ব্রেকিং নিউজ
Home | ব্রেকিং নিউজ | চুনতি অভয়ারণ্যে বিদ্যুৎ লাইন: বিপন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশ, হুমকিতে বন্যপ্রাণীর জীবন

চুনতি অভয়ারণ্যে বিদ্যুৎ লাইন: বিপন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশ, হুমকিতে বন্যপ্রাণীর জীবন

মোহাম্মদ মারুফ: বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইনের কারণে লোহাগাড়ার চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। দীর্ঘদিন ধরে নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে পরিচিত এই অভয়ারণ্যে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন যেন বন্যপ্রাণীর জীবন ও বাস্তুসংস্থানকে ঝুঁকির মুখে ফেলেছে। ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে বিপন্ন হচ্ছে অভয়ারণ্যের প্রাণীজগতের নিরাপত্তা ও টেকসই জীবনযাপন। এই পরিস্থিতি আগামী প্রজন্মের জন্য প্রকৃতি সংরক্ষণে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।

জানা যায়, চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য বাংলাদেশের একটি সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। এটি চুনতি অভয়ারণ্য নামেও পরিচিত। চুনতি অভয়ারণ্য চট্টগ্রামের লোহাগাড়া, বাঁশখালী, সাতকানিয়া উপজেলা ও কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার ৭ হাজার ৭৬৪ হেক্টর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। বনের সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও বিপন্ন বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য ১৯৮৬ সালে এই অভয়ারণ্য প্রতিষ্ঠা করা হয়। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে এশীয় বন্যহাতির যাতায়াতের একটি করিডোর হিসেবে এই অভয়ারণ্যের গুরুত্ব অপরিসীম। তবে ক্রমাবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ, নির্বিচারে গাছ কাটা, কৃষি জমিতে রূপান্তরের মাধ্যমে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থান ধ্বংস প্রভৃতি কারণে এই বনের অস্তিত্ব আজ হুমকির সম্মুখীন।

স্থানীয়রা জানান, চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, যেখানে প্রকৃতি ও প্রাণ একে অপরের পরিপূরক হয়ে টিকে আছে শতাব্দীর পর শতাব্দী। সেই নিসর্গে এখন বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের দখলদারিত্ব। গাছ কেটে, পাহাড়ের ভেতর দিয়ে যেভাবে বিদ্যুৎ লাইন বসানো হয়েছে তা শুধু বনকে নয়, এখানকার জীববৈচিত্র্যকেও মারাত্মক হুমকিতে ফেলছে। বনভূমির ভেতর দিয়ে ঝুলে থাকা হাই ভোল্টেজ লাইনে দুর্ঘটনায় মারা পড়ছে বন্যপ্রাণী। বনের নীরবতা ভেঙে গর্জে উঠছে যন্ত্রের শব্দ। অভয়ারণ্যে বিদ্যুতের নামে যে অদৃশ্য দুর্বৃত্তায়ন চলছে, তা এখনই না থামালে হারিয়ে যাবে বহু প্রজাতি, নষ্ট হবে প্রাকৃতিক ভারসাম্য।

গতকাল শুক্রবার অভয়ারণ্যের লুতু মিয়ার ঘোনা এলাকায় সরেজমিনে দেখা যায়, বনের গভীর ভেতর দিয়ে টানা হয়েছে বৈদ্যুতিক সঞ্চালন লাইন। এই লাইনের জন্য স্থাপনা করা হয়েছে একাধিক খুঁটি। বৈদ্যুতিক তারে নেই কোনো কাভার। কোথাও কোথাও গাছ কেটে ফাঁকা করা হয়েছে লাইনের পথ সুগম করতে। এতে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। লাইনের নিচে ও আশপাশে দেখা গেছে বন্যপ্রাণীর চলাচলের চিহ্ন। বনের নির্জনতায় খুঁটি বসানো ও তার টানার ফলে অনেক বন্যপ্রাণী নিরাপদ আশ্রয় থেকে ছিটকে পড়েছে। প্রাণীদের চলাচলের রাস্তাও বন্ধ হয়েছে বৈদ্যুতিক খুঁটি ও তারের কারণে। পরিবেশবাদীদের মতে অভয়ারণ্যের ভেতর দিয়ে এই ধরনের প্রকল্প পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের উপর দীর্ঘমেয়াদি বিরূপ প্রভাব ফেলবে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বনাঞ্চলে এ ধরনের কার্যক্রম আইনত নিষিদ্ধ এবং তা বন সংরক্ষণের উদ্দেশ্যের পরিপন্থী। এই বৈদ্যুতিক আগ্রাসন বন্ধ না হলে চুনতি অভয়ারণ্যের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাবে। বনের ভারসাম্য রক্ষা ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে অবিলম্বে বৈদ্যুতিক খুঁটিসহ সঞ্চালন লাইন উচ্ছেদের দাবি জানান।

চট্টগ্রাম পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি লোহাগাড়া জোনাল অফিসের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (ডিজিএম) মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম খান জানান, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে শতভাগ বিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের ভেতর বিদ্যুৎ লাইন স্থাপন করা হয়েছিল। ওই সময় অভয়ারণ্য কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনো ধরনের বাধা দেয়া হয়নি। অভয়ারণ্য কর্তৃপক্ষ বিদ্যুৎ লাইন অপসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করলে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা হবে।

বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা নুর জাহান জানান, অভয়ারণ্যের ভেতর যখন বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের কাজ করা হচ্ছিল তখনও বাধা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু বাধা অমান্য করে অভয়ারণ্যের ভেতর বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন স্থাপন করা হয়েছে। অভয়ারণ্যের ভেতর থেকে বিদ্যুৎ সঞ্চালনা লাইন অপসারণের জন্য পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার চিঠিও দেয়া হয়েছে। সবশেষ চলতি সনের ৩ জুনও লোহাগাড়া জোনাল অফিসের ডিজিএম বরাবরে চিঠি প্রেরণ করা হয়েছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও হাতি বিশেষজ্ঞ ড. মোহাম্মদ আবদুল আজিজ জানান, অভয়ারণ্য আইনগতভাবে সংরক্ষিত ও সংবেদনশীল এলাকা। সেখানে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন স্থাপন আন্তর্জাতিক নীতিমালার পরিপন্থী। এই ধরনের কার্যক্রম শুধু গাছ–পাখির ক্ষতি নয়, বরং পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের উপর দীর্ঘমেয়াদে ভয়াবহ প্রভাব ফেলে। তিনি আরো জানান, অভয়ারণ্য মানেই প্রাণ–প্রকৃতির নিরাপদ আশ্রয়স্থল। সেখানে এমন কর্মকান্ড প্রকৃতির উপর চরম অবিচার। বিদ্যুৎ উন্নয়ন জরুরি হলেও সেটা হতে হবে পরিবেশবান্ধব ও টেকসই উপায়ে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!