ব্রেকিং নিউজ
Home | দেশ-বিদেশের সংবাদ | মাইলেজ জটিলতা : ট্রেনের সিডিউল বিপর্যয়

মাইলেজ জটিলতা : ট্রেনের সিডিউল বিপর্যয়

নিউজ ডেক্স : রেলের রানিং স্টাফদের (লোকোমাস্টার, গার্ড এবং টিটিই) মাইলেজ জটিলতার বিষয়টি নিরসন না হওয়ায় গত ২৫ জানুয়ারি হতে ৮ ঘণ্টার বেশি ডিউটি করছেন না ট্রেন চালকরা। ফলে একেরপর এক ট্রেনের সিডিউল বিপর্যয় ঘটছে। মাইলেজ নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা আগামীকাল রোববারের মধ্যে সমাধান না হলে সোমবার থেকে ট্রেন চলাচলে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতিতে অটল রয়েছেন চালকরা।

ট্রেনে আট ঘণ্টার বেশি দায়িত্ব পালনের জন্য লোকোমাস্টার, গার্ড ও টিটিইরা আগে অতিরিক্ত আর্থিক সুবিধা পেতেন, যা রেলওয়ের ভাষায় মাইলেজ। সম্প্রতি রাষ্ট্রের বেসামরিক কর্মীদের মূল বেতনের অতিরিক্ত অর্থ পাওয়ার বিধান নেই উল্লেখ করে অর্থ মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপন জারি করে। এতে রেলের রানিং স্টাফদের মাইলেজ সুবিধা বাতিল করা হয়। এখন এ মাইলেজ সুবিধা চালুর জন্যই আন্দোলন করছেন স্টাফরা। এই আন্দোলনের অংশ হিসেবে গত ২৫ জানুয়ারি থেকে চালকরা ৮ ঘণ্টার বেশি ডিউটি করছেন না। ফলে চালক সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। এমনিতে সারাদেশে ট্রেনের চালক সংকট দীর্ঘদিনের। এখন আন্দোলনের কারণে একেরপর পর এক বাতিল হচ্ছে ট্রেনের সিডিউল। স্টাফদের আন্দোলনের জেরে এবার বাতিল হয়েছে চট্টগ্রাম গুডস পোর্ট ইয়ার্ডের (সিজিপিওয়াই) একটি গুডস ট্রেনের যাত্রা। গতকাল শুক্রবার লোকোমাস্টার ও সহকারী লোকোমাস্টার সংকটের মুখে সিজিপিওয়াই ৬০৩ আপ ট্রেনের যাত্রা বাতিল করা হয়। চট্টগ্রামের সিজিপিওয়াই থেকে ট্রেনটি ঢাকার কমলাপুর আইসিডিতে (ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপো) যাওয়ার কথা। এ ছাড়া আন্দোলনের কারণে ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়গামী ৩ জোড়া শাটল ট্রেন, চট্টগ্রাম–নাজিরহাটগামী এক জোড়া ডেমু ট্রেন ও চট্টগ্রাম–দোহাজারীগামী একটি ট্রেনের যাত্রা বাতিল করা হয়েছে।

মাইলেজ ভাতা আগের নিয়মে বহাল রাখার দাবিতে গত কয়েক মাস ধরে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করে আসছেন রেলের রানিং স্টাফরা। ইতোমধ্যে স্টাফরা তাদের মাইলেজ জটিলতার বিষয়টি সুরাহার জন্য রেলমন্ত্রী, রেলওয়ের মহাপরিচালক, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন। বৈঠকও হয়েছে রানিং স্টাফদের সংগঠনের নেতাদের সাথে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো ঘোষণা আসেনি। এদিকে রানিং স্টাফদের অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতির বিষয়টি রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের জিএম, প্রধান যান্ত্রিক প্রকৌশলী, ডিআরএম, পরিবহন কর্মকর্তা ও বাণিজ্যিক কর্মকর্তাসহ ঊর্র্ধ্বতন সকল কর্মকর্তাদেরকেও জানিয়ে দিয়েছেন বলে জানান বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক–কর্মচারী সমিতি যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. মুজিবুর রহমান ভূইয়া।

তিনি গতকাল বলেন, মাইলেজ নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা দূর না করলে আগামী সোমবার থেকে ট্রেন চলাচলে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতিতে আমরা অটল আছি। অর্থমন্ত্রণায়ের প্রজ্ঞাপন বাতিল না হলে সারাদেশে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে। যেভাবে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে, তা বন্ধ করা সম্ভব হবে না।

মো. মুজিবুর রহমান ভূইয়া জানান, রেলওয়ে স্টাবলিশমেন্ট কোড ভলিউম–১–এর চ্যাপ্টার–৫ এবং লোকোমোটিভ অ্যান্ড রানিং শেড ম্যানুয়াল জিআই চ্যাপ্টার–১২ অনুযায়ী–১০০ মাইল কিংবা ৮ ঘণ্টার বেশি ট্রেন চালালে একজন রানিং স্টাফ মাইলেজ (রানিং ভাতা) প্রাপ্য হবেন। অতিরিক্ত ট্রেন চালালে প্রতি ঘণ্টা ও মাইল অনুযায়ী একদিনের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ মাইলেজ হিসাবে তিনি পাবেন। প্রতি মাসে যেখানে রানিং স্টাফরা ১১ হাজার মাইলের মাইলেজ ভাতা পেতেন সেখানে সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে ‘আইবাস প্লাস প্লাস সিস্টেমে’ তাদের মাইলেজ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে তিন হাজার মাইলের বেশি দেওয়া যাবে না বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তিন হাজার মাইলের বেশি ট্রেন চালালেও তারা বেশি মাইলের জন্য কোনো ভাতা পাবেন না।

তিনি বলেন, ১৯৯৮ সালে প্রধানমন্ত্রীর এক অনুশাসনে রেলের রানিং স্টাফদের মাইলেজ (রেলের আইন অনুযায়ী) পাওয়ার কথা বলা রয়েছে। আমাদের পক্ষে আদালতের রায়ও আছে। কিন্তু, সমপ্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে রেলের মাইলেজ সুবিধা নতুন করে নির্ধারিত করা হয়েছে। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী বেসিকের সঙ্গে ৭৫ শতাংশ টাকা যোগ হবে না। এটি রেলওয়ে আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এটি বাস্তবায়ন করা হলে মাইলেজ সুবিধা থেকে চালক–গার্ডরা বঞ্চিত হবেন। অর্থমন্ত্রণালয়ের এই প্রজ্ঞাপনে ১৬২ বছরের নিয়ম–নীতি ভঙ্গ হয়েছে। রেলে চালক ও গার্ড সংকট চরমে উঠেছে। একনাগাড়ে একজন চালক ও গার্ড ১৭ থেকে ১৯ ঘণ্টা পর্যন্ত ট্রেন চালাচ্ছেন। ৮ ঘণ্টার বেশি চালানোর পর মাইলেজ (মাইল প্রতি) হিসাবে তারা টাকা পান। রেলে চালক সংকট থাকায় তারা এ সুবিধা পান। ১৯৬২ জন ট্রেন চালকের স্থলে বর্তমানে ১০১৮ জন রয়েছেন। ৯৮৮ চালকের অভাব রয়েছে। আর ট্রেনে অর্ধেকেরও কম গার্ড রয়েছেন।

রেলওয়ে আইনের ১৬৮৫/১০৮৫ বিধিতে বলা হয়েছে–ট্রেন চালক, গার্ড ও ট্রেন টিকিট পরীক্ষকরা (টিটিই) হলেন রানিং স্টাফ। তারা নির্ধারিত ডিউটির পাশাপাশি কর্মরত অবস্থায় যত দূরত্ব পর্যন্ত ট্রেন চালাবেন সে হিসাবে মাইল গুনে বাড়তি ভাতা পাবেন। রেলওয়ে আইনে সাপ্তাহিক বা সরকারি বন্ধের দিনে ডিউটি করলে হলিডে মাইলেজ প্রাপ্তির বিধানও রয়েছে তাদের।

কিন্তু সমপ্রতি ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফারের (ইএফটি) মাধ্যমে বেতন–ভাতা প্রদান প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্তিতে বিশেষ ভাতা সীমিত করা হয়েছে। যা কোনো অবস্থাতেই মেনে নিচ্ছেন না রানিং স্টাফরা। যেকোনো সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারী ডিউটি শেষে পরবর্তী ১৬ ঘণ্টা বিশ্রামে যেতে পারেন কিংবা পারিবারিক–সামাজিক কাজে সম্পৃক্ত হতে পারেন। কিন্তু রানিং স্টাফদের কেউই তা পারেন না। স্বাভাবিক সময়ে ট্রেন চালানোর পরও মানবসৃষ্ট ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঈদ–পূজার ছুটির সময় রানিং স্টাফদের ট্রেন নিয়ে ছুটতে হয়। তাদের কোনো ছুটি নেই। সেই বিবেচনায় ব্রিটিশ আমল থেকে রানিং স্টাফরা মাইলেজ পান। ১৬২ বছর আগে থেকে এ বিধান চলে আসছে। কিন্তু নতুন নিয়মে রেলওয়ে রানিং স্টাফদের এসব সুবিধা থাকছে না। এতে তারা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছেন। বিষয়টি আগামীকালের মধ্যে সমাধান না হলে সারাদেশে ট্রেন চলাচলে অচলাবস্থার সৃষ্টি হতে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে।

বিডিনিউজ জানায়, পূর্ব রেলের বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা বলেন, রানিং স্টাফরা ৮ ঘণ্টার বেশি কাজ না করায় নাজিরহাট রুটের ডেমু এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি শাটলের যাত্রা বাতিল করা হয়েছে। তবে কোনো আন্তঃনগর ট্রেন চলাচল বিঘ্নিত হয়নি। সমস্যা সমাধানের বিষয়ে কী উদ্যোগ নেয়া হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতনরা বলতে পারবেন। পরবর্তীতে রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) সরদার সাহাদাত আলীর কাছে বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আজ (শুক্রবার) কোনো আলোচনা হয়নি। এছাড়া রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মো. হুমায়ুন কবীর ও পূর্ব রেলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) জাহাঙ্গীর হোসেনের মোবাইল ফোনে একাধিকবার চেষ্টা করলেও তারা ফোন ধরেননি। -আজাদী প্রতিবেদন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!