ব্রেকিং নিউজ
Home | উন্মুক্ত পাতা | চিত্রনায়িকা পরীমনিসহ পিছনে ফেলে আসা কিছু কথা ও আমাদের সংবিধান

চিত্রনায়িকা পরীমনিসহ পিছনে ফেলে আসা কিছু কথা ও আমাদের সংবিধান

ফিরোজা সামাদ : প্রথমেই আমি বলতে চাই, আমার লেখায় অনেক ভুল থাকতে পারে। আমি এই লেখাটিতে ইন্টারনেট, গণমাধ্যম ও দেশের চলমান খবর, টিভি, মিডিয়ার সহায়তা নিয়ে আমার মতো করে লিখেছি ||

(১)
দেখা যায়, বিনা আইনে, বিনা বিচারে গ্রেপ্তারকৃক ব্যক্তি সম্পর্কে সম্মানহানিকর সংবাদ পরিবেশন ও প্রচার করতে শুরু করে মিডিয়া জগত। বিনা আইনে গুম বা ক্রসফায়ার করা হয়, লুকিয়ে বা মিথ্যা কোনো কাহিনি বলে। কিন্তু ; বিনা আইনে সম্মানহানি করা হয় সদর্পে, টিভি,পত্র পত্রিকা,আর বিভিন্ন আনলাইন মিডিয়ার সামনে। মুখরোচক ইউটিউবাররা যেনো বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে। আর এটা সবচেয়ে বেশি ঘটে থাকে যখন কোনো নারী জড়িত থাকে বা গ্রেপ্তার হয়। এটা যেনো আমাদের সমাজে সুরসুরীর মতো||

(২)
একটু পেছনে তাকালে দেখতে পাই, শামীমা নূর, পাপিয়া ও ডা. সাবরিনা আরিফের গ্রেপ্তারের পর মূল অভিযোগের পাশাপাশি তাঁদের চরিত্র নিয়ে নানান নোংরা কাহিনি ছাপা হয়েছে বেশকিছু গণমাধ্যমে । মাত্র কয়েকদিন আগে প্রচার হয়েছে গ্রেপ্তারকৃত হেলেনা জাহাঙ্গীর, ফারিয়া মাহাবুব পিয়াসা ও মরিয়ম আক্তার মৌ সম্পর্কে। তাতেও তাদের গায়ে অশ্লীল বাক্য সেঁটে দেয়া হয়েছে। তারপর গত বুধবারে গ্রেপ্তার হয়েছে চিত্রনায়িকা পরীমনি। পরী মনি সম্পর্কেও একতরফা মুখরোচক সংবাদ পরিবেশনের হিড়িক শুরু করেছে মিডিয়ায়। তাকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। তাকে টর্চার করে মুখ থেকে কার কার সাথে সম্পর্ক তা বের করছে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। অথচ, এই পরীমনি কাউকে খুন করেনি, সরকারের কোনো অর্থ আত্মসাৎ করেনি। বড়োলোকের কোন্ কোন্ সন্তানদের ব্ল্যাক মেলিং করেছে? তাদের নাম বা ছবি মিডিয়ায় প্রকাশ হয়নি, আর হবে বলেও মনে হয় না, এ জন্য কাউকে কোনো জবাবদিহির মধ্যে পড়তে হবে না আমাদের দেশে। আজ এই পুরুষশাসিত সমাজের শার্দূলরা অপরিপক্ক বয়সের পরীমনির গায়েই শুধু কলঙ্কের সীল মোহর মেরে দিয়েছে অনায়াসে, এই হলো আমাদের সমাজ ব্যবস্থা। অথচ এসব কর্মকাণ্ড সংবিধান বহির্ভূত!

(৩)
উল্লেখ্য, পিয়াসা ও মৌ গ্রেপ্তার হওয়ার পর পুলিশের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা তাঁদের আখ্যায়িত করেছেন ‘রাতের রানি’ হিসেবে। তাঁর বক্তব্য অনুসারে, এরা রাতে বিভিন্ন পার্টির আয়োজন করে ধনাঢ্য ব্যক্তি ও তাঁদের সন্তানদের আমন্ত্রণ জানায় এবং পার্টি চলাকালে কৌশলে আপত্তিকর ছবি তুলে ব্ল্যাকমেল করে। যতোদূর মনে পরে , এমন বা এর চেয়ে মানহানিকর অভিযোগে আগেও গ্রেপ্তার হওয়া কোনো কোনো নারী সম্পর্কে করা হয়েছে||

(৪)
যেমনঃ উত্তরা বোট ক্লাবের ঘটনায় অভিনেত্রী পরীমনির করা মামলায় অভিযুক্ত হিসেবে নাসিরউদ্দীন নামে এক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাকে গ্রেপ্তারের সময় একই সঙ্গে তিন নারীকে গ্রেপ্তার করে তাঁদের ” রক্ষিতা ” হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয় পুলিশ। কিন্তু ; এদের লালনকারী ” ভক্ষক ” দের নাম বা চেহারা জনতা দেখেনি শুধু পুরুষ বলে ||

(৫)
তথ্যপ্রমাণ ছাড়া এসব মানহানিকর বক্তব্য শুধু সংবিধান বা আইনবিরোধী নয়, বরং নৈতিকতা বিরোধীও। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এই সামান্য বোধ হারিয়ে গেছে আমাদের সমাজের অনেক স্তরে। যেমন, পিয়াসা ও মৌকে পুলিশের কর্তা কর্তৃক ‘‘রাতের রাণী ’’ আখ্যায়িত করা বিভিন্ন কলামিস্ট, অনেক সিনিয়র সাংবাদিকরা তাদের কলামে, ” এরা বা পরীমনি চরিত্রহীনা, উঁচু দরের পতিতা এবং নারী ও মাদক ব্যবসায়ী ” উল্লেখ করে তাদের জ্ঞানের পরিধি প্রকাশ করে বাহবা কুরিয়েছেন! কিন্তু ; ” রাতের রাজা “, ” উচু দরের পতিত পুরুষ “, ” পুরুষ মাদক ব্যবসায়ী “, বা ” চরিত্রহীন “দের কথা কোথাও বলার প্রয়োজন মনে করেন নি। করবেন কী করে? তাদের নেশাধরা চোখে তখন রূপসী সুন্দরী পরীমনির চেহারাই ভাসছিলো যে||

(৬)
আমি কারোর সাফাই গাইছি না। তবে বিভিন্ন তথ্য থেকে মূল বস্তুটি নিয়ে বলতে চাই বাংলাদেশের সংবিধানে এই সকল অপরাধের জন্য কী ধরণের ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে? পাঠক আপনারা ইন্টারনেট বা বিভিন্ন গণমাধ্যম দেখুন! দেশের সংবিধান সম্পর্কে কিছু অন্তত জানুন! দেখুন সংবিধানের ৩১ নং অনুচ্ছেদে কী বলা হয়েছে?

(৭)
আমাদের সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদে আছে, আইন মোতাবেক ছাড়া কারও জীবন, ব্যক্তিস্বাধীনতা, সম্পদ, সুনাম এসবের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। এটা যে কিছুতেই করা যাবে না, তা বোঝাতে সংবিধানের এই একটিমাত্র অনুচ্ছেদে কথাটা পুনরাবৃত্তি করে বলা হয়েছে। কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করার পর কখনো কখনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাঁর বুকে ” ধর্ষক “/ “মাদক ব্যবসায়ী “/ ” রাকের রাণী “/ ” পতিতা ” লেখা কাগজ এঁটে দিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে তার সুনামহানি করাকেও অনুমোদন দেয় নি। তাই এটিও সংবিধানের ৩১ নং অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। অথচ আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও মিডিয়া হরহামেশা সংবিধান বিরোধী এই কাজহগুলো করতে অভ্যস্ত। এখন প্রশ্ন হলো তাহলে এসব হয় কীভাবে?

(৮)
ছোট্ট একটি উদাহরণ : এর আগে কোটি টাকা খরচ করে ওয়েস্টিনের পুরো স্যুট ভাড়া করে এমন কর্মকাণ্ড করার অভিযোগ উঠেছিল শামীমা আকতার পাপিয়া নামে এক নারীর বিরুদ্ধে। কারা এই কর্মকাণ্ডের পুরুষ পার্টনার ছিলো? তা নিয়ে কিন্তু; কোনো প্রশ্নই আসেনি কারোর মনে, কেনো? উদাহরণ দেয়া যেতে পারে তথ্য পাওয়াসদেশের মূলধারার পত্রিকা থেকে। অনলাইন আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের তাহলে কী অবস্থা? তা সহজেই অনুমেয়।

(৯)
পুলিশ ও এ ধরনের পত্রিকার অভিযোগের একটি প্রধান দিক। গ্রেপ্তারকৃত নারীরা ধনী ব্যক্তি বা তাঁদের সন্তানদের আমন্ত্রণ জানিয়ে এমন আপত্তিকর ছবি তাঁদের সঙ্গে তোলেন যে তাঁরা মানসম্মানের ভয়ে ব্ল্যাকমেলড হতে বাধ্য হন। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এরা প্রশ্ন তোলে না সে সব ব্যক্তিরা কারা? কী তাদের পরিচয়? কোন মানসিকতা অপরাধবৃত্তি নিয়ে তারা ‘রাতের রানি’দের আহ্বানে স্বেচ্ছায় হাজির হয়ে এমন কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয় যে, সেগুলোর ছবি বা ভিডিও প্রকাশিত হলে সমাজে মুখ দেখানো যায় না !? অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, অনৈতিক কাজ বন্ধ করা কোনো উদ্দেশ্য নয়, বরং এতে ব্ল্যাকমেলের শিকার হওয়া ধনাঢ্য ব্যক্তিদের ক্ষোভ মোচনই হচ্ছে পুলিশ আর একশ্রেণির সংবাদমাধ্যমের আসল কাজ! আলোচিত এসব গ্রেপ্তারের ঘটনায় আরেকটি লক্ষণীয় দিক হচ্ছে, গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিদের বাসা থেকে অবধারিতভাবে মদ ও মাদকদ্রব্য, ক্যাশিনোর সরঞ্জাম, কালোটাকা উদ্ধার এবং তার ব্যাপক প্রচার। প্রশ্ন আসে, এর পেছনে কি এ দেশের রক্ষণশীল সমাজকে প্রথমেই হেয় করা হয় না? নিজেদের সস্তা জনপ্রিয়তা পাওয়ার কোনো মানসিকতা কাজ করে কি-না ? তা নাহলে এতো মাদক আর মদ তাঁরা কার কাছ থেকে? অথবা কোথা থেকে সংগ্রহ করেন? সাধারণ জনগণ তা কখনো জানতে পারে না কেন?

(১০)
গ্রেপ্তার নারীদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে, তা অভিযোগ হিসেবেই সংবাদমাধ্যমকে জানানো উচিৎ। কিন্তু ; বিচারের আগেই তাঁদের দোষী হিসেবে উপস্থাপন বা তাঁদের সম্পর্কে অশ্লীল প্রচারণা থেকে সবাইকে বের হতে হবে। তাঁরা অপরাধ করে থাকলে এর সঙ্গে জড়িত সবার যেমনঃ মদ বা মাদকের জোগানদাতা, পর্নোগ্রাফি বা অবাধ যৌনাচার চক্রের পৃষ্ঠপোষক, পার্টনার ও সুবিধাভোগীতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।সাথে তাদের ছবিসহ পরিচয় প্রদান করতে হবে । এই ধরনের চক্র না থাকলে কোনো নারীর একার পক্ষে বছরের পর বছর কথিত সব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা সম্ভব নয়। অপরাধ যতো বড়ো হয় তার পেছনে গডফাদার ও মাফিয়াচক্রও থাকেন সক্রিয়। পাপিয়া, পিয়াসা, পরীমনিদের অপরাধ যদি বড়োই হয় তাহলে তাঁদের গডফাদারও অনেক বেশি শক্তিশালী থাকার কথা। এর আগে ক্যাসিনো-কাণ্ডে ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট গ্রেপ্তার হওয়ার সময় আমরা সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বলতে শুনেছি, “এমন কর্মকাণ্ডের পেছনে গডফাদার আছেন এবং তাঁরা কেউ রেহাই পাবেন না।” কিন্তু পরে আমরা সম্রাটের কোনো গডফাদারকে গ্রেপ্তার হতে দেখিনি বা এমন কারোর নামও শুনিনি,ছবি দেখার তো কোনো প্রশ্নই আসে না । গডফাদারদের বাদ দিয়ে, অপরাধের সূতিকাগারে হানা না দিয়ে, কিছু চুনোপুঁটি কথিত অপরাধী গ্রেপ্তার করে, তাঁদের নিয়ে ঢোলবাদ্য বাজালে কেউ সস্তা বাহবা বা বিকৃত আনন্দ উপভোগ করতে পারে। কিন্তু ; তাতে কোনোদিনও আসল সমস্যার সমাধান হবে না ! আসল সমস্যার সমাধান করতে হবে সংবিধান আর আইনকে সততার সঙ্গে মেনে। এসব মেনে চললে অপরাধ প্রমাণের আগে কাউকে দোষী হিসেবে উপস্থাপন করা যাবে না। অপরাধের সঙ্গে জড়িত সব পক্ষকেই বিচারের আওতায় নেয়ার নির্দেশ থাকা বাঞ্ছনীয়। অপরাধী নয়, অপরাধ দমনের দিকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হলে হয়তো কিছুটা হলেও সহায়ক ভূমিকা পালন করা হবে। গণমাধ্যমকেও দায়িত্বশীল ও সততার সাথে ভূমিকা পালন করতে হবে দেশের স্বার্থে । কিন্তু; সবকিছু দেখে মনে হচ্ছে, এসব কথা জেনে- শুনেই আমরা ভুলতে বসেছি ক্ষমতা ও স্বার্থের তরে ||

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!