সৈয়দ মোহাম্মদ আলমগীর : চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং-এর লেখা থেকে জানা যায়, প্রথম শতাব্দী থেকেই “কাশ-মি-লো” নামে কাশ্মীর রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল।১৮১৯ সাল পর্যন্ত পাশতুন উপজাতীয় দিরানী রাজবংশ কাশ্মীর শাসন করত। ১৮১৯ সালে শিখ মহারাজা রণজিৎ সিংহ কাশ্মীর দখল করে নেয়। ১৯২৫ সালে হরি সিং কাশ্মীরের রাজা হন। প্রথম ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধের পর লাহোর চুক্তি অনুসারে কাশ্মীর ইষ্টইণ্ডিয়া কোম্পানির শাসনাধীনে আসে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজন পর্যন্ত ইষ্টইণ্ডিয়া কোম্পানির পক্ষে হরি সিং ছিলেন কাশ্মীরের শাসক। হিন্দু মহারাজাদের অধীনে কাশ্মীর শাসিত হলেও জম্মু ও লাডাখ অঞ্চল ছাড়া সমগ্র রাজ্যে মুসলমান জনসংখ্যার আধিক্য ছিল বেশি।
‘ইন্ডিয়ান ইনডিপেন্ডেন্স এ্যাক্ট’ নামে ব্রিটিশ ভারত বিভক্তির যে পরিকল্পনা তৈরি হয়েছিল তাতে বলা হয়েছিল, ভারতের দেশীয় রাজ্যের রাজারা ভারত বা পাকিস্তানে যোগ দিতে পারবেন, অথবা তাঁরা স্বাধীনতা বজায় রেখে শাসনকাজ চালাতে পারবেন। কাশ্মীরের তৎকালীন হিন্দু মহারাজা হরি সিং চাইছিলেন স্বাধীন থাকতে অথবা ভারতের সাথে যোগ দিতে। অন্যদিকে পশ্চিম জম্মু এবং গিলগিট-বালতিস্তানের মুসলিমরা চাইছিলেন পাকিস্তানের সাথে যোগ দিতে।
১৯৪৭ সালের ২৬ অক্টোবর হরি সিং কাশ্মীরের ভারতভুক্তির চুক্তিতে সই করেন। ২৭ অক্টোবর তা ভারতের গভর্নর-জেনারেল কর্তৃক অনুমোদিত হয়। ফলে ১৯৪৭ সালেই শুরু হয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ – যা চলেছিল প্রায় দু’বছর ধরে।ভারত জম্মু’র বেশিরভাগ অংশ, কাশ্মীর উপত্যকা, লাডাখ এবং সিয়াচেন হিমবাহ নিয়ে প্রায় ৪৩% অঞ্চল ও পাকিস্তান আজাদ কাশ্মীর এবং গিলগিট, বাল্টিস্থানের উত্তরাঞ্চলসহ কাশ্মীরের ৩৭% দখল করে নেয়।
কাশ্মীরের রাজা হরি সিংহ ও ভারতের মধ্যে চুক্তি মোতাবেক ১৯৪৯ সালের ১৭ অক্টোবর ভারতীয় সংবিধানে ৩৭০ ধারা সংযোজন হয়। ৩৭০ ধারার উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলি হলো :
• কোন বহিরাগত কাশ্মীরে জমি কিনতে পারবে না।
• কোন বহিরাগত কাশ্মীরে চাকুরী পাবে না ।
• কাশ্মীরে স্বতন্ত্র নিজস্ব সংবিধান ও পতাকা থাকবে।
• ভারতীয় সংসদ প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও যোগাযোগ- এই তিনটি বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।অন্যান্য বিষয়ে জম্মু কাশ্মীর স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।
• জম্মু, কাশ্মীর, লাদাখ হবে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
পাকিস্তান প্রথম থেকেই সমগ্র কাশ্মীর পাকিস্তনের অংশ বলে দাবি করে আসছিলো। ভারত ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে কাশ্মীর প্রসঙ্গ উত্থাপন করে।এ প্রসঙ্গে জাতিসংঘ ৪৭ নম্বর প্রস্তাবে কাশ্মীরে গণভোট, পাকিস্তানের সেনা প্রত্যাহার, এবং ভারতের সামরিক উপস্থিতি ন্যূনতম পর্যায়ে কমিয়ে আনতে আহ্বান জানায়।ভারত প্রথমে গনভোটে রাজী হলেও পরবর্তী জম্মু কাশ্মীরের জনগণের মনোভাব পাকিস্তানের দিকে হওয়ায় গনভোট অস্বীকার করে।ফলশুতিতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কাশ্মীর নিয়ে ১৯৪৭, ১৯৬৫ এবং ১৯৯৯-এ তিনটি বড় যুদ্ধ সংগঠিত হয়। এছাড়াও,১৯৮৪ সালের পর থেকে সিয়াচেন হিমবাহ এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এই দুই দেশের মধ্যে বেশ কয়েকটি খণ্ডযুদ্ধ সংগঠিত হয়।
আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টো জাতিসংঘে দেওয়া তার বিখ্যাত ভাষণে বলেছিলেন, “কাশ্মীর কখনই ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ নয় – বরং এটি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যেকার এক বিতর্কিত ভূখন্ড।”পাকিস্তানের এই নীতি অদ্যাবধি বিদ্যমান।
এরুপ পরিস্থিতিতে ৫ই আগস্ট,২০১৯ মোদি সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলের সাথে কোনরূপ আলোচনা ছাড়াই ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করলেন।কাশ্মীরে আন্দোলনের আশংকায় ১৪৪ ধারা জারী, সমস্ত স্কুল কলেজ বন্ধ,রাজনৈতিক নেতা, প্রভাবশালী ব্যক্তিদের গৃহবন্দী,ইন্টারনেটসহ যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ, সাংবাদিকদের প্রবেশ নিষেধ করেছেন। সকল পর্যটকদের কাশ্মীর ত্যাগ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। জম্মু ও কাশ্মীরকে দুটি ভাগে বিভক্ত করে সেই দুটিকে ভারতের দুটি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। লাদাখ-কেও পৃথক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হয়েছে। কাশ্মীরে অতিরিক্ত দুই লক্ষ সৈন্য মোতায়েন করেছে। মুলতঃ জম্মু কাশ্মীর এখন বহিবিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
কাশ্মীরকে নিয়ে ভারত সরকার কী করতে চাচ্ছে তা এখনও স্পষ্ট নয়।তবে অনুমিত হয় যে, প্যালেস্টাইনের মত মুসলিমদের বিতারন করে হিন্দু, বৌদ্ধদের প্রতিষ্ঠিত করা বা রোহিঙ্গাদের মত জাতিগত নিধন হতে পারে। তবে ভারতের উদ্দেশ্য যে ভাল নয় তা বুঝা যায় উত্তরপ্রদেশের মুজাফ্ফরনগরের বিধায়ক বিক্রম সাইনির কথায়। এক জনসভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে BJP বিধায়ক বলেন, ‘৩৭০ ধারা আর নেই। এবার অবিবাহিত BJP কর্মীরা জম্মু ও কাশ্মীরে সম্পত্তি কিনতে পারবেন ও কাশ্মীরি যুবতীকে বিয়ে করতে পারবেন।’ এখানেই না থেমে, BJP বিধায়ক আরও বলেন, ‘মুসলিম কর্মীদের তো আরও খুশি হওয়া উচিত। ফরসা কাশ্মীরি মেয়ে বিয়ে করতে পারবেন।’
৩৭০ ধারা বাতিল হওয়ায় পাকিস্তান তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। মঙ্গলবার (৬ আগস্ট) রাওয়ালপিন্ডিতে সেনা কমান্ডারদের বৈঠক শেষে দেশটির সেনাবাহিনীর আইএসপিআরের মুখপাত্র আসিফ গফুর বলেন, কাশ্মীরি জনগণের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতার জন্য যতদূর করতে হয় তার জন্য পাক সেনাবাহিনী প্রস্তুত।
পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল কামার জাবেদ বলেন, কাশ্মীরিদের শেষ সংগ্রামে কাশ্মীরিদের শেষ লড়াই পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দৃঢ়ভাবে তাদের পাশে থাকবে। আমাদের দায়বদ্ধতা থেকে যতদূর করতে হয় তার জন্য আমরা প্রস্তুত। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহারে ভারতের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে লড়াই করবেন। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে তিনি বিষয়টি তুলবেন বলে জানিয়েছেন।
ইতিমধ্যে পাকিস্তান ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করেছে। একই সঙ্গে ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বন্ধের ঘোষণাও করল পাকিস্তান। ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের বহর কমিয়ে দেওয়া এবং দ্বিপাক্ষিক কূটনৈতিক সম্পর্ক পর্যালোচনা করে পুনর্বিন্যাস করা হবে বলেও সরকারি ভাবে এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিল ইসলামাবাদ।
তুরস্ক ও চীনসহ কয়েকটি দেশ পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়েছে।যুক্ত রাষ্ট্র গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে।
চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখপাত্র হুয়া চুনইয়াং মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে বলেন, পশ্চিম অঞ্চলে চীন-ভারত সীমান্তে ভারত চীনা অঞ্চলকে অন্তর্ভুক্ত করার বিরোধীতা করে আসছে। ভারত অভ্যন্তরীণ আইন একতরফা সংশোধন করায় চীনের আঞ্চলিক সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ণ হচ্ছে, যা গ্রহণযোগ্য নয়।
অন্যদিকে সৌদি আরব, শ্রীলংকাসহ কয়েকটি দেশ ভারতকে সাপোর্ট করছে। এখন দেখা যাচ্ছে ভয়াবহ এক যুদ্ধের আবহ।
লেখক : সাবেক ব্যাংকার।