Home | দেশ-বিদেশের সংবাদ | এশিয়ার ‘আয়রন লেডি’ শেখ হাসিনা: দ্য ইকোনমিস্ট

এশিয়ার ‘আয়রন লেডি’ শেখ হাসিনা: দ্য ইকোনমিস্ট

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘসময় ক্ষমতায় থাকা নারী সরকারপ্রধান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এমনকি নারী ও পুরুষ সরকারপ্রধানদের মধ্যেও তিনি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্যদের একজন। দুই দশক ধরে ক্ষমতায় থাকা বাংলাদেশের এই সরকারপ্রধান ১৭ কোটি মানুষের দেশের দারিদ্র্য বিমোচনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তার ক্ষমতার মেয়াদের বেশিরভাগ সময়ে দেশের গড় বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশ রয়েছে।

৭৫ বছর বয়সী প্রধানমন্ত্রী তার দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সবমিলিয়ে মোট চারবার ক্ষমতাসীন হয়েছে আওয়ামী লীগ। এর মধ্যে তার নেতৃত্বেই পরপর তিনটি নির্বাচনে জয়লাভ করেছে দলটি। যা ইন্দিরা গান্ধী বা মার্গারেট থ্যাচারের ক্ষমতার চেয়েও বেশি।

আগামী বছরের শুরুর দিকে বাংলাদেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। ওই নির্বাচনেও তিনি জয়ী হবেন বলে আশা করছেন। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নর্দার্ন ভার্জিনিয়ার হোটেল স্যুটে তার সাক্ষাৎকার নিয়েছে ব্রিটেনের বিখ্যাত সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট।

সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ নিয়ে তার স্বপ্ন ও উচ্চাশার বিষয়ে জানতে চেয়েছিল ব্রিটিশ এই সাময়িকী। বুধবার (২৪ মে) ‘এশিয়ার লৌহ মানবী শেখ হাসিনা’ শিরোনামে সেই সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছে দ্য ইকোনমিস্ট।

সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমি এই দেশকে একটি ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত দেশ করতে চাই।’ তারপর ভয়াবহ ইতিহাসের কথা উল্লেখ করে তিনি প্রশ্ন করেন, ‘আপনি কী ভাবতে পারেন, তারা আমার বাবাকে হত্যা করেছে?’

ইকোনমিস্ট বলছে, তার বাবা ও বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কাছ থেকে দেশটির রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা লাভের চার বছর পর ১৯৭৫ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হন। তার ১৭ জন ঘনিষ্ঠ আত্মীয় খুন হয়েছিলেন। সেই সময় শেখ হাসিনা ইউরোপে থাকায় বেঁচে যান।

‘তারা আমার ভাইকে, আমার মাকে, আরেক ভাইকে হত্যা করেছে— মাত্র দশ বছর বয়সী! আমার দুই বোন জামাই, আমার একমাত্র চাচা একজন প্রতিবন্ধী তাকেও হত্যা করেছে,’ বলেন প্রধানমন্ত্রী। এসব কথা বলার সময় তার চোখ অশ্রুতে ভিজে যায়।

তার উপদেষ্টারা এই সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী ইকোনমিস্টের প্রতিবেদককে সেই দীর্ঘকাল আগের ট্র্যাজেডি সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করতে বলেছিলেন। প্রতিবেদক সেটি না করলেও শেখ হাসিনা তা তুলে ধরেন।

কোনও রাজনীতিকই সমালোচনা পছন্দ করেন না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার বাংলাদেশের অন্যান্য সব সরকারের চেয়ে ব্যতিক্রম বলে ইঙ্গিত দেন। দুর্নীতির বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি তার বাবার স্থলাভিষিক্ত হওয়া সামরিক সরকারকে দায়ী করেন। একই সঙ্গে তার সরকারের সদস্যদের দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগে একটি প্রকল্পের অর্থায়ন থেকে সরে যাওয়ার ঘটনায় বিশ্বব্যাংককে অভিযুক্ত করেন। বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির যে অভিযোগ তুলেছিল, সেটির কোনও অস্তিত্ব নেই বলেও দাবি করেন তিনি।

দুর্নীতির বিষয়ে শেখ হাসিনা বলেন, হয়তো নিচের স্তরে আছে। তবে আজকাল তেমন নাই। তারা দুর্নীতির সাহস করলে আমি ব্যবস্থা নেব!

দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় আফগানিস্তানের পরই আছে বাংলাদেশ। তালেবানের উত্থানে এই অঞ্চলে এখন সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ আফগানিস্তান। শেখ হাসিনা ২০০৮ সালে পুনর্নির্বাচিত হওয়ার আগে আওয়ামী লীগ এবং খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) মধ্যে বারবার ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে। বর্তমানে খালেদা জিয়া গৃহবন্দী রয়েছেন। তার দলের কর্মী-সমর্থকরাও ভীত।

আগামী নির্বাচন বিএনপিকে ফেরার পথ দেখাবে কি না, সেটি পরিষ্কার নয়। যদিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি সুষ্ঠু ভোটের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলে দাবি করেছেন। তিনি বলেছেন, নির্বাচনে কেবল ‘প্রকৃত রাজনৈতিক দলকেই’ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অনুমতি দেওয়া উচিত এবং তার বিরোধীরা নির্বাচনী মানদণ্ড পূরণ করতে পারছে না।

তিনি অর্ধশতাব্দী আগে সেনাশাসনের অধীনে গঠিত বিএনপিকে ‘একজন সামরিক শাসক কর্তৃক অবৈধভাবে গঠিত’ রাজনৈতিক দল বলে অভিযোগ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী অভিযোগ করে বলেন, পাকিস্তানের সাবেক মিত্র দেশের সবচেয়ে বড় একটি ইসলামি দল; যাদের প্রায় সবাই যুদ্ধাপরাধী। আমাদের বক্তব্য হল, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ছাড়া এমন কোনও দল নেই, যারা সত্যিই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে।

ইকোনমিস্ট লিখেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কঠোর কব্জায় থাকার কারণে বাংলাদেশ সম্ভবত কিছুক্ষেত্রে উপকৃতও হচ্ছে। তবে তা বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার স্পষ্টতই খুব বেশি বাড়ায়নি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় আসার আগেই এই প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধি পেয়েছিল। পূর্বের বিদ্যমান বিভিন্ন অবকাঠামো ও অন্যান্য উপাদানের কল্যাণে তা হয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো পণ্য: যেমন দেশের পোশাক শিল্প এবং অভিজাত এনজিওগুলোর সরবরাহ করা সেবা। তারপরও তিনি দেশের অবকাঠামো বিনিয়োগসহ বিভিন্ন নীতিমালা তৈরি করেছেন; যা প্রবৃদ্ধির গতি বজায় রাখতে সহায়তা করেছে।

তবে বাংলাদেশের আয় কমে গেছে। পোশাকের ওপর অত্যধিক নির্ভরশীল বাংলাদেশকে নতুন রপ্তানির বিকাশ ঘটানো দরকার। আর
এর আগে এই বাস্তবতা দেশটির সরকার খুব কমই মোকাবিলা করছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশ হস্তশিল্প ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের বিকাশের দিকে নজর দিচ্ছে। তবে এটি এক অপর্যাপ্ত সমাধান বলে লিখেছে ইকোনমিস্ট।

ব্রিটিশ এই সাময়িকী বলছে, বাংলাদেশের গণতন্ত্র রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র হয়তো একসময় শেখ হাসিনাকে সতর্ক করেছিল। এখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান উদ্বেগ বাংলাদেশে চীনের স্থান করে নেওয়া। বাংলাদেশের সরকার বিনিয়োগের জন্য চীনকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত সম্পর্ক রয়েছে শেখ হাসিনার। তারাও একই দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই তিন শক্তির সাথে সম্পর্ক ঢেলে সাজাতে পারদর্শী বলে মনে হয়। বাস্তববাদী হওয়ায় এটি তার একটি সফলতা।

শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমেরিকা এবং চীনের সম্পর্ক তাদের নিজেদের ব্যাপার। আমি কেন সেখানে নাক গলাবো?’ এরপর আমেরিকার সমালোচনা করেন তিনি। কারণ এই দেশটি এক সময় খালেদা জিয়ার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিল। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তারা বলে, তারা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র… কিন্তু আমাদের দেশে তারা এর চর্চা করে না। কেন তারা আমাকে সমর্থন করে না?’

ইকোনমিস্ট লিখেছে, শেখ হাসিনার দীর্ঘ রাজনৈতিক ক্যারিয়ার এক সাহসিকতার গল্প। এর মধ্যে কিছু তার নীতিগত সাফল্য, যা তিনি দাবি করতে পারেন।

ব্রিটিশ এই সাময়িকী বলছে, শেখ হাসিনার সরকারের সর্বশেষ পরিকল্পনার শিরোনাম হল ভিশন-২০৪১। তবে তিনি এটি দেখতে পারবেন না বলে স্বীকার করেছেন। ক্ষমতায় তৃতীয় দশক পেরিয়ে গেলেও উত্তরাধিকার পরিকল্পনা তার অ্যাজেন্ডায় নেই বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘কারণ আমি যদি না থাকি… তাহলে কে ক্ষমতায় আসবে, তা আমি জানি না।’

• দ্য ইকোনমিস্টকে দেওয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার অবলম্বনে। ঈষৎ সংক্ষেপিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!