নিউজ ডেক্স : রাজধানীতে তালাক বা বিবাহবিচ্ছেদ আবেদনের পরিমাণ বাড়ছে। বর্তমানে দিনে গড়ে ৩৭টি তালাকের আবেদন করা হচ্ছে। এর মধ্যে গড়ে ৭০ শতাংশ আবেদন করছেন নারীরা। এই নারীদের অধিকাংশই চাকরিজীবী এবং স্বাবলম্বী। ফলে তালাকের আবেদনে সমঝোতা হচ্ছে গড়ে ৫ শতাংশেরও কম।
স্ত্রীদের করা আবেদনে কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে স্বামীর সন্দেহবাতিক মনোভাব, পরনারীর সঙ্গে সম্পর্ক, যৌতুকের জন্য নির্যাতন, মাদকাসক্তি, পুরুষত্বহীনতাসহ বিভিন্ন কারণ। অন্যদিকে স্বামীর অবাধ্য হওয়া, ইসলামি শরিয়ত অনুযায়ী না চলা, বদমেজাজ, সংসারের প্রতি উদাসীনতা, সন্তান না হওয়ায় স্ত্রীকে তালাক দিচ্ছেন স্বামীরা।
২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর এবং ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) তালাকের তথ্য বিশ্লেষণ করে এমন চিত্র পাওয়া গেছে। এর আগের ৯ বছরের তালাকের তথ্য বিশ্লেষণ করেও একই চিত্র দেখা গেছে। কিন্তু তালাকের তেমন কোনো অভিন্ন কারণ দেখা যায়নি। প্রতিটি তালাকের ঘটনায়ই সুনির্দিষ্ট কিছু কারণ উল্লেখ রয়েছে।
ডিএনসিসি ও ডিএসসিসির জনসংযোগ বিভাগ সূত্র জানায়, ২০২০ সালে ডিএনসিসি ও ডিএসসিসিতে ১২ হাজার ৫১৩টি তালাকের আবেদন করা হয়েছে। অর্থাৎ মাসে গড়ে এক হাজার ৪২টির বেশি, যা দিনে গড়ে ৩৫টি, ঘণ্টায় একটিরও বেশি। এসব তালাকের কারণ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ‘বনিবনা না হওয়া’।
এর মধ্যে স্ত্রীদের করা আবেদনে কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে স্বামীর সন্দেহবাতিক মনোভাব, পরনারীর সঙ্গে সম্পর্ক, যৌতুকের জন্য নির্যাতন, মাদকাসক্তি, পুরুষত্বহীনতাসহ বিভিন্ন কারণ।
পারিবারিক বন্ধনের মূল বিষয় ধৈর্য। যেকোনো পরিস্থিতিতে স্বামী-স্ত্রী উভয়কেই সহনশীলতার পরিচয় দিতে হয়। পারস্পরিক সহযোগিতা ও যোগাযোগ বাড়িয়ে একসঙ্গে চললে সমাজে বিবাহবিচ্ছেদ কমবে।
অন্যদিকে স্বামীর অবাধ্য হওয়া, ইসলামি শরিয়ত অনুযায়ী না চলা, বদ মেজাজ, সংসারের প্রতি উদাসীনতা, সন্তান না হওয়ায় স্ত্রীকে তালাক দিচ্ছেন স্বামীরা।
২০১১ সালে ডিএনসিসিতে তালাকের আবেদন করা হয় দুই হাজার ৮৬৪টি, ডিএসসিসিতে দুই হাজার ৭৮৬টি। পরের বছর দুই সিটিতে গড়ে তিন শতাধিক বেশি আবেদন জমা পড়ে। ২০১৯ সালে ডিএনসিসিতে তালাকের আবেদন করা হয়েছে ছয় হাজার ১৬৮টি, ডিএসসিসিতে ছয় হাজার ১২৪টি। এভাবে বিবাহবিচ্ছেদ বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে মানসিক চাপসহ সামাজিক এবং পারিবারিক বন্ধন কমে যাওয়াকে অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন সমাজবিজ্ঞানীরা।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক রাশেদা ইরশাদ নাসির বলেন, ‘একটা পরিবার গড়ে ওঠে একজন পুরুষ এবং নারীর বিবাহবন্ধনের মাধ্যমে। এর মাধ্যমেই প্রজন্মের পর প্রজন্মের যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু এখন কর্মক্ষেত্রে দক্ষতার পার্থক্য, প্রতিযোগিতার সঙ্গে নিজেকে চালিয়ে যাওয়া এবং সেগুলোর সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পাড়ায় নারী-পুরুষের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব বাড়ছে। ফলে বাস্তবতা এবং প্রতিযোগিতার সঙ্গে টিকে থাকতে বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে।’
তিনি বলেন, ‘এখন প্রতিযোগিতামূলক সমাজ। মানুষের আকাঙ্ক্ষা অনেক বেশি। এই আকাঙ্ক্ষা আদি সমাজের সঙ্গে বর্তমান সমাজের পার্থক্য তৈরি করেছে। অথচ আগে যুগের পর যুগ সংসার টিকে থাকত।’
এখন প্রতিযোগিতামূলক সমাজ। মানুষের আকাঙ্ক্ষা অনেক বেশি। এই আকাঙ্ক্ষা আদি সমাজের সঙ্গে বর্তমান সমাজের পার্থক্য তৈরি করেছে। অথচ আগে যুগের পর যুগ সংসার টিকে থাকত।
১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী, তালাকের নোটিশ সিটি করপোরেশনের মেয়রের কার্যালয়ে পাঠানো হয়। প্রথমে সেখানে তালাকের আবেদন নথিভুক্ত হয়। তারপর সেখান থেকে তালাকের আবেদন স্বামী এবং স্ত্রী সিটি করপোরেশনের কোন অঞ্চলে বাস করেন, সেই অনুযায়ী ওই অঞ্চলে পাঠানো হয়।
পরে আবেদনকারী ও বিবাদী উভয়পক্ষকেই আপসের নোটিশ পাঠান সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তারা (নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট)। দুই পক্ষের মধ্যে আপস না হলে সিটি করপোরেশনের আর কোনো দায়িত্ব থাকে না। আইন অনুযায়ী, আবেদনের ৯০ দিনের মধ্যে কোনো পক্ষ আপস বা প্রত্যাহার আবেদন না করলেও তালাক কার্যকর হয়ে যায়।
ডিএনসিসি এবং ডিএসসিসির মেয়র দফতরের তথ্য মতে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে তালাকের আবেদন করেছেন পাঁচ হাজার ৪৮৭ জন। এর মধ্যে ডিএনসিসিতে আবেদন দুই হাজার ৮২৫টি, ডিএসসিসিতে দুই হাজার ৬৬২টি। এই হিসেবে ডিএসসিসি ও ডিএনসিসিতে দিনে ৩৭টি তালাকের আবেদন পড়ছে। যা ঘণ্টায় এক দশমিক পাঁচেরও বেশি।
এর আগে, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ডিএসসিসি এবং ডিএনসিসিতে তালাকের আবেদন করেন ১২ হাজার ৫১৩ জন। যা দিনে গড়ে ৩৪টি। এই হিসেবে চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে দিনে গড়ে তিনটি করে তালাক আবেদন বাড়ছে। বর্তমানে ডিএনসিসির পৃথক ১০টি অঞ্চল রয়েছে। কোনো অঞ্চলে দিনে বা মাসে কয়টি তালাক হয় তার হিসেব রাখে মেয়র দফতর।
এই দফতর সূত্র জানায়, ডিএনসিসি এলাকার মধ্যে অঞ্চল-৩ এর আওতাধীন এলাকা তথা গুলশান, বনানী, বারিধারা, মহাখালী, রামপুরা এলাকায় তালাকের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। সর্বশেষ গত ৬ জুন এই অঞ্চলে তালাকের আবেদন জমা পড়েছে ১২টি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএনসিসির অঞ্চল-৩ এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল বাকী বলেন, স্বামী বা স্ত্রী যে পক্ষই আবেদন করুক, আগে উভয়পক্ষকেই সমঝোতার নোটিশ দেয়া হয়। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা সমঝোতায় যান না। উভয়েই নিজ নিজ অবস্থানে অনড় থাকেন। দ্বিতীয়বার নোটিশ দিলেও তারা উপস্থিত হন না। আইন অনুযায়ী তালাক আবেদনের ৯০ দিনের মধ্যে সমঝোতা না হলে তা কার্যকর হয়ে যায়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েক বছর ধরে ঢাকায় তালাকের প্রবণতা বাড়ছে। এর মধ্যে শিক্ষিত স্বামী-স্ত্রীদের মধ্যে তালাক বেশি হচ্ছে। ২০১৯ সালের জুন মাসে প্রকাশিত বিবিএসের ‘দ্য সিচুয়েশন অব ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে তালাকের ঘটনা ১৭ শতাংশ বেড়েছে।
স্ত্রীর পক্ষ থেকে তালাক আবেদন বেশি : ডিএসসিসির জনসংযোগ বিভাগ জানায়, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ডিএসসিসিতে তালাকের আবেদন করেছেন ছয় হাজার ৩৪৫ জন। এর মধ্যে চার হাজার ৪২৮টি আবেদন করেছেন নারী বা স্ত্রীরা। এক হাজার ৯১৭টি আবেদন স্বামীর। চলতি বছরের বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত এক হাজার ৯৫৩টি তালাকের আবেদন করেছেন স্ত্রী, স্বামী ৭০৯টি। এর মধ্যে গত মার্চে ৬০২টি তালাক আবেদনের ৪৮৬টিই স্ত্রীদের।
অন্যদিকে, ডিএনসিসিতে ২০২০ সালে তালাকের আবেদন করেছেন ছয় হাজার ১৬৮ জন। এর মধ্যে চার হাজার ৫৩টি আবেদনই স্ত্রীর পক্ষ থেকে। এছাড়া চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে আবেদন পড়েছে দুই হাজার ৮২৫টি। এর অধিকাংশ আবেদনই নারীদের বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
ডিএসসিসিতে মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের পক্ষে তালাকের আবেদনগুলো তদারকি করেন সংস্থাটির জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাছের। তিনি বলেন, বছরে যে পরিমাণ তালাকের আবেদন করা হয়, তার গড়ে ৭০ শতাংশই স্ত্রীদের। স্বামীদের আবেদন কম।
ঘুরেফিরে তালাকের একই কারণ : ডিএসসিসি ও ডিএনসিসিতে আসা তালাকের আবেদনগুলো ঘেটে তালাকের অভিন্ন কারণ দেখা যায়নি। সবগুলো আবেদনেই গৎবাঁধা কারণ। এসব আবেদনের একটি ছক বা ফরম আইনজীবীদের কাছে তৈরি থাকে। শুধু সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর নাম, পরিচয় বদলে একই ধাঁচের আবেদন করা হয়। মাঝেমধ্যে দুই-একটি কারণ ভিন্ন হয়ে থাকে।
গত মে মাসে ডিএসসিসি মেয়র বরাবর আবেদন আসে ৩৬২টি। এর মধ্যে ২৫৩টি আবেদন ছিল স্ত্রীদের পক্ষ থেকে। আবেদনগুলোতে তালাকের কারণ হিসেবে স্ত্রীরা উল্লেখ করেছেন, স্বামীর সঙ্গে বনিবনা না হওয়া, ভরণ-পোষণ না দেওয়া, যৌতুকের দাবিতে নির্যাতন, অন্য নারীর সঙ্গে স্বামীর সম্পর্ক, মাদকাসক্তি। আর স্বামীদের আবেদনে স্ত্রীর বদমেজাজ, সংসারে উদাসীনতা, অবাধ্য হওয়া, ইসলামি শরিয়ত অনুযায়ী না চলাসহ বিভিন্ন কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। ডিএনসিসির তালাকের আবেদনগুলো পর্যালোচনা করে তালাকের প্রায় একই কারণ পাওয়া গেছে।
১৬ মে তালাক চেয়ে ডিএসসিসি মেয়র বরাবর আবেদন করেন কলাবাগানের এক নারী। কারণ হিসেবে তিনি আবেদনে স্বামীর সঙ্গে বনিবনা হচ্ছে না বলে উল্লেখ করেন। যাত্রাবাড়ীর শহীদ ফারুক রোডের আরেক নারী তালাকের কারণ হিসেবে তার স্বামী অন্য নারীর সঙ্গে সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেছেন। এছাড়া পরপুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক থাকায় স্ত্রীকে তালাক দিয়েছেন বনানী এলাকার এক ব্যক্তি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছু বনানীর ওই ব্যক্তি জানান, তাদের সাত বছরের সংসারে দুই ছেলে মেয়ে রয়েছে। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে স্ত্রী তার এক ছেলে বন্ধুর সঙ্গে গোপন সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছেন। বিষয়টি আগ থেকে সন্দেহ হলেও গত এপ্রিলে ধরা পড়ে। তাই স্ত্রীকে তালাক দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
যৌতুকের দাবিতে এক বছরের বেশি সময় ধরে নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছিলেন রামপুরার এক নারী। তিনি জানান, রামপুরা এলাকায় তার স্বামীর ছোট একটি মুদি দোকান রয়েছে। ব্যবসা বড় করার জন্য বাবার বাড়ি থেকে ৪ লাখ টাকা আনতে এক বছর ধরে স্বামী চাপ দিচ্ছিলেন।
কিন্তু দুই বছরের সংসারে বাবা বাড়ি থেকে ঘরের ফার্নিচার, স্বর্ণালঙ্কারসহ বিভিন্ন উপহার দিয়েছেন। এখন বাবার কাছে টাকা নেই। টাকা দিতে না পারায় নিয়মিত তাকে নির্যাতন করতেন স্বামী। তাই বাধ্য হয়ে তালাকের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি।
গত জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত দেশে গৃহে নারী নির্যাতনের চিত্র নিজেদের ওয়েবসাইটে তুলে ধরেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। তাদের হিসাব অনুযায়ী, ওই পাঁচ মাসে ২৬৯ জন নারী বা স্ত্রী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে স্বামীর দ্বারা ২৩ জন স্ত্রী নির্যাতন এবং ৯৫ জন হত্যার শিকার হয়েছেন। স্বামীর পরিবারের সদস্যরা হত্যা করেছেন ২৯ জন। এ ছাড়া পারিবারিক কলহে আত্মহত্যা করেছেন ৫৬ জন।
আসকের পরিচালক মিনা গোস্বামী বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে দেশে স্ত্রীদের ওপর পারিবারিক নির্যাতন বাড়ছে। এই ধরনের অভিযোগই এখন আমাদের কাছে বেশি আসছে। এখন ঢাকায় বা দেশে যদি বিবাহবিচ্ছেদ বাড়তে থাকে তা হলে এই নির্যাতন অন্যতম কারণ। নারীর প্রতি সম্মানবোধ ও সহনশীলতাই পারে এই বিচ্ছেদ কমাতে।’ জাগো নিউজ