াংশ আসনে বিজয়ী হয়। সেই সংসদেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ-সহ চার বছরে সামরিক আইনের আওতায় সব অধ্যাদেশ, ঘোষণাকে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে আইনি বৈধতা দেওয়া হয়। এক ধরনের আইনী সুরক্ষা দিয়েই বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচারের পথ যেমন বন্ধ করা হয়েছিল- একই সঙ্গে তাদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরী দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়। পরবর্তী কালে ১৯৯৬ সালে সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লিগ বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচারের হাতে ন্যস্ত করতে ১৯৯৬ সালের ১৪ নভেম্বর পার্লামেন্টে ইনডেমিনিটি আইন বাতিল করা হয়৷ সুগম হয় জাতির জনকের ঘাতকদের বিচারের পথ, নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে বাঙালি। ১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর আবাসিক একান্ত সহকারি (পিএ) এএফএম মোহিতুল ইসলাম ১৯৭৫ সালের ১৫ অগস্ট সংঘটিত নারকীয় হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় থানায় একটি এফআইআর দায়ের করেন৷ ৩ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা সিআইডির কাছে হস্তান্তর করা হয় এবং তারা এ মামলার তদন্ত শুরু করে। ১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারী সিআইডি এই মামলায় ২০ জনকে অভিযুক্ত করে মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে চার্জশিট দাখিল করে৷ ১৯৯৭ সালের ১ মার্চ ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আইনগত আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার পর বিচার কার্যের জন্য মামলাটি ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতে পাঠান। ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর মামলার রায়ে বিচারক কাজি গোলাম রসুল ১৫ জন সাবেক সেনা কর্মকর্তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন৷ তবে, ২০০১ সালে বিএনপি- জামায়াত জোট সরকার গঠন করলে আবারও থমকে দাঁড়ায় বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচার।
২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গঠন করলে, গতি ফেরে মামলার। ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি মামলার রায়ে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা মামলায় ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন উচ্চ আদালত। বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের মধ্যে সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, আর্টিলারি মুহিউদ্দিন আহমদ, বজলুল হুদা এবং ল্যান্সার এ কে এম মহিউদ্দিনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। অন্য দিকে দীর্ঘ দিনেও দেশে আনা সম্ভব হয়নি বঙ্গবন্ধুর পলাতক ৬ খুনিকে। বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের ৬ জন এখনও বিদেশে পলাতক। বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনিদের দেশে ফিরিয়ে আনতে সরকারের টাস্ক ফোর্স-এর উদ্যোগের কথা কিছুদিন আগে জানিয়েছিলেন বাংলাদেশের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন জানিয়েছিলেন, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের গ্রেফতারে রেড অ্যালার্ট এখনো বহাল। খুনীদের অবস্থান নিশ্চিত করে দ্রুত তাদের দেশে আনা সম্ভব হবে। এই ফিরিয়ে আনার জোরদার চেষ্টা এখনো চলছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা দু’বার পূর্ণ মেয়াদে দায়িত্ব পালন শেষে এবার তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি আইনের নিয়মিত প্রক্রিয়ায় বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারও চালিয়ে যাচ্ছেন। মুক্তিযুদ্ধের যে শপথ ছিলো, সেই শপথের পথ থেকে মাঝে অনেকটাই পথহারা হয়েছিলো বাংলাদেশ। শেখ হাসিনার লড়াই সেই পথভোলা বাংলাদেশকে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অসাম্প্রদায়িক মহাসড়কে তুলে দেওয়ার। তবে, সেই পথ যে মসৃন নয়, সেটা বঙ্গবন্ধু তনয়া আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ভালো করেই জানেন । ২০০৪ এর ২১ আগস্ট সহ ২১ বারের বেশি তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। তার পরেও শেখ হাসিনা আছেন, চলছে তার দেশ গড়ার লড়াই। সেই লড়াইয়ের ফলাফলে বাংলাদেশ পথ হারায়নি। পথ হারায়নি মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা। সঙ্কা কাটেনি আজো। এতকিছুর পরেও আগস্ট এলেই শোকাতুর হয় বাঙ্গালী। রক্তক্ষরণ হয় প্রতিটি হৃদয়ে। সেই রক্ত অশ্রুজল হয়ে ঝরে পরে অার সংশয়ে কাটে আগষ্ট মাস। তাই ইতিহাসের পাতায় চির অক্ষয় হয়ে অাছে ” বিশ্বের আরেক বিষ্ময়ের নাম কিংবদন্তি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান !! “
কাঁদো বাঙালি কাঁদো, কাঁদো তোমরা চিরদিন,
যে অপরাধ করেছি চোখের জলে শুধিতে হইবে ঋণ !!