ব্রেকিং নিউজ
Home | দেশ-বিদেশের সংবাদ | এক বছর ধরে বাক্সবন্দি সোয়া দুই কোটি টাকার মেশিন

এক বছর ধরে বাক্সবন্দি সোয়া দুই কোটি টাকার মেশিন

নিউজ ডেক্স : হৃদরোগ বিভাগের জন্য একটি অত্যাধুনিক ইন্ট্রাভাসকুলার আলট্রাসাউন্ড সিস্টেম (আইভাস) মেশিন ক্রয়ে টেন্ডার পরবর্তী কার্যাদেশ দিয়েছিল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। হার্টে রিং পরানোর প্রয়োজনীয়তা যাচাইয়ের পাশাপাশি সঠিক ভাবে রিং বসলো কী না, তা খুব সহজেই যাচাই করা যায় অত্যাধুনিক এ যন্ত্রে। ঢাকার মেসার্স মেডি গ্রাফিক ট্রেডিং লি. নামের এক প্রতিষ্ঠান মেশিনটি ক্রয়ে কার্যাদেশ পায়। কার্যাদেশ প্রাপ্তির পর তারা মেশিনটি সরবরাহও করে।

তবে শিপমেন্ট সংক্রান্ত জটিলতায় সার্ভে কমিটির পক্ষ থেকে মেশিনটি গ্রহণে আপত্তি আসে। সে-ই আপত্তিতে প্রায় এক বছর ধরে বাক্সবন্দি প্রায় সোয়া দুই কোটি টাকার এ মেশিন। গত বছরের মে মাস থেকে হৃদরোগ বিভাগের ক্যাথল্যাব কক্ষে মেশিনটি পড়ে আছে। প্রায় বছর খানেক ধরে মেশিনটি বাক্সবন্দি থাকার তথ্য নিশ্চিত করেছেন হৃদরোগ বিভাগের প্রধান ডা. আশীষ দে।

প্রস্তুতকারী দেশ থেকে শিপমেন্ট না হওয়ায় সার্ভে কমিটি মেশিনটি গ্রহণে আপত্তি জানিয়েছিল উল্লেখ করে ডা. আশীষ দে বলেন, আপত্তি থাকায় বিধি মোতাবেক মেশিনটি গ্রহণের সুযোগ ছিল না। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানও মেশিনটি ফিরিয়ে নেয়নি। যার কারণে দীর্ঘ দিন ধরে মেশিনটি পড়ে আছে। এদিকে, মেশিনটির বিষয়ে করণীয় জানতে মন্ত্রণালয়ে কয়েক দফা চিঠি চালাচালিও করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এখনো পর্যন্ত মেশিনটির বিষয়ে চূড়ান্ত কোনো সুরাহা হয়নি।

সর্বশেষ মেশিনটির বিষয়ে আপত্তি সংক্রান্ত নিজেদের মতামত পুনরায় মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর কথা জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এ তথ্য নিশ্চিত করে চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান বলেন, যেহেতু সার্ভে কমিটি কনভিন্সড না, সেহেতু আমাদের মতামত পুনরায় মন্ত্রণালয়ে পাঠাবো। মন্ত্রণালয় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।

সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, অত্যাধুনিক এ মেশিনের দাম দেড় কোটি টাকার কিছু কম-বেশি। এই আইভাস মেশিনের সাথে আনুষঙ্গিক হিসেবে ফ্রেকশনাল ফ্লু রিজার্ভ (এফএফআর) নামে আরো একটি মেশিন রয়েছে। এর দামও অর্ধ লাখের কম নয়। সবমিলিয়ে মেশিনটির দাম প্রায় সোয়া ২ কোটি টাকা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কার্যাদেশের চুক্তি অনুযায়ী- আমেরিকার বিখ্যাত চিকিৎসা সরঞ্জাম প্রস্তুতকারী ‘বোস্টন সায়েন্টিফিক’ ব্র্যান্ডের ইন্ট্রাভাসকুলার আলট্রাসাউন্ড সিস্টেম (আইভাস) মেশিন সরবরাহ করার কথা। মেশিনটির প্রস্তুতকারী দেশ আমেরিকা। সে হিসেবে মেশিনটি আমেরিকা থেকেই শিপমেন্ট হওয়ার কথা। কিন্তু সরবরাহ করা মেশিনটির প্রস্তুতকারী দেশ হিসেবে আমেরিকা ও ব্র্যান্ড ঠিক থাকলেও মেশিনটি শিপমেন্ট হয়েছে নেদারল্যান্ড থেকে। যা নিয়ে সার্ভে কমিটির পক্ষ থেকে আপত্তি উঠে। যদিও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের দাবি, মেশিনটি প্রথমে আমেরিকা থেকে নেদারল্যান্ড নিয়ে যাওয়া হয়। পরে নেদারল্যান্ড থেকেই শিপমেন্ট হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বিষয়টি খতিয়ে দেখে এর সত্যতাও পেয়েছেন। তবে নেদারল্যান্ডে মাঝখানে দুই বছরের মতো সময় মেশিনটি কোথায় ছিল তার হদিস পায়নি সার্ভে কমিটি ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এ তথ্য নিশ্চিত করে হাসপাতালের বর্তমান পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান জানান, প্রস্তুতকারী দেশ এবং ব্র্যান্ড ঠিক থাকলেও মাঝখানে প্রায় দুই বছর মেশিনটি কোথায় ছিল তার সুস্পষ্ট তথ্য নেই। যার কারণে সার্ভে কমিটির পক্ষ থেকে আপত্তি উঠে। এ সব কারণেই সরবরাহ করা মেশিনটি গ্রহণ করা যায়নি।

সার্ভে কমিটিতে হাসপাতালের তৎকালীন পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম হুমায়ুন কবীর, হৃদরোগ বিভাগের তৎকালীন বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. প্রবীর কুমার দাশ, মেডিসিন বিভাগের ডা. সৌমেন বড়ুয়া ছাড়াও ন্যাশনাল ইলেকট্রো- মেডিকেল ইকুইপমেন্ট মেনটেন্যান্স ওয়ার্কশপ এন্ড ট্রেনিং সেন্টার (নিমিউ)’র প্রতিনিধি ছিলেন।

হৃদরোগ বিভাগের বর্তমান প্রধান ডা. আশীষ দে বলছেন, মেশিনটি আমেরিকার তৈরি। এটাতে সন্দেহ নেই। কারণ, এ মেশিন আমেরিকা ছাড়া আর কোথাও তৈরি হয় না। মেশিন ঠিক আছে। তবে শিপমেন্ট সংক্রান্ত ত্রুটিতে মেশিনটি গ্রহণে আপত্তি উঠেছিল। যার কারণে মেশিনটি রিসিভ করা যায়নি।

অন্যদিকে, যে অর্থবছরে মেশিনটি ক্রয়ের কার্যাদেশ দেয়া হয়েছিল, সে অর্থ বছরের অবশিষ্ট অর্থ এর মাঝে মন্ত্রণালয়ে ফেরত চলে গেছে। অর্থাৎ মেশিনটি বাবদ যে বরাদ্দ ছিল, তা ফেরত গেছে। তাই চাইলেও এ মেশিন এখন হাসপাতালের পক্ষে কেনা সম্ভব না বলে জানান হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান। তিনি বলেন, আমরা মতামতসহ সার্বিক অবস্থা মন্ত্রণালয়কে জানাবো। মন্ত্রণালয় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।

আইভাসের ব্যবহার : চিকিৎসকরা বলছেন- রোগীর হার্টে ব্লক দেখা দিলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে রিং পরানোর (স্ট্যান্ট বসানোর) প্রয়োজন পড়ে। ক্ষেত্র বিশেষে ওষুধ দিয়েও এর চিকিৎসা করা হয়। যদিও ব্লকের সাইজ ও সংখ্যার উপর সেটি নির্ভর করে। অত্যাধুনিক এই আইভাস মেশিনের মাধ্যমে রোগীর হার্টের অভ্যন্তরে রক্তনালীর আলট্রসনোগ্রাম করা যায়। যা রক্তনালীর পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে আনে। এতে করে ব্লক দেখা দিলেও হার্টে রিং পরানোর প্রয়োজনীয়তা আছে কী না, প্রয়োজন থাকলেও কোন সাইজের রিং পরাতে হবে, সেটি সহজে যাচাই করা যাবে। এমন তথ্য দিয়ে হৃদরোগ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. রিজোয়ান রেহান আজাদীকে বলেন, শুধু রিং পরানোর আগে নয়। রিং বসানোর পরও সেটি সঠিকভাবে ও যথাপোযুক্ত স্থানে বসলো কী না, তাও যাচাই করা যায় এ মেশিনে। মোটকথা রিং পরানোর আগে যেমন কাজ দেবে, রিং পরানোর পরও মেশিনটি কাজ দেবে।

হৃদরোগ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. প্রবীর কুমার দাশের আন্তরিক প্রচেষ্টায় হৃদরোগ বিভাগে অত্যাধুনিক এ মেশিন যুক্ত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। তিনি দায়িত্বে থাকাকালীন মেশিনটি যুক্ত করে সেবা চালুর আশা করেছিলেন। পরে ২০২১ সালের জুন মাসে অধ্যাপক ডা. প্রবীর কুমার দাশ অবসরোত্তর ছুটিতে যান। অত্যাধুনিক এই মেশিন সংযোজনের মাধ্যমে হৃদরোগের চিকিৎসায় চমেক হাসপাতাল আরো এক ধাপ এগিয়ে যাবে বলে ওই সময় জানিয়েছিলেন অধ্যাপক ডা. প্রবীর কুমার দাশ। তিনি বলেন, ব্লক দেখা দিলে অনেক ক্ষেত্রে রিং পরানোর প্রয়োজন হয়। আবার রিং না পরিয়ে শুধু ওষুধ সেবনের মধ্য দিয়েও এই ব্লক দূর করা যায়। সেটি রক্তনালীর ফ্লু’র উপর নির্ভর করে। রিং না পরিয়ে শুধু ওষুধ দিয়ে ব্লক দূর করা সম্ভব কী না, তা এই মেশিনে আলট্রাসনোগ্রামের মাধ্যমে সহজে জানা যাবে। এটি রোগীদের পাশাপাশি চিকিৎসকদের জন্যও বড় রকমের সুবিধা।

চট্টগ্রামের বেসরকারি এক বা দুটি হাসপাতালে হয়তো এ সুবিধা আছে। কিন্তু আর্থিক অসঙ্গতির কারণে সবার দ্বারা বেসরকারি হাসপাতালে এ চিকিৎসা নেয়া সম্ভবপর নয়। সরকারি পর্যায়ে চমেক হাসপাতালে এ মেশিন সংযোজন হলে তা গরীব রোগীদের জন্য আর্শিবাদ হতো বলে মনে করেন অধ্যাপক ডা. প্রবীর কুমার দাশ। -আজাদী প্রতিবেদন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!