নিউজ ডেক্স : চট্টগ্রাম সিটি কলেজ থেকে ২০১৩ সালে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন করেন সাইদুল ইসলাম। এরপর একটি ভুঁইফোড় ওষুধ কোম্পানিতে কাজ করেন দুই বছর। একপর্যায়ে ২০১৫ সালে নিজেই খুলে বসেন ওষুধ কোম্পানি। নাম দেন- অ্যাকয়ার ফার্মা। চীন ও ভারত থেকে আনতেন ওষুধ। বাসায় বসে নিজের কোম্পানির নামে করতেন প্যাকেটজাত। চার ধরনের ওষুধ এনে বাজারজাত করতেন ২২ নামে। টাকার বিনিময়ে ডাক্তারদের দিয়ে এসব ওষুধ লেখান তিনি ব্যবস্থাপত্রেও। ভয়ঙ্কর প্রতারণা করা এমন ১৮ ডাক্তারের হদিস পেয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ। ‘গুণধর’ এ ডাক্তারদের কে কত টাকার বিনিময়ে অনিবন্ধিত ও ভেজাল এসব ওষুধ ব্যবস্থাপত্রে লিখেছেন- জিজ্ঞাসাবাদে মিলেছে তাও। এসব ডাক্তারের বিরুদ্ধে তাই ব্যবস্থা নিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর, বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি), জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরেও চিঠি দিচ্ছে গোয়েন্দা পুলিশ।
চট্টগ্রাম নগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার পলাশ কান্তি নাথ বলেন, ‘চার ধরনের সফট জেল ভারত ও চীন থেকে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিয়ে আসতেন সাইদুল। তার কোনো ল্যাব নেই। টেকনিশিয়ানও নেই। হাতেই এগুলো ২২ নামে প্যাকেজিং করতেন। এরপর নিজেই উচ্চ হারে কমিশনে বিক্রির জন্য দিয়ে আসতেন বিভিন্ন ফার্মেসিতে। এতেও ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ লাভ থাকত তার। চিকিৎসকদের বিভিন্ন উপহারসামগ্রী ও প্রতি মাসে টাকাও দিতেন নির্দিষ্ট হারে। আর এসব ভেজাল ওষুধ ব্যবস্থাপত্রে লিখতেন ১৮ জন ডাক্তার। এই বিপজ্জনক ডাক্তারদের একটা তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সংশ্নিষ্ট দপ্তরগুলোতে চিঠি দেওয়া হচ্ছে।’
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর চট্টগ্রামের তত্ত্বাবধায়ক মো. শফিকুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘গোয়েন্দা পুলিশ যেসব নামের ওষুধ জব্দ করেছে, এগুলোর কোনো অনুমোদন নেই। এমনকি এগুলো ওষুধই নয়। যেসব চিকিৎসক এগুলো ব্যবস্থাপত্রে লিখেছেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও বিএমডিসিতে লিখিতভাবে জানানো হবে। এসব ওষুধ কোনো ফার্মেসি কিংবা অন্য কোথাও ওষুধ হিসেবে বিক্রি হলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
১৭ জানুয়ারি খুলশী থানাধীন লালখান বাজার পশ্চিম হাই লেভেল রোডের মো. তাহেরের ভবনের নিচতলায় অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ ভেজাল ওষুধসহ একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃত সাইদুল ইসলাম শরীয়তপুর জেলার নুরিয়া থানার নওগাঁও গ্রামের শেখবাড়ির আবুল হোসেন শেখের ছেলে। এ সময় বিপুল পরিমাণ ভেজাল ওষুধ ও প্যাকেজিং সরঞ্জামও উদ্ধার করা হয়েছে। ওষুধগুলোর মধ্যে রয়েছে অ্যাকুয়াজ সফট জেল, অ্যাকুয়ার সফট জেল, ক্যাপরাল ট্যাবলেট, প্রোবায়োটিক-৪ ক্যাপসুল, ফ্যাট লস গ্রিন টি, এক্সট্রাক্ট সফট জেল ক্যাপসুল, উইন ক্যাল, উইন গোল্ড, উইন প্লাস, কার্টিয়াম, অ্যামিনো আলট্রা, ইউনি পোলেন, সিয়াম প্লাস, নিউরোপা ডায়েট্রি সাপ্লিমেন্ট ও মেমোরি কেয়ার ডায়েট্রি সাপ্লিমেন্ট। চার ধরনের সফট জেল ক্যাপসুল এনে এভাবে ২২ নামে মোড়কজাত করতেন সাইদুল, বাজারজাত করতেন অ্যাকয়ার ফার্মার নামে। টাকার বিনিময়ে এসব ভেজাল ওষুধ লিখতেন ডাক্তাররা।
নগর গোয়েন্দা পুলিশের তালিকা অনুযায়ী শেভরন ল্যাবরেটরি লিমিটেডের চিকিৎসক এম এ রউফ এসব ভেজাল ওষুধ ব্যবস্থাপত্রে লেখার বিনিময়ে প্রতি মাসে নিতেন ৩০ হাজার টাকা। দুই বছর ধরে এ টাকা নিচ্ছেন তিনি। সর্বশেষ গত ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতেও নিয়েছেন। একই প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসক আবরার হোসেন নেন প্রতি মাসে ২০ হাজার, শিমুল কুমার পাঁচ হাজার, জসিম উদ্দিন ১০ হাজার, আবদুর রব ১০ হাজার ও সাদিক হোসেন ১০ হাজার টাকা। তারা সবাই দেড় থেকে দুই বছর ধরে এ টাকা নিচ্ছেন। চলতি মাসেও টাকা নিয়েছেন তারা।
ল্যানসেট ডায়াগনস্টিক সেন্টারের চিকিৎসক আলী আজগর নেন ১০ হাজার টাকা। পিপলস হাসপাতালের চিকিৎসক মহিউদ্দিন শিকদার প্রতি মাসে নিতেন ৩০ হাজার টাকা করে। এক বছর ধরে এ টাকা নিচ্ছেন তিনি। সর্বশেষ গত ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেও নিয়েছেন। একই হাসপাতালের ডা. চন্দন কুমার প্রতি মাসে নিতেন ১৫ হাজার। দেড় বছর ধরে তিনি এ টাকা নিয়ে ভেজাল ওষুধ লিখেছেন। এ ছাড়া আশীষ কুমার দে নিতেন ১০ হাজার করে। দুই বছর ধরে নিচ্ছেন এটা। সর্বশেষ ১২ জানুয়ারিও নিয়েছেন। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার মেজবাহ সালেকিন প্রতি মাসে নিতেন ১০ হাজার, দেড় বছর ধরে। একই হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার রিমন দাশ, অনিক চৌধুরী ও রাজীব চৌধুরীও প্রতি মাসে নিতেন তিন হাজার করে। সাতকানিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক ফরহাদ আলী রাজু নিতেন প্রতি মাসে পাঁচ হাজার টাকা।
এপিক হেলথ কেয়ারের চিকিৎসক তৌহিদুল আলম নিতেন ১০ হাজার ও আরমান হোসেন নিতেন তিন হাজার করে। চিকিৎসক অসীম বড়ূয়া নেন ছয় হাজার। নগরের চকবাজার ফুলতলা এলাকায় রয়েছে তার চেম্বার।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চমেক হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডা. রাজীব চৌধুরী বলেন, ‘আমি চমেক হাসপাতালে যোগদান করেছি গত নভেম্বরে। মেডিকেল ছাড়া বাইরে কোথাও আমার চেম্বারও নেই। নাম নিয়ে কোথাও ভুল হচ্ছে। এই দেড় মাসে অনুমোদনহীন কোনো ওষুধ আমি ব্যবস্থাপত্রে লিখিনি।’
পুলিশের তালিকায় ডা. অনিক চৌধুরীর নাম থাকলেও এ নামে চমেক হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগে কোনো চিকিৎসক নেই। তবে অনিক চন্দ নামের একজন চিকিৎসক আছেন। তিনি সমকালকে বলেন, ‘চার বছর আগে চমেক হাসপাতালে যোগদান করেছি। নগরে আমার কোনো চেম্বার নেই। ফটিকছড়িতে চেম্বার করলেও কোনো রোগীর ব্যবস্থাপত্রে ভেজাল কিংবা অনুমোদনহীন কোনো ওষুধ লিখিনি কখনও।’
চমেক হাসপাতালের মানসিক স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান ডা. মহিউদ্দিন সিকদার তার নাম থাকা প্রসঙ্গে বলেন, ‘এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। কারও কাছ থেকে নির্দিষ্ট ওষুধ লেখার বিনিময়ে কোনো টাকা নিই না আমি। উপহারসামগ্রীও খুলে দেখি না। চেম্বারের সহকারীরাই নিয়ে যায় ওসব।’ তবে হাসপাতালের পাশে পিপলস হাসপাতাল ও এপিক হেলথ কেয়ারে নিয়মিত চেম্বার করেন বলে স্বীকার করেন তিনি।
ওষুধ (নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাদেশ ১৯৮২-এর ১৪(এ)(১) ধারা অনুযায়ী, ‘এ অধ্যাদেশ অনুযায়ী কোনো রোগীর জন্য চিকিৎসক নিবন্ধনবিহীন ওষুধ ব্যবস্থাপত্র দিতে পারবেন না।’ ২০১৪ সালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর একটি নির্দেশনা জারি করে। সেখানে বলা হয়, ‘ওষুধ (নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাদেশের আলোকে জনস্বাস্থ্যের গুরুত্ব বিবেচনা করে আপনার নিয়ন্ত্রণাধীন কর্মরত ফিজিশিয়ানগণ (ডাক্তার) যাতে নিবন্ধনবিহীন ওষুধ ও তথাকথিত ফুড সাপ্লিমেন্ট-এর ব্যবস্থাপত্র প্রদান না করেন, তার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আপনাকে অনুরোধ করা হইল।’
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. এ এম মুজিবুল হক বলেন, ‘টাকার বিনিময়ে কোনো ওষুধ লেখা নৈতিকতা-বিবর্জিত। কোনো অননুমোদিত ওষুধ লেখা তো খুবই অপরাধ। অনুমোদনহীন ওষুধ ব্যবস্থাপত্রে লেখার প্রমাণ পেলে সংশ্নিষ্ট চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া এ ধরনের ওষুধ উৎপাদন, বিপণন ও বিক্রির তথ্য পেলেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ব্যবস্থাপত্রে কোনো ফুড সাপ্লিমেন্ট না লিখতেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা রয়েছে।’
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের নিবন্ধক ডা. মো. জাহিদুল হক বসুনিয়া এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘কোনো চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্রে ওষুধ হিসেবে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অননুমোদিত ওষুধ লিখতে পারেন না। এ ধরনের সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে তাদের বিরুদ্ধে।’ -সমকাল