ব্রেকিং নিউজ
Home | দেশ-বিদেশের সংবাদ | করোনা ইউনিটে ভর্তি রোগীদের ৭৫ ভাগই গ্রামাঞ্চলের

করোনা ইউনিটে ভর্তি রোগীদের ৭৫ ভাগই গ্রামাঞ্চলের

নিউজ ডেক্স : চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের করোনা ইউনিটে ভর্তি রোগীদের ৭৫ ভাগই গ্রামাঞ্চলের। আর চিকিৎসাধীন রোগীদের ৯৫ শতাংশের বেশি রোগী নিম্নবিত্ত পরিবারের। বর্তমানে নারী রোগীর সংখ্যা তুলনামূলক বেশি। চিকিৎসাধীন ৭০ ভাগ রোগীরই প্রয়োজন হচ্ছে অক্সিজেন সাপোর্ট। ভর্তি রোগীদের মাঝে পঞ্চাশোর্ধ রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। ৬০ শতাংশের বেশি রোগীর বয়স ৫০ ও তদুর্ধ্ব।

চিকিৎসকরা বলছেন, চিকিৎসাধীন রোগীর প্রায় শতভাগই মাস্ক পরায় চরম উদাসীন। মাস্ক পরার সঠিক নিয়মও তারা জানেন না। কেউ কেউ মাস্ক পরলেও দিনের পর দিন থুতনির নিচেই পরেছেন। এছাড়া ভর্তি রোগীদের মাঝে টিকা গ্রহীতার হার আড়াই শতাংশেরও কম। দুই ডোজ টিকা নিয়েছেন এমন রোগী পাওয়া গেছে মাত্র একজন। আর ৫ জন রোগী রয়েছেন যারা এক ডোজ করে টিকা নিয়েছেন। মোট ভর্তি রোগীর সংখ্যার অনুপাতে টিকা গ্রহীতার এই হার ২.২৬ শতাংশ।

হাসপাতালের করোনা ইউনিটে ভর্তি ২৬৫ জন রোগীর ওপর পরিচালিত এক সমীক্ষায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। গত ১২-১৯ জুলাই পর্যন্ত ভর্তি হওয়া করোনা রোগীদের ওপর এ সমীক্ষা চালান চমেক হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের এক দল চিকিৎসক। মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সুযত পালের তত্ত্বাবধানে এ সমীক্ষা কার্যক্রমে নেতৃত্ব দেন মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. রাজীব বিশ্বাস। সমীক্ষা দলে ছিলেন মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মির্জা নুরুল করিম, করোনা ইউনিটের মেডিকেল অফিসার ডা. সাবরিনা ইউসুফ ও মেডিসিন বিভাগের অনারারি মেডিকেল অফিসার ডা. সৌভিক পাল।

সমীক্ষা পরিচালনাকারী চিকিৎসকরা বলছেন, টিকা গ্রহণ সংক্রান্ত তথ্য ২৬৫ জন রোগীর কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। তবে এলাকা, নারী-পুরুষ, বয়স, আর্থিক অবস্থা, মাস্ক পরাসহ অন্যান্য তথ্য নেওয়া হয়েছে ১৭৪ জন রোগীর কাছ থেকে। সে হিসেবে টিকা সংক্রান্ত ছাড়া অন্যান্য তথ্য ১৭৪ জন রোগীর ওপর পরিচালিত সমীক্ষা থেকে পাওয়া।

সমীক্ষার উদ্দেশ্য : ভাইরাসের ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ডেল্টা ছড়িয়ে পড়ায় সারা দেশের পাশাপাশি চট্টগ্রামেও সংক্রমণ আশঙ্কাজনক হারে বাড়তে থাকে। জুনের মাঝামাঝি থেকে চমেক হাসপাতালের করোনা ইউনিটের রেড জোনে রোগী বাড়তে শুরু করে। জুনের শেষ দিকে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। এতে করোনা ইউনিটে রেড জোনের আওতা বাড়াতে বাধ্য হয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। হঠাৎ বেড়ে যাওয়া সংক্রমণকে কাছ থেকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে পর্যবেক্ষণের উদ্দেশ্যেই মূলত এই সমীক্ষা পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে জানান সমীক্ষা পরিচালনাকারী দলের নেতৃত্ব দেওয়া ডা. রাজীব বিশ্বাস। এছাড়া সংক্রমণের প্রথম ও দ্বিতীয় ঢেউয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য আছে কিনা, তা খুঁজে বের করাও এই সমীক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য। সমীক্ষায় প্রাপ্ত তথ্য করোনা রোগীদের চিকিৎসা ও সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন সমীক্ষা তত্ত্বাবধানে থাকা মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সুযত পাল।

সমীক্ষায় প্রাপ্ত তথ্য মতে, করোনায় আক্রান্ত চিকিৎসাধীন ১৭৪ জন রোগীর মাঝে ১৩০ জন ভর্তি হয়েছেন বিভিন্ন উপজেলা ও গ্রামাঞ্চল থেকে। হিসেবে ১২-১৯ জুলাই চিকিৎসাধীন রোগীর প্রায় ৭৫ ভাগই গ্রামাঞ্চলের। আর শহরাঞ্চলের রোগী ভর্তি ছিলেন ৪৪ জন। শতকরা হিসেবে এটি ২৫ শতাংশ। উপজেলা পর্যায় থেকে সবচেয়ে বেশি রোগী পাওয়া গেছে মীরসরাইয়ে। এ উপজেলা থেকে ২০ জন রোগী চিকিৎসাধীন ছিলেন। ফটিকছড়ি থেকে চিকিৎসাধীন ছিলেন ১৭ জন। রাউজান থেকে ১৬ জন ও বোয়ালখালী থেকে ১৪ জন রোগী ওই সময়ে চিকিৎসাধীন ছিলেন। বাকি রোগী কুমিল্লা, নোয়াখালী, ফেনীসহ চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চল ও উপজেলা থেকে এসে ভর্তি হন।

নারী রোগী তুলনামূলক বেশি : সামপ্রতিক সময়ে করোনায় আক্রান্ত নারীদের সংখ্যা বেড়েছে বলে মনে করছেন সমীক্ষা পরিচালনাকারী চিকিৎসকরা। আক্রান্তের পর যাদের হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। সমীক্ষায় দেখা যায়, ১৭৪ জনের মাঝে নারী রোগী ভর্তি ছিলেন ৯৩ জন। আর পুরুষ রোগী ছিলেন ৮১ জন। নারী রোগীদের প্রায় শতভাগই গৃহিণী।

পঞ্চাশোর্ধ রোগীর সংখ্যা বেশি : চিকিৎসাধীন রোগীদের মাঝে সবচেয়ে বেশি রোগী ৫০ ও তদুর্ধ্ব বয়সী। ৬০ শতাংশের বেশি রোগী এই বয়সী। সমীক্ষায় প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ভর্তি রোগীদের মাঝে সবচেয়ে বেশি রোগী ৫০-৫৯ বছর বয়সী। এই বয়সী ৪০ জন রোগী ওই সময়ে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ৬০-৬৯ বছর বয়সী ভর্তি ছিলেন ৩৬ জন। ৭০-৭৯ বছর বয়সী ছিলেন ৩৪ জন। হিসেবে ৫০ ও তদুর্ধ্ব বয়সী ১১০ জন রোগী ওই সময়ে চিকিৎসাধীন ছিলেন, যা মোট ভর্তি রোগীর ৬৩ শতাংশ। আর ৩০ বছরের কম বয়সী রোগীর সংখ্যা ১৭ জন। শতকরা হিসেবে যা ১০ শতাংশের সামান্য বেশি।

৯৫ ভাগের বেশি রোগী নিম্নবিত্ত পরিবারের : চিকিৎসাধীন রোগীদের প্রায় ৯৫ ভাগই নিম্নবিত্ত পরিবারের বলে সমীক্ষায় উঠে এসেছে। অর্থাৎ চিকিৎসাধীন এসব রোগীর পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুবই দুর্বল।

টিকা গ্রহীতার হার আড়াই শতাংশের কম : সমীক্ষায় দেখা যায়, ২৬৫ জন রোগীর মাঝে মাত্র একজন রোগী পাওয়া গেছে, যিনি করোনার দুই ডোজ টিকা গ্রহণ করেছেন। আর ৫ জন রোগী এক ডোজ করে টিকা নিয়েছেন। হিসেবে চিকিৎসাধীন রোগীদের মাঝে টিকা গ্রহীতার হার ২.২৬ শতাংশ। বাকি রোগীদের কেউ টিকা নেননি।

মাস্ক পরায় উদাসীনতা : হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এসব রোগীর প্রায় শতভাগই মাস্ক পরায় চরম উদাসীন মর্মে সমীক্ষায় উঠে এসেছে। সমীক্ষা পরিচালনাকারী ডা. রাজীব বিশ্বাস বলছেন, আমরা প্রত্যেক রোগীর কাছ থেকে মাস্ক পরার বিষয়ে তথ্য নিয়েছি। গ্রামাঞ্চলের নিম্নবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের এসব রোগী মাস্ক পরায় চরম উদাসীন। মাস্ক পরা নিয়ে তাদের মাঝে সচেতনতা নেই বললেই চলে। মাস্ক পরার সঠিক নিয়মও তারা জানেন না। কেউ কেউ পরলেও মাস্কটি থুতনিতে ঝুলিয়ে রাখতেন। আর একই মাস্ক তারা দিনের পর দিন পরতেন বলে আমাদের জানিয়েছেন।

মাস্ক পরায় উদাসীনতা ও অসচেতনতার কারণে গ্রামাঞ্চলে আক্রান্তের হার আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে বলে মনে করছেন অধ্যাপক ডা. সুযত পাল। তিনি বলেন, গ্রামাঞ্চলের মানুষ এখনো সচেতন নন, যার কারণে সংক্রমণ আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। টিকা গ্রহণেও গ্রামাঞ্চলের মানুষের মাঝে অসচেতনতা লক্ষনীয়। ২৬৫ জন রোগীর মাঝে মাত্র ৬ জন পাওয়া গেছে, যারা করোনার টিকা নিয়েছেন। এ থেকে স্পষ্ট যে, টিকা গ্রহণের পর করোনায় আক্রান্ত হলেও গুরুতর জটিলতা দেখা যাচ্ছে না। অর্থাৎ কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া টিকাগ্রহীতাদের হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে না। তাই সবার টিকা নিতে হবে। আর মাস্ক পরার বিকল্প নেই। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের মানুষকে এ বিষয়ে সচেতন করতে হবে।

অক্সিজেন সাপোর্ট লাগছে ৭০ ভাগ রোগীর : করোনায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন রোগীদের দুই-তৃতীয়াংশই (১০৮ জন) হাসপাতালে এসেছেন গুরুতর অবস্থায়। গুরুতর এসব রোগীর মাঝে ৬০ শতাংশের (৬০ জন) অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৮৫ শতাংশের কম। চিকিৎসাধীন রোগীদের ৭০ ভাগেরই (১১৭ জন) বিভিন্ন মাত্রায় অক্সিজেন সাপোর্ট প্রয়োজন হচ্ছে। আর জটিল রোগীর সংখ্যা ১৫ জন।

সমীক্ষা পরিচালনাকারী চিকিৎসকরা বলছেন, গুরুতর জটিলতা থাকা রোগীদের আইসিইউতে স্থানান্তর করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিচ্ছে। কিন্তু আইসিইউ শয্যার অপ্রতুলতার কারণে সবাইকে আইসিইউ সেবা দেওয়া যাচ্ছে না। করোনা ইউনিটের রেড জোনে চিকিৎসাধীন রোগীদের মাঝে দৈনিক অন্তত ১০-১২ জনকে আইসিইউতে স্থানান্তরের প্রয়োজন দেখা দিচ্ছে। কিন্তু আইসিইউ শয্যা রয়েছে ৫টি। তাই আন্তরিকতা থাকলেও সব রোগীকে এ সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

সমীক্ষা পরিচালনাকালীন অন্তত ৮ জন অন্তঃসত্ত্বা নারী গর্ভকালীন ও প্রসব পরবর্তী জটিলতা নিয়ে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। এছাড়া দৈনিক গড়ে ৩৫ জন রোগী ভর্তি হচ্ছেন এখানে। সমীক্ষা পরিচালনাকালীন এক সপ্তাহে রেড জোনে ৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে।

সুপারিশ : সমীক্ষায় প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনা করে বেশ কয়েক দফা সুপারিশ করেছে সমীক্ষা পরিচালনাকারী চিকিৎসক দল। এসব সুপারিশের মধ্যে রয়েছে, সর্বস্তরে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা, গণ টিকাদান যত দ্রুত সম্ভব সম্পন্ন করা, যেকোনো মূল্যে বিরামহীন অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করা, জনবলসহ আইসিইউ শয্যা-সুবিধা বাড়ানো, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও লজিস্টিক সাপোর্ট বাড়ানো, চিকিৎসক-নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো।

চমেক হাসপাতালের করোনা ইউনিট অতি অল্প সুযোগ-সুবিধা নিয়ে করোনা রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে আসছে বলে মনে করেন অধ্যাপক ডা. সুযত পাল। তিনি বলেন, আর্থিকভাবে দুর্বল রোগীদের ভরসাস্থল এই হাসপাতাল। সীমিত জনবল ও কম সুযোগ-সুবিধা নিয়ে এখানকার চিকিৎসক-নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা আন্তরিকভাবে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিদিন অন্তত ৩০ জন রোগী এখান থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছেন। এটা কম পাওয়া নয়। তবে সংক্রমণ ঠেকাতে মাস্ক পরা এবং গণ টিকাদানে জোর দিতে হবে। এ বিষয়ে গ্রামাঞ্চলে সচেতনতা বাড়াতে জোর দেন তিনি। – আজাদী প্রতিবেদন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!