ব্রেকিং নিউজ
Home | শীর্ষ সংবাদ | পোস্টমর্টেম

পোস্টমর্টেম

134

তারিকুল ইসলাম তারিক : তড়িঘড়ি করে হসপিটালে চলে এলাম। একটা লাশের পোস্টমর্টেম করতে হবে। লাশটি এক মধ্যবয়সী নারীর। বয়স নাকি ৩৫/৩৬ এর কাছাকাছি। যদিও আমি নিজে লাশটি দেখিনি। প্রতিটি পোস্টমর্টেমের আগে আমি বেশ টেনশনে ভুগি। কেন জানি মানুষের শরীরে কাটাছেঁড়া করতে আমার ভীষণ কান্না পায়। একজন ডাক্তার হিসেবে অবশ্য এসব কথা কারো সাথে শেয়ার করা যায়না। তবে এর একটা সমাধান আমি খুঁজে বের করেছি। প্রতিবার ময়নাতদন্তের আগে আমি একটানা তিনটা সিগারেট শেষ করি। নিকোটিনে আমি এক অদ্ভুত সাহস খুঁজে পাই। আজও সেটাই করলাম।

সিগারেট শেষ করে পোস্টমর্টেম রুমে ঢুকলাম। লাশের মুখের কাপড় সরিয়ে আমি যেটা দেখলাম, তার জন্য আমি একদমই প্রস্তুত ছিলাম না। লাশের চেহারা অবিকল নীলুর মত। নিজেকে সামলে নিয়ে রেজিস্টার ঘেটে দেখলাম লাশের নামের স্থানে নীল কালিতে লেখা,  “নিলুফার ইয়াসমিন”

এবার আমাকে বিশ্বাস করতেই হলো লাশটি নীলুর। আমি স্বীয় দায়িত্ব পালনে তৎপর হলাম। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করলাম, নীলুর শরীরে আমি ছুরি চালাতে পারছিনা। আমার হাত কাঁপছে আর শরীর ঘামছে। আমার এ অবস্থা দেখে সহকারী সজল আমাকে বললো, ” স্যার আপনি একটু বিশ্রাম নিন রুমে গিয়ে। পরে কাজ টা করি।” আমি ছুরিটা ছুঁড়ে ফেলে রুমে গিয়ে বসে পড়লাম। একটা সিগারেট ধরিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে রইলাম।

এই নীলুর সাথে আমার পরিচয় যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন থেকে। ক্লাসে সবাই কোনো এক অজানা কারণে আমাকে টিকটিকি বলে খেপাতো। একদিন সহপাঠী নীলুও আমাকে টিকটিকি বলে খেপাচ্ছিলো। আমি রেগে গিয়ে একটা কলম ওর কবজিতে ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম। প্রায় ইঞ্চিখানেক গর্ত হয়ে গিয়েছিলো। রক্তারক্তি হয়ে বিশ্রী অবস্থা হয়েছিল। তবে সেদিন নীলু আমার নামে স্যারের কাছে নালিশ করেনি।স্যার জিজ্ঞেস করায় ও উত্তর দিয়েছিলো,”একটু অসাবধানতায় হয়েছে।”

ঠিক সেদিন থেকে নীলুকে ভালবাসা শুরু করেছিলাম। আমাদের প্রেম চলছিলো প্রায় ৬ বছর। ও আমাকে ভীষণ ভালবাসতো। আমি বাসতাম কিনা জানিনা। কারণ কাউকে সত্যিকারের ভালবাসলে কেউ দ্বিতীয়বার প্রেমে পড়েনা। কিন্তু আমি পড়েছিলাম। আমাদের মেডিকেলের সব চেয়ে সুন্দরী ইরার প্রেম, আমাকে নীলুর ভালোবাসাগুলো ভুলিয়ে দিয়েছিলো। বর্ণবাদী এই আমি, শ্যামবর্ণের নীলুকে ছেড়ে ফর্সা, স্লিম, মেধাবী ইরার প্রেমে মজে গিয়ে সামান্য অজুহাত আঁকড়ে নীলুকে ছেড়েছিলাম। মেয়েটি ভীষণ ভেঙে পড়েছিলো। এর বছর খানেক পর শুনেছিলাম, এক ব্যবসায়ীর সাথে ওর বিয়ে হয়ে গেছে। পরে আমি লেখাপড়ার জন্য বিদেশ চলে গেলে আর খোঁজ রাখিনি নীলুর। প্রায় ১৭ বছর পর আবারো নীলু আমার সামনে চলে এলো লাশ হয়ে।

সিগারেট শেষ করে আবারো নীলুর কাছে চলে এলাম। নীলুর ডান হাতের কব্জিতে সেই কলমের ক্ষত আজও স্পষ্ট। আমার চোখ থেকে নিজের অজান্তেই পানি ঝরছে৷ ওর সারা শরীরে আঘাতের কালসিটে দাগ পরে গেছে। মাথায় গভীর ক্ষত। গলায়ও ক্ষতচিহ্ন স্পষ্ট। আমি নীলুর শরীরে নির্দয় ভাবে ছুরি আর হাতুড়ি চালাচ্ছি। আমার চোখের পানি আমাকে মাঝেমধ্যেই বিচলিত করে দিচ্ছে। তবে আমাকে যে কাজ টা শেষ করতেই হবে। নিজের সাথে অনেক লড়াই করে কাজটা শেষ করলাম। সবশেষে নিশ্চিত হলাম, কেউ গলাটিপে ওকে হত্যা করেছে।

কে করতে পারে?

হয়তো স্বামীই করেছে৷

হয়তো অন্য কেউ।

জানিনা।

তবে এটা জানি, পৃথিবীর সবচেয়ে ভাল মানুষগুলো সব সময় কোনো না কোনো প্রতারক কেই ভালোবাসে। যেমন নীলু আমাকে কিংবা তার স্বামীকে বেসেছিলো।

আর সব শেষে নিজের জীবন দিয়ে সেই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করে যায়। ওরা হয়তো হারিয়ে যায়। আর ভালো থাকে প্রতারক গুলো। যেমন আমি ভাল আছি। দিব্যি সুখেই আছি। হয়তো নীলুর স্বামীও ভাল থাকবে। ভাল থাকবে সব প্রতারকেরা। আর হারিয়ে যাবে নীলুরা আর ওদের ভালোবাসাগুলো।

নোট : অবিশ্বাসের এই পৃথিবীতে কিছু মানুষ জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত শুধু ঠকেই চলে। এই মানুষ গুলো যত সহজে এবং গভীরভাবে কাউকে বিশ্বাস করে আর ভালোবাসে, ঠিক তার চেয়েও সহজে কিছু মানুষ তাদের বিশ্বাস ভাঙে আর প্রতারণা করে। এভাবেই সব কিছু হারিয়ে ওই মানুষগুলো নিঃস হয়েই দুনিয়া ছাড়ে। তবুও কোনো এক অদ্ভুত কারণে ভালোবাসা আর বিশ্বাস নামের অদ্ভুত শব্দগুলো পৃথিবীতে ঠিকই টিকে থাকে। কারণ প্রতিটা মানুষই দিনের শেষে বিশ্বাস আর ভালোবাসা আঁকড়েই বেঁচে থাকার শেষ চেষ্টা টুকু করে চলে।

লেখক : সহকারী শিক্ষক, ঝালকাঠি এইচ.সি সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!