নিউজ ডেক্স : অবিরাম বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় দক্ষিণ চট্টগ্রামের পটিয়া, চন্দনাইশ ও সাতকানিয়া উপজেলার প্রায় চার লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে রয়েছে। এসব এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও দূর্ভোগ বেড়েছে বানভাসি মানুষের। এদিকে কর্ণফুলী, সাঙ্গু, ডলু নদী সহ বিভিন্ন খালের পানি বিপদসীমার নিচে প্রবাহিত হচ্ছে। গতকাল রোববার থেকে বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় বন্যা কবলিত এলাকার পানি কমতে শুরু করেছে।
সোমবার (১৫ জুলাই) পটিয়া, চন্দনাইশ এবং সাতকানিয়া উপজেলার বিভিন্ন বন্যা কবলিত গ্রাম ঘুরে এ চিত্র দেখা গেছে।
এদিকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের চন্দনাইশ বড়পাড়া (কসাইপাড়া) এলাকায় রাস্তার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হওয়ার কারণে যান চলাচলে বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে। রাস্তার একপাশ বন্ধ রেখে অন্যপাশ চালু রেখে যান চলাচলের উপযোগী করা হলেও সাময়িক ভোগান্তি পেতে হচ্ছে যাত্রীদের। স্থানীয়রা জানান, ১৯৯৭ সালের পর থেকে এভাবে আর কখনো পানি উঠেনি।
১০ দিনের অবিরাম বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে উপজেলার আমিলাইশ, বাজালিয়া, চরতী, ঢেমশা, পশ্চিম ঢেমশা, নলুয়া, ছদাহা, কালিয়াইশ, মাদার্শা, সাতকানিয়া সদর, খাগরিয়া, ধর্মপুর, এওচিয়া, কেঁওচিয়া, সোনাকানিয়া, কাঞ্চনা, পুরানগড় ইউনিয়ন ও সাতকানিয়া পৌরসভার পৌরসভার অধিকাংশ এলাকা প্লাবিত হয়। বর্ষণ অব্যাহত থাকায় পানিবন্দি হয়ে পড়ে প্রায় তিন লক্ষাধিক মানুষ। ভেসে গেছে মৎস্য খামার ও পুকুর। তলিয়ে গেছে আউশ, আমন ক্ষেতের বীজতলা ও বিভিন্ন সবজি খেত।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, সাতকানিয়া উপজেলার কেওচিয়া ইউনিয়নের ১০ হাজার পরিবার পানির নিচে। তারই সাথে মারা পড়েছে প্রায় লক্ষাধিক হাঁস মুরগি। দ্বিতল বিশিষ্ট ঘরের মালিকরা পার্শ্ববর্তী ঘরে আশ্রয় দিয়েছেন। আবার কয়েকটি বাড়িও শূণ্য অবস্থায় দেখা গেছে। জানতে চাইলে, পাশের বাড়ি থেকে জানানো হয়, বন্যার পানি উঠার পর তারা আত্মীয়ের বাড়িতে চলে গেছে।
প্রবল স্রোতের নীচে পড়েছে মহাসড়ক ও গ্রামীণ সড়কগুলো। খানাখন্দে ভরে গেছে সড়ক ও মহাসড়ক। উপজেলার কালিয়াইশ, ধর্মপুর, বাজালিয়া পুরানগড়, নলুয়া, ঢেমশা, পশ্চিম ঢেমশা, কেওচিয়া, ছদাহা, এওচিয়া, সোনাকানিয়া ও সাতকানিয়া সদর ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকা ঢলের পানি নেমে গেলেও এসব জনপদের সাথে উপজেলা সদরসহ অন্যান্য স্থানের সাথে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। উপজেলার প্রায় অধিকাংশ এলাকার অভ্যন্তরীণ সড়কগুলোর অবস্থা বেহাল দশায় পরিনত হয়েছে। বন্যার পানির তীব্র স্রোতে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের এলজিইডি সড়কগুলোর বিভিন্ন স্থানে বিশালাকৃতির গর্তের সৃষ্টি হয়েছে।
জানা যায়, পুরো ইউনিয়নের মধ্যে আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে মাত্র একটি। যার কারণে ১০ হাজার পরিবারকেও আশ্রয় দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। পরে নৌকা ধরে আশ্রয়কেন্দ্রে গেলে আশ্রিতগণ বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরেন।
কান্না জড়িত অবস্থায় ছকিনা খাতুন (৬০) বলেন, ‘ভোটের সময় আসলে নেতা এমপিরা আমাদের দুয়ারে দুয়ারে আসে ভোট চাইতে, কিন্তু আজকে আমরা সাতদিন ধরে পানিবন্দী। আমাদের খোঁজ নিতে কেউ আসছে না। গতকালকে আমাদের চেয়ারম্যান এসে দুপুরে একটি খাবারের প্যাকেট দিয়ে গেলো কিন্তু তার পর থেকে এখন পর্যন্ত কি অবস্থায় আছি কেউ খবর নেয়নি। অন্তত খাবার পানি দিয়ে গেলে মনটাকে সান্তনা দিতে পারতাম।
ছকিনা সাতকানিয়া উপজেলার বন্যাকবলিত কেওচিয়া ইউনিয়নের তেমুহানি গ্রামের বাসিন্দা। বন্যায় বাড়ি-ঘর পানির নিচে থাকার কারণে তেমুহানি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় গ্রহণ করেন তিনি।
শুধু ছকিনা খাতুন নয়, প্রায় ৫০টি পরিবার এ আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেন। সবার মনে ক্ষোভ একটাই সুপেয় পানি ও পর্যাপ্ত খাবার না পাওয়া। শফিয়া খাতুন (৬১) সিভয়েসকে জানান, প্রথমদিন পানি বাড়িতে ঢুকেনি, পানি ছিলো ঘর ছুঁই ছুঁই। তাই আমরা ইচ্ছে করে আশ্রয়কেন্দ্রে আসিনি। পরদিন যখন পানি ঘরে ঢুকে গেলো তখন থেকে আর রান্না করা সম্ভব হচ্ছে না। ঘরের চুলা এবং লাকড়ি পানিতে তলিয়ে যায়। যার ফলে চলে আসি আশ্রয়কেন্দ্রে। তারপর থেকে ছেলে খাবার নিয়ে আসে বিভিন্ন জায়গা থেকে তা নিয়ে কোনভাবে রাতযাপন করছি।
তেমুহানির আব্দুল গফুর (৩৭) বলেন, সরকার বলছে আমাদের জন্য ত্রাণ দেয়া হচ্ছে কিন্তু আমরা সে ত্রাণ পাচ্ছি না কেন? এসব ত্রাণ যাচ্ছে কোথায়? নাকি আমাদের জন্য ত্রাণ এনে সেটি অন্যান্য জায়গায় বিলি করছে নেতারা, সেটি খোঁজ নেয়া জরুরি।
মো. মামুন (২৮) জানান, আমরা খবর পেয়েছি এমপি আমাদের এলাকায় এসেছিলো কিন্তু রাস্তার পাশে কয়েকটি পরিবারের মাঝে ত্রাণ দিয়ে চলে গেছে। আমাদের এদিকে আসেনি। আমরা ভেবেছিলাম অন্তত তারা এদিকে এসে আমাদের সমস্যার কথা শুনবে। কিন্তু আমাদের দুঃখ দেখবে কে? এখন আল্লাহর উপর ভরসা করেই আছি।
ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী নাহিদা সোলতানা বলেন, বন্যায় পানি উঠার কারণে আমার বই খাতা সব পানিতে ডুবে গেছে। হঠাৎ করে পানি উঠার কারণে কি করবো বুঝে উঠতে পারিনি। আর পানি উঠার পর থেকে স্কুলও বন্ধ অবস্থায় রয়েছে। অনেকে স্কুলে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। এখন আমার বই খাতা কোথায় পাবো তা নিয়ে চিন্তিত আছি।
কেওচিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনির আহমদ জানান, প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাঁচ টন ত্রাণ সরবরাহ পেয়েছি। কিন্তু সেগুলো নিমিষেই শেষ হয়ে গেছে। পরিবারের চেয়ে ত্রাণের সংখ্যা নিতান্তই কম। আমি গত দুই দিন ধরে ব্যক্তিগত ভাবে বিভিন্ন ওয়ার্ডে ভাত রান্না করে মেম্বারদের কাছে পাঠিয়েছি। তারা ঘরে ঘরে বিলি করেছেন। আজকেও রান্না করে সব জায়গায় পাঠিয়ে দিয়েছি। এ পর্যন্ত আমি এলাকাবাসীর জন্য ৭ লক্ষ টাকার খাবার বিতরণ করেছি। কথা দিচ্ছি যতটুকু সাধ্য আছে সাধারণ মানুষের পাশে থাকবো।
সুপেয় পানির ব্যাপারে তিনি বলেন, আমি উপজেলা থেকে হ্যালোজেন ট্যাবলেট এবং খাবার স্যালাইন নিয়ে এসেছি। এগুলো খাবারের সাথে বিতরণ করবো।
বাজালিয়া ইউনিয়নের সচিব মো. খসরু শিকদার বলেন, বাজালিয়া ইউনিয়নের ছয়টি গ্রামের প্রায় সাত হাজার মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। তবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মাহালিয়া এলাকা। ওখানে প্রায় দুই হাজার ঘর পানিবন্দি। আর আসা যাওয়ার একমাত্র বাহন নৌকা।
রাস্তায় গাড়ি চলাচলের বিষয়ে তিনি বলেন, গত মঙ্গলবার সড়কে হাঁটু সমান পানি হলে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। তারপরেও ওইদিন কিছু বড় গাড়ি চলাচল করেছে। কিন্তু এরপর গত কয়েকদিন সড়কে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ার পর যান চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।
উপজেলা প্রশাসনের সাথে কথা বলে জানা যায়, বাজালিয়া ইউনিয়নের মীরের পাড়ায় সাঙ্গু নদীর বাঁধ ভেঙে অতিরিক্ত পানি ঢুকার কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। পাহাড়ি ঢলের পানি লোকালয়ে প্রবেশের ফলে হুমকির মুখে পড়েছে জনজীবন। তলিয়ে গেছে সাতকানিয়া উপজেলার কেওচিয়া, ছদাহা, ঢেমশা, বাজালিয়া, ধর্মপুর, আমিলাইশ, কালিয়াইশ, পুরানগড় ও সাতকানিয়া পৌর এলাকার প্রায় চার লক্ষাধিক পরিবার পানির নিচে প্লাবিত হয়েছে। বিভিন্ন সড়কের উপর দিয়ে হাঁটু থেকে কোমড় সমান পানি চলাচল করতে দেখা যায়। প্রবল বর্ষণ ও বন্যাকবলিত এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। বান্দরবান সড়কের উপর দিয়ে চার ফুট পানি চলাচল করায় বান্দরবানের সাথে সারাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মোবারক হোসেন জানান, পুরো সাতকানিয়া ২ লক্ষ মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছে। সাঙ্গু নদীতে পানি চলাচল করছে বিপদ সীমার শূণ্য দশমিক ৮০ মিটার উপরে। তাই এখনো আশঙ্কামুক্ত বলা যাচ্ছে না। বৃষ্টি পড়লে আবারও পানি বাড়তে পারে। এ পর্যন্ত ৯৫ মেট্রিক টন চাল এবং চার হাজার শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। একই সাথে বিভিন্ন ইউপি চেয়ারম্যানদের ব্যক্তিগত পক্ষ থেকে খাবার রান্না করে বিতরণ করা হচ্ছে।
চন্দনাইশ উপজেলার চগাচর, জোয়ারা, দিয়াকুল, ধোপাছড়ি, হাশিমপুর ইউনিয়ন মিলিয়ে প্রায় দুই লক্ষাধিক পরিবার পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। স্থানীয় সাংসদ নজরুল ইসলাম, পৌরসভার, মেয়র মাহবুবুল আলম খোকা এবং উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ হতে ত্রাণ সরবরাহ অব্যাহত রয়েছে।
চন্দনাইশ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আ.ন.ম বদরুদ্দোজা বলেন, পুরো চন্দনাইশ উপজেলায় প্রায় ৮০ ভাগ অঞ্চল পানির নিচে রয়েছে। যদিও আগের তুলনায় একটু পানি কমেছে কিন্তু শঙ্কা কাটেনি। কারণ দুই লক্ষাধিক পরিবার এখনো পানিবন্দি রয়েছে। আমরা ইতোমধ্যে ৯০ মেট্রিক টন চাল বন্যা কবলিত এলাকায় বিতরণ করেছি। এক হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার দেয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসন থেকে এ পর্যন্ত দুই লক্ষ টাকা পেয়েছি তা দিয়ে আমরা খিচুড়ি রান্না করে বিভিন্ন ইউনিয়নে পাঠিয়ে দিচ্ছি। তবে উপজেলা প্রশাসনের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনও ত্রাণ বিতরণ করছেন।
এদিকে পটিয়া উপজেলার দুইটি ইউনিয়নের প্রায় ৩ হাজার পরিবার পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে বলে জানিয়েছে উপজেলা প্রশাসন। ইতোমধ্যে দুই হাজার পরিবারের মাঝে ২০ মেট্রিক টন ত্রাণ বিতরণ উদ্বোধন করেছেন হুইপ সামশুল হক চৌধুরী। ত্রাণের মধ্যে ছিলো- চাল, ডাল আর আলু।
পটিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হাবিবুল হাসান জানান, পটিয়া উপজেলায় মাত্র দুইটি ইউনিয়ন বন্যায় কবলিত হয়েছে। আমরা আজকে ২০ মেট্রিক টন ত্রাণ বিতরণ করেছি। আরও ১০ মেট্রিক টন ত্রাণ আজকে এসেছে। পর্যায়ক্রমে সেগুলোও বিতরণ করা হবে।
চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, দক্ষিণ চট্টগ্রামের বন্যা কবলিত এলাকায় আমাদের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত খাবার স্যালাইন, পানি বিশুদ্ধিকরণ ট্যাবলেট প্রদান করা হয়েছে। আবার প্রত্যেক উপজেলায় আমরা সেখানে মেডিকেল টিমও প্রস্তুত রেখেছি।
তিনি বলেন, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত ৫০০ মেট্রিক টন ত্রাণ এবং সাড়ে ছয় হাজার শুকনো খাবারের প্যাকেট প্রদান করা হয়েছে। যার প্রত্যেকটি প্যাকেটের ওজন ১০ কেজি। তাছাড়া স্ব-স্ব উপজেলার নিজস্ব তহবিল থেকেও ত্রাণ সরবরাহ করা হচ্ছে। -সিভয়েস