ব্রেকিং নিউজ
Home | শীর্ষ সংবাদ | নাকফুল

নাকফুল

67

ওমর ফারুক : হাজারী লেনে বাবার জন্য দুষ্প্রাপ্য ঔষধ কিনতে এসে সারি সারি স্বর্ণের দোকান দেখতে পাই। শুনেছিলাম হাজারী লেন হলো ঔষধের রাজ্য। দুনিয়ার তাবৎ ঔষধ কোথাও পাওয়া না গেলেও, এই হাজারী লেনে আসলে পাওয়া যায়। এখানে এসে ঔষধের পাশাপাশি স্বর্ণের রাজ্যও দেখতে পেলাম। কাঁচে ঘেরা সব স্বর্ণের দোকান। বাইরে থেকে সব দেখা যায়। চকচক করছে বাহারি রকমের স্বর্ণ। সূর্যের রশ্মির মতো চিক চিক করে বেরিয়ে আসছে স্বর্ণের সোনালী আভা। ‘অমল জুয়েলার্স’ নামের এক স্বর্ণের দোকানের সামনে বজ্রপাত পড়া মানুষের মতো দাঁড়িয়ে গেলাম। ভেতরে নানা বয়সী মহিলারা স্বর্ণ দেখছিল। দোকানের লোকেরা নানা ডিজাইনের স্বর্ণ দেখিয়ে চলছে তাদের। মাঝবয়সী এক মহিলা ছোট আয়না সামনে এনে নাক দেখছিল। নাকফুলে তাকে কেমন লাগছে তা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল হয়ত।

মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। মায়ের কোনো নাকফুল নেই। নাকফুল ছাড়া মায়ের নাক দেখতে আমরা ভাই-বোনেরা অভ্যস্ত। মায়ের নাকে ছিদ্র আছে কিন্তু সেখানে কিছু ছিলো না। অথচ পাড়ার চাচীদের নাকে নাকফুল ছিলো, কারো কারো আবার নাকে বোলাক ছিল, গলায় কারো কারো হারও ছিল। শুকনো পাতা জ্বালিয়ে গরমের দিনে ভাত রান্না করার সময় কখনো সখনো মায়ের নাকে একটা ফোঁটা ঘাম আবিস্কার করতাম। চিকচিক করতো। নাকফুল ভেবে ভুল করতাম। মানুষের মায়ের নাকফুলের চেয়ে ঢের সুন্দর লাগতো মায়ের নাকে পড়া ঘামকে।

মায়ের কানের দুলও ছিলো না। পাড়াতো চাচীরা বলতো, আহারে ভাবী! আপনার তো একটা নাকফুলও নাই। মা হেসে বলতেন, ছেলে-মেয়েরাই আমার নাকফুল, আমার কানের দুল। এসব সোনাদানা দিয়ে কি হবে? সন্তানেরা পড়াশোনা করে মানুষের মতো মানুষ হলেই তো আমার সৌন্দর্য বাড়বে। ওদের বাবা দিছিল, আমি বেইচা দিছি। এসব আমার ভালো লাগে না।

টিস্যু দিয়ে আর্দ্র হয়ে আসা চোখ মুছতে মুছতে অমল জুয়েলার্সে ঢুকে পড়লাম। থরে থরে সাজানো সব গলার হার, চেইন, নাকফুল, কানের দুল সহ আরো কতো কি? দোকানের একটা বিক্রেতা বেশ আগ্রহ নিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো, কি কিনবেন? কি দেখাবো? ভাবী আসেন নি? লজ্জায় ঢোঁক গিলে বললাম, আমার মায়ের জন্য একটা নাকফুল দেখান তো? ও নাকফুল দেখবেন বলে লোকটা ঐ দোকানের গোবেচারা টাইপের একজন বিক্রয় কর্মীকে ডাকলো। হয়তো কম দামী জিনিস চেয়েছি বলে লোকটা আমাকে গুরত্ব দেয়নি। মানুষ গুরুত্ব না দিলেও এখন আমার খারাপ লাগে না। প্রতিদিন টিউশনি করতে মানুষের বাড়ির কলিংবেল টিপতে হয়। নানা অজুহাতে ছাত্রদের মুখে শুনতে হয়, স্যার আজকে পড়বো না। দীর্ঘ জ্যাম পেরিয়ে টিউশনের বাসায় পৌঁছে তুচ্ছ কারণে ছাত্রের পড়বে না শুনতে হয়। গুরত্বহীনতা বুঝি এবং মেনে নিতেও শিখে গেছি।

লোকটার কথা ভুলে আমি নাকফুল দেখতে লাগলাম। ঘামের ফোঁটার মত একটা নাকফুল আমার বেশ পছন্দ হলো। সবাই ভাববে ঘাম অথচ সেটা স্বর্ণের ফোঁটা। দরদাম করে টাকা দেবার জন্য পকেটে হাত দিলে বুঝি টিউশনিতে পাওয়া খামটা গায়েব। শার্ট-প্যান্টের সব পকেটে খুঁজি। কোথাও নাই। অথচ স্পষ্ট মনে আছে হলুদ খামটা পকেটেই পুরেছিলাম।

মা মনি কুলিং কর্ণারে দই চিড়া খেতে খেতে রমিজের গল্পটা শুনে সত্যিই মনটা খারাপ হয়ে গেল।

লেখক : সহকারী শিক্ষা অফিসার, লোহাগাড়া উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!