ব্রেকিং নিউজ
Home | শিক্ষাঙ্গন | শিশুবান্ধব পাঠশালা : সৃজনশীলতায় বিকশিত হচ্ছে রোহিঙ্গা শিশুরা

শিশুবান্ধব পাঠশালা : সৃজনশীলতায় বিকশিত হচ্ছে রোহিঙ্গা শিশুরা

02j-753x540-753x540
কায়সার হামিদ মানিক, উখিয়া : একদল রোহিঙ্গা শিশু কখনো ছবি আঁকছে, কখনো রং করছে, কখনো ছড়ার তালে তালে নাচ। পড়া মুখস্থ করার তাড়া নেই। নেই শিক্ষকের চোখ রাঙানি। শিশুরা হাসছে, খেলছে, আনন্দ করছে আবার এর মধ্য দিয়েই শিখছে অনেক কিছু। তারা গল্প শুনে, কাঁচি, কাগজ ও আটা দিয়ে ফুল-পাখিসহ নানা ধরনের জিনিস বানায়। উখিয়ায় ‘বলপ্রয়োগে বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিকদের’ অস্থায়ী আশ্রয় শিবিরে বেসরকারি সংস্থার ‘মুক্তি’র উদ্যোগে গড়ে উঠেছে এমন বেশ কয়েকটি শিশুবান্ধব পাঠশালা। জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক তহবিলের (ইউনিসেফ) এসব পাঠশালা গড়ে তোলা হয়েছে।
সরেজমিনে গতকাল রবিবার উখিয়ার বালুখালী আশ্রয় শিবিরে মুক্তির পাঠশালা ‘ভোরের পাখি-১’ এ গেলে কথা হয় অনেক রোহিঙ্গার শিশুর সাথে। তাদেরই একজন মো: রফিক (৭)। মিয়ানমারের মংডুর ঢেকিবনিয়া থেকে আনা এ শিশুটি ‘আরলি লানিং’ শাখার শিক্ষার্থী। রফিক জানায়, এই পাঠশালায় এসে ১৮ টি বার্মিজ ছড়া ও ১০টি ইংরেজী ছড়া শিখেছে। শিক্ষকরা তাদেরকে পড়ালেখা শেখানোর পাশাপাশি গল্প শোনান। ছবি আঁকা শেখান। কাগজ দিয়ে কিভাবে ফুল, প্রজাপতি, পাখি, নৌকা বানাতে হয়Ñতাও শেখানো হয়। মিয়ানমারে তারা কখনো এসব শেখার সুযোগ পায়নি। এখানে ছবি আঁকতে তার খুব ভাল লাগে। গল্প শুনতে, ছড়ার তালে তালে মৃদু নাচতে ভাল লাগে। শিক্ষকরা তাদের বকা-ঝকা করেননা। তারা খুব ¯েœহ করেন।
‘আরলি লার্নিং’ শাখার আরেক শিক্ষার্থী সেহেরা (৭)। মংডুর নাপ্পুরা এলাকার তাদের বাড়ি। তার পিতার নাম মো: ইউনুস। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে তার অবস্থান দ্বিতীয়। এ পাঠশালায় তার বড় ভাই এহেসানও পড়ে। সেহেরা জানায়, পাঠশালায় তাকে ব্যায়াম শেখানো হয়েছে। সে মাছ, আপেল, আম, নৌকা, ফুল, মানুষ ও গাছের ছবি আঁকতে পারে। পড়তে পারে, খেলতে পারে। তাই এখানে তার খুব ভাল লাগে। তার প্রিয় খেলা দড়ি নিয়ে লাফানো (স্কিপিং)। রাখাইন রাজ্যের স্থানীয় ভাষায় এই খেলাকে তারা ‘ফাল্দানি খেলা’ বলে।
কথা হয় সেহেরার ভাই এহেসানের সাথেও। সে জানায়, বালুখালীর বি-৯ ব্লকে একটি ত্রিপলের ছাউনি দেওয়া ছোট ঘরে তারা এখন বসবাস করছে। সেখানে খুব গরম। সেই তুলনায় পাঠশালার পরিবেশ বেশ আরামদায়ক। গরম কম, বাতাসও পাওয়া যায়। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডুর নাপ্পুরা গ্রামে তাদের মাটির ঘর ছিল। গোলপাতার ছাউনি দেওয়া ওই ঘরে খুব ঠান্ডা পরিবেশ।
‘ভোরের পাখি-১’ এর শিক্ষিকা জান্নাতুল ফেরদৌসের বাড়ি চকরিয়া উপজেলায়। তিনি রোহিঙ্গা শিশুদের ইংরেজী ও অংশ শেখান। আরেক শিক্ষিকারর নাম দিলরুবা। মিয়ানমারে জন্ম নেওয়া এ নারী শিশুদের বার্মিজ ভাষায় পড়ান।
পাঠদানের বিষয়ে জানই চাইলে শিক্ষিকা জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, ‘আমরা চাই শিশুরা একটু আনন্দ নিয়ে পড়ালেখা শিখুক। এখানে সেই পরিবেশটাই আমরা তাদের দেওয়ার চেষ্টা করি। পড়ানোর পাশাপাশি আমরা তাদের ব্যায়াম করাই, ছবি আঁকতে দিই। কাগজ, কলম ও রং পেন্সিল দিয়ে ছবি আঁকা শেখাই। এতে বেশ সাড়া পাওয়া যায়। সৃজনশীল কাজগুলো শেখার ক্ষেত্রে এসব শিশু খুবই মনোযোগ থাকে। তারা খুব সহজে এসব শিখে নেয়। তারা কাগজ দিয়ে ফুল, ফল, নৌকা, ঘুড়ি, ঘরসহ নানা জিনিস বানায়। আমরা তাদের জীবনঘনিষ্ঠ গল্প বলি। এতে তাদের মেধার বিকাশ হচ্ছে। তারা গড়ে উঠছে সুস্থ মন ও বোধ নিয়ে।’
পাশেই মুক্তির আরেক পাঠশালা ‘ভোরের পাখি-২’। সেখানে সুন্দর ফুল আঁকতে পারে রুবি (১১)। সে গ্রেড ওয়ানের শিক্ষার্থী। তার আঁকা কিছু ফুলের ছবি পাঠশালার দেওয়ালে টানিয়ে দেওয়া হয়েছে। সে জানায়, এখানে শিক্ষকরা তাদের পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা থাকার বিষয়ে শিখিয়েছেন। তারা এখন নিয়মিত নখ কাটে, নিয়ম মেনে হাত-মুখ ধোয় এবং স্বাস্থ্য সম্মত পায়খানা ব্যবহার করে। এটা সে তার পরিবারের অন্য সদস্যদেরও শিখিয়েছে।
এ পাঠশালার গ্রেড ওয়ানের শিক্ষার্থী আফিয়া (১১)। সে জানায়, পড়ার পাশাপাশি সে এখানে খেলতে পারে। তাই পাঠশালায় থাকতেই তার বেশি ভাল লাগে। খোলামেলা পরিবেশে অন্য শিশুদের সাথে আনন্দময় সময় কাটাতে পেরে সে খুব খুশি।
বালুখালীতে বেসরকারি সংস্থার ‘মুক্তি’র উদ্যোগে গড়ে তোলা ‘নতুন কুড়ি-১’, ‘নতুন কুড়ি-২’, ‘নতুন কুড়ি-৩’ এবং ‘নতুন কুড়ি-৪’ এ গিয়ে প্রায় একই চিত্র চোখে পড়ে। পাঠশালার পরিবেশ খুবই সাজানো-গোছানো। চারপাশের বাঁশের বেড়ার দেওয়ালে রোহিঙ্গা শিশুদের হাতে আঁকা নানা ধরনের ছবি। ফুল, পাখি, গাছ, নদী, পাহাড়, প্রকৃতি। মাথার ওপরে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে বার্মিজ ও ইংরেজী বর্ণমালা, ঘুড়ি ও ফুল-পাখির ছবি। নিচে দেওয়ালের সাথে সাঁটিয়ে দেওয়া হয়েছে বার্মিজ ও ইংরেজী ছড়া এবং বর্ণমালার ফ্লিপ চার্ট, মানবদেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, ফল, মাছ, পাখি ও প্রাণীর পরিচিতি সম্বলিত অনেকগুলো ফ্লিপচার্ট।
‘মুক্তি’র পয়েন্ট পার্সন (শিক্ষা) শওকত আলী বলেন, ‘প্রথম দিকে রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য গড়ে তোলা শিক্ষা কেন্দ্রগুলোর অবকাঠামোতে কিছুটা স্থায়ী রূপ ছিল। ২০১৭ সালে ৫টি পাঠশালা তৈরী করা হয় ফুল ওয়াল দিয়ে, ২০টি তৈরী করা হয় হাফ ওয়াল দিয়ে। সর্বশেষ সরকারের নির্দেশনা এবং সাহায্য সংস্থার নকশা অনুসারে বাঁশের বেড়া দিয়ে ২৫টি পাঠশালার সম্পূর্ণ অবকাঠামো তৈরী করা হয়। পরে ২০১৭ সালের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের এ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ৬৭টি পাঠশালা তৈরী করা হয়েছে সম্পূর্ণ বাঁশ ব্যবহার করে। আরও ৩৩টি পাঠশালা তৈরী করে দিয়েছে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম)। সদ্য নির্মিত পাঠশালাগুলোর উপরে রয়েছে ছনের ছাউনি। যাতে ভেতরের পরিবেশটা ঠান্ডা থাকে এবং শিশু শিক্ষার্থীরা স্বস্তি পায়।’
মুক্তির প্রধান নির্বাহী বিমল চন্দ্র দে সরকার বলেন, ‘পাঠশালাগুলোতে বার্মিজ ও ইংরেজী ভাষায় পড়ানোর পাশাপাশি শিশুদের নানা ধরনের সৃজনশীল কাজের সাথে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে। এই কাজগুলো তাদের জন্য আলাদা বিনোদনের ক্ষেত্র তৈরী করেছে। এতে তাদের মানসিক বিকাশ হচ্ছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে তাদের সামাজিকতার মনোভাব। ব্যায়ামের মাধ্যমে তাদের শরীর গঠনের বিষয়টিও নিশ্চিত হচ্ছে। আমরা তাদের জন্য সম্পূর্ণ আনন্দদায়ক পরিবেশ দেওয়ার চেষ্টা করেছি। সেই জন্যই পাঠশালাগুলো শিশুবান্ধব করে গড়ে তোলা হয়েছে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!