ব্রেকিং নিউজ
Home | দেশ-বিদেশের সংবাদ | চট্টগ্রামেও বিবাহ বিচ্ছেদের হিড়িক : পরকীয়ায় ভাঙছে সংসার

চট্টগ্রামেও বিবাহ বিচ্ছেদের হিড়িক : পরকীয়ায় ভাঙছে সংসার

maxresdefault

নিউজ ডেক্স : চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিএ’র ছাত্রী ১৯ বছরের তরুণী ফারজানা লোপা। সম্পর্কে জড়িয়ে বিয়ে করেছেন এক সন্তানের জনক পারভেজ সিকদারকে। পারভেজ পেশায় শিপ ব্রেকিং ব্যবসায়ী। তার সংসারে স্ত্রী থাকার কথা জেনেই লোপা বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু বিয়ের এক মাসের মাথায় লোপা পারভেজকে চাপ দিতে থাকে প্রথম স্ত্রীকে তালাক দিতে। লোপার এ আবদার রক্ষা না করায় তালাকের সিদ্ধান্ত নেয় লোপা। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন আদালত-১ এর ম্যাজিস্ট্রেট তাকে অনেক বুঝিয়ে সংসার টিকাতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত ৩ মাসের মাথায় বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটায় সে। শুধু লোপা-পারভেজ নয়, প্রতিদিন এভাবে চট্টগ্রামে বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য আবেদন জমা পড়ছে গড়ে ২০ থেকে ২৫টি। গড়ে প্রতি ঘণ্টায় একটি। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন যুগ্ম জেলা জজ, (স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট) জাহানারা ফেরদৌসের মতে পারস্পরিক আস্থাহীনতা এবং নতুন সম্পর্কে (পরকীয়া) জড়িয়ে যাওয়ার কারণে চট্টগ্রামে বিবাহ বিচ্ছেদের হার উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে গেছে।

গত দু’মাসে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে (চসিক) সালিশি মামলা জমা পড়েছে ২ হাজার ৮২৬টি, যার মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন ১ হাজার ৭৮টি। পারিবারিক কলহ, যৌতুক দাবি ইত্যাদি কারণেও বিবাহ বিচ্ছেদের হার বেড়েছে। ইন্টারনেট ফেসবুক ও মোবাইলে গড়ে ওঠা সম্পর্ক এবং ভারতীয় টিভি সিরিয়ালের জন্য দায়ী করছেন সমাজ বিজ্ঞানীরা।

চসিক সূত্র জানায়, ২০১৫ সালে বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য ৩ হাজার ৪৮৬টি আবেদন জমা পড়েছিল। ২০১৬ সালে ৩ হাজার ৯৬১টি আবেদন জমা পড়ে। আর ২০১৭ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন জমা পড়েছে ১ হাজার ৯২৯টি। আবেদনকারীদের মধ্যে ৭০ শতাংশই নারী। পূর্বে শারীরিক, মানসিক নির্যাতন ও যৌতুকের বিষয়গুলো বিচ্ছেদের কারণ হিসেবে বেশি উল্লেখ করা হতো। কিন্তু বর্তমানে এসব বিষয়ের সঙ্গে অবহেলা, দায়িত্ব পালনে অনীহা, আস্থাহীনতা এবং পরকীয়ার বিষয়গুলো বেশি উল্লেখ করা হচ্ছে।

চসিকের হিসেব মতে ২০১৬ সালে সিটি করপোরেশনের আওতাধীন ২টি আদালতে ৩ হাজার ৯৬১টি বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটেছে। ১ নম্বর আদালতে ১ হাজার ৫৩৪টি এবং ২ নম্বর আদালতে ২ হাজার ৪২৭টি বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে।

নগরীর ১৬ থানার মধ্যে ইপিজেড এলাকায় বিচ্ছেদের হার সবচেয়ে বেশি। চট্টগ্রামে পুরুষের চেয়ে নারীরা বিবাহ বিচ্ছেদ আবেদনে এগিয়ে। নগরীতে ৬৫ শতাংশ বিচ্ছেদ ঘটছে নারীদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে।

স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট জাহানারা ফেরদৌস বলেন, ফেসবুক, ইন্টারনেট ও মোবাইলের অপব্যবহারের মাধ্যমে সম্পর্কে জড়িয়ে বর্তমানে অধিকাংশ যুবক-যুবতী বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছেন। বিয়ের পর আবার এসব মাধ্যমে যোগাযোগের সূত্র ধরে অন্য কোনো ব্যক্তির প্রতি মনোযোগী হয়ে পড়ছেন তারা। একপর্যায়ে নতুন সম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী হচ্ছেন। কোনো রকম সম্পর্কে না জড়ালেও সন্দেহ আর অবিশ্বাসের কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার সম্পর্কে ফাটল সৃষ্টি হচ্ছে।

তিনি বলেন, উচ্চবিত্ত এবং নিম্নবিত্তদের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদের প্রবণতা বেশি। এছাড়া প্রবাসী অথবা স্বামী অন্য শহরে কাজ করে এরকম স্ত্রীদের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদের হার বেশি। কারণ স্বামীকে কাছে না পেয়ে তারা একাকিত্বে ভোগে। এই একাকিত্বের কারণে তারা পরকীয়াতে জড়িয়ে পড়ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দূর থেকে মোবাইল, ইন্টারনেট কিংবা ফেসবুকের অপব্যবহারের মাধ্যমে গড়ে ওঠা এসব সম্পর্কের ক্ষেত্রে পরস্পরের ব্যাপারে ভালোভাবে জানা হয়ে ওঠে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভুল তথ্য দিয়ে নিজের অবস্থানকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করেন তরুণ-তরুণীরা। এসব মিথ্যা তথ্যের ওপর দাঁড়িয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তারা। পরে সংসার করতে গিয়ে প্রকৃত সত্য জানতে পারেন তারা। এতে পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস জন্ম নেয়। একে অপরের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেন।

অনেক সময় তুচ্ছ বিষয়কে কেন্দ্র করে সম্পর্ক ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নেন স্বামী-স্ত্রী দুজনই। এ বিষয়ে উকিলের সঙ্গে পরামর্শ করে আবেদন করেন। আবেদন জমা দেয়ার পরও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য তিন মাস সময় থাকে। এর মধ্যে যে কেউ চাইলে বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন বাতিল করতে পারেন।

এ প্রসঙ্গে চসিক পেশকার আবু জাফর চৌধুরী বলেন, সিটি করপোরেশন অফিসে সরাসরি আবেদন করা দম্পতিদের বুঝিয়ে প্রতিমাসে ৮ থেকে ১০টি আবেদন প্রত্যাহার করানো হয়। কিন্তু উকিলের মাধ্যমে আসা নথিগুলো খুব একটা প্রত্যাহার হয় না। যদিও অধিকাংশ বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন উকিলের মাধ্যমেই আসে। যে কেউ চাইলে সিটি করপোরেশন অফিসে সরাসরি বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন করতে পারেন। এটা অনেকে জানেন না।

সমাজবিজ্ঞানী ও প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. অনুপম সেন বিবাহ বিচ্ছেদের অন্যতম কারণ যৌতুক প্রথাকে দায়ী করেন। তার মতে এটি অনেকটা মানবতাবিরোধী অপরাধের মতোই। তিনি আরো বলেন, গ্রামীণ সমাজ ভেঙে খুব দ্রুত নাগরিক সমাজে পরিণত হচ্ছে। নাগরিক সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে সচেতন হচ্ছে মানুষ। নগর এলাকায় একসঙ্গে অনেক মানুষের আবাসন গড়ে উঠছে। নৈকট্য এবং যোগাযোগের সুযোগ-সুবিধা বেড়ে যাওয়ার কারণে পারস্পরিক সম্পর্ক ও অনাস্থার পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে। এসবের প্রভাবে বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যা বাড়ছে।

চট্টগ্রাম লিগ্যাল এইড কমিটির প্যানেল আইনজীবী কানিছ কাউছার চৌধুরী জানান, আগে বিত্তবান পরিবারের মাঝে বিবাহ বিচ্ছেদের হার বেশি ছিল। ইদানীং এটি মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত পরিবারের মাঝেও ব্যাপক আকারে দেখা যাচ্ছে। পারিবারিক বন্ধন নড়বড়ে হওয়া, স্বামী-স্ত্রীর পরকীয়াসহ সমাজে নৈতিক অবক্ষয় বাড়ার কারণেই বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে। এছাড়া কিছু কিছু বিদেশি টিভি চ্যানেলে বিচ্ছেদ এবং পরকীয়ায় উদু্বদ্ধ করে প্রচার হওয়া নাটক সিরিয়াল দেখে নারীরা তা অনুকরণ করছে। তারা মনে করছে এটিই বাস্তবতা। এছাড়া শিক্ষিত নারীদের স্বামী কিংবা শ্বশুরবাড়ির লোকজন বকা-ঝকা করলে বা মতের মিল না হলে তা তারা মানতে পারে না। ওইসব কারণেও বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটছে।

– মানব জমিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!