Home | দেশ-বিদেশের সংবাদ | চট্টগ্রাম ঘিরেই যত জঙ্গি তৎপরতা

চট্টগ্রাম ঘিরেই যত জঙ্গি তৎপরতা

(ফাইল ফটো)

(ফাইল ফটো)

নিউজ ডেক্স : আসন্ন সংসদ নির্বাচন নিয়ে র‌্যাব-পুলিশের ব্যস্ততার সুযোগে জঙ্গিরা নাশকতার চেষ্টা করবে-এমন আশঙ্কা করছেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাগণ। জঙ্গিরা সংগঠিত হয়ে নাশকতা ঘটাতে পারে-সিএমপি ও জেলা পুলিশের কাছে এমন আগাম সতর্কবার্তা ইতোমধ্যে পাঠিয়েছে পুলিশ সদর দফতর। গোপনে তহবিল সংগ্রহ, প্রচারণা ও নতুন সদস্য তৈরির কাজে নেমেছে তারা। তাদের অর্থ ও বিস্ফোরকের উৎস এখনো বন্ধ হয়নি। চুরি-ছিনতাই করেও তারা অর্থ জোগাড় করছে। এর মধ্যে মীরসরাইয়ে নতুন করে জঙ্গি আস্তানা পাওয়ায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সেই আশঙ্কা সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী গত তিন বছরে চট্টগ্রামে ১১টি জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পায়। এর বেশিরভাগই সীতাকুণ্ড-মীরসরাই এলাকায়। এবার সাধারণের ভিড়ে মিশে গিয়ে নতুন করে রাউজান-রাঙ্গুনিয়ার দিকে জঙ্গিরা আস্তানা গড়ে তুলছে-এমন তথ্য পুলিশের কাছে আছে। আসন্ন সংসদ নির্বাচনে হেভিওয়েট কোনো প্রার্থীকে টার্গেট করার চেষ্টাও করতে পারে তারা।

চট্টগ্রামে সক্রিয় জঙ্গি সংগঠনগুলো নিজেদের বিভাজন কাটিয়ে জোট গঠন করে মাঠে নেমেছে। এই তথ্য আছে পুলিশের কাছে। তবে বাস্তবতা হলো, জঙ্গিদের মোকাবেলায় পুলিশের যে পরিমাণ লজিস্টিক সাপোর্ট প্রয়োজন, তা নেই। এমনকি প্রযুক্তিগতভাবে দক্ষ জঙ্গিদের মোকাবেলায় প্রযুক্তি সুবিধা কাজে লাগাতে অনেক সময় বেগ পেতে হচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে। জঙ্গিদের হামলা মোকাবেলা করতে আরো বেশি প্রযুক্তির প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন চট্টগ্রাম ও জেলার বিভিন্ন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাগণ। সিএমপির ডবলমুরিং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মহিউদ্দিন সেলিম জঙ্গি মোকাবেলা প্রসঙ্গে বিট পুলিশিং ও কমিউনিটি পুলিশিংয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। গতকাল তিনি বলেন, আমার থানা এলাকায় ১০টি বিট রয়েছে। আমরা প্রতিনিয়ত এলাকায় খোঁজ নিচ্ছি, এমন কোনো ভাড়াটিয়া বাড়িভাড়া নিচ্ছে কি না, যাদের সম্পর্কে আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। নির্বাচনের আগে এ বিষয়টি নিয়ে রুট লেভেলে কাজ করছি। কমিউনিটি পুলিশিংয়ের মাধ্যমেও মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার কাজ চলছে। প্রতি শুক্রবার জুমায় বিভিন্ন মসজিদে গিয়ে জঙ্গি ও মাদকের কুফল সম্পর্কে জনগণকে উদ্দীপ্ত করতে বক্তব্য রাখছি। এছাড়া নিজস্ব সোর্স কাজ করছে।

টেকনাফের ওসি প্রদীপ কুমার দাশ বলেন, জঙ্গি সংক্রান্ত বিষয়ে আমরা ইতোমধ্যে বহিরাগতদের একটি ডাটাবেইজ তৈরি করেছি। এছাড়া নিয়মিত উঠান বৈঠক হচ্ছে, যাতে কোনোভাবেই অপরিচিত কেউ আশ্রয়-প্রশ্রয় না পায়। এর মধ্যে কয়েকজনকে পেয়েছি, যারা তথ্য গোপন করে নতুন আগস্তুকদের থাকতে দিয়েছিল। তাদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে।

সিএমপির কোতোয়ালী থানার ওসি মোহাম্মদ মহসিন বলেন, জঙ্গিদের আস্তানা গাড়তে হলে কোথাও না কোথাও ভাড়া করে থাকতেই হবে। যদি ঘর ভাড়া না পায় তবে সে আস্তানা গাড়ার সুযোগ পাবে না। এ সুযোগটা যাতে তারা না পায় সে ব্যাপারে গোয়েন্দা তৎপরতা যেমন জোরদার করা হয়েছে, একই সাথে এলাকার বিভিন্ন মসজিদ-মন্দিরে গিয়ে সাধারণ মানুষকে বুঝানোর চেষ্টা করছি, তাদের সচেতন হতে হবে। কারণ এ বিষফোঁড়া অপারেশন করে নির্মূল করতে সাধারণ জনতার সহযোগিতা লাগবে। তা না হলে কিছুদিন ঘাপটি মেরে থেকে নতুন করে তারা আবার সক্র্রিয় হয়ে উঠবে।

পটিয়া থানার ওসি নেয়ামত উল্লাহ বলেন, জঙ্গি তৎপরতা পুরোপুরি নির্মূল করা গেছে-এ কথা বলার উপায় নেই। তাই আমরা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আগের চেয়েও বেশি অ্যালার্ট আছি। আরো বেশি তথ্য সংগ্রহ করছি। তবে আমি এতটুকু বলতে পারি, আমার এলাকায় জঙ্গি হামলার আশঙ্কা নেই।

পুলিশের একটি গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যমতে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সংলগ্ন হওয়ায় সীতাকুণ্ড, মীরসরাই ও জোরারগঞ্জকে ঘিরে জঙ্গি সংগঠনগুলো বড় আস্তানা গড়ে তুলেছে। দুই দশকের বেশি সময় ধরে চলছে বিভিন্ন জঙ্গি ও সন্ত্রাসী সংগঠনের অপতৎপরতা। বিশেষ করে পাহাড়ি অঞ্চল জঙ্গিদের নিরাপদ ঘাঁটি হিসেবে অনেক আগে থেকেই পরিচিত। এখানে জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) এবং পরে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) ঘাঁটির সন্ধান পায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। এ অঞ্চলে সাধারণ যুবকদের মোটিভেট করতে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে চলেছে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো।

কারণ হিসেবে তথ্য পাওয়া যায়, সীতাকুণ্ড এলাকা শিল্প-কারখানা ও শিপব্রেকিংয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। মীরসরাইয়ে হচ্ছে অর্থনৈতিক অঞ্চল। দেশের লাইফ লাইনখ্যাত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চলে গেছে এই দুই উপজেলার ওপর দিয়ে। এসব কারণে অপরাধী গোষ্ঠীগুলোর কাছে এ দুই উপজেলা নিরাপদ জোন হিসেবে বিবেচিত। এছাড়া মীরসরাই হচ্ছে সীমান্তবর্তী একটি উপজেলা। ওই উপজেলার করেরহাট ইউনিয়নের অপর প্রান্তে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য। ভৌগোলিক এবং অবস্থানগত দিক দিয়ে এ দুই উপজেলাকে নিরাপদ মনে করে জঙ্গিরা। অপরাধ করে ত্রিপুরা সীমান্ত দিয়ে পালানোর সুযোগও আছে। আবার অস্ত্র চোরাচালানেরও রুট এই সীমান্ত।

শীর্ষ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, এরই মধ্যে দেশের জঙ্গি নেটওয়ার্কগুলো নিজেদের মধ্যে প্রাথমিক যোগাযোগ গড়ে তুলেছে। তবে সীতাকুণ্ড, মীরসরাই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর টার্গেটে পরিণত হওয়ায় তারা বিকল্প হিসেবে রাউজান ও রাঙ্গুনিয়াকে বেছে নিয়েছে। গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, জঙ্গিরা ভিন্ন কৌশলে এবার হামলা চালানোর পরিকল্পনা করছে। হামলায় তারা ব্যবহার করবে এসিডের চেয়েও দাহ্য রাসায়নিক পদার্থ।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গোয়েন্দাদের পাঠানো একাধিক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়েছে। সম্ভাব্য রাসায়নিক জঙ্গি হামলা মোকাবেলার প্রস্তুতি হিসেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে দেশের সকল সরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে বিশেষ ইউনিট গঠনের নির্দেশ দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, রাসায়নিক হামলায় আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার জন্য প্রতিটি হাসপাতালে একটি বিশেষজ্ঞ টিম গঠনের জন্য। পাশাপাশি প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম ও ওষুধ মজুদ, অ্যাম্বুলেন্স সচল রাখা, অপারেশন থিয়েটারে বিদ্যুতের বিকল্প ব্যবস্থার জন্য জেনারেটর সচল রাখা ও বিশেষ চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা টিমের সকল সদস্যের বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিতেও বলা হয়েছে।

গোয়েন্দা সূত্র মতে, চট্টগ্রামে জঙ্গিগোষ্ঠীর তৎপরতা ধরা পড়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, বৃহত্তর চট্টগ্রামের কোনো অঞ্চল থেকে এ হামলার সূত্রপাত হতে পারে। গোয়েন্দাদের এই সতর্কবার্তার পর পর সম্ভাব্য জঙ্গি হামলা ও সহিংসতা রুখতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াছ হোসেন। গত রোববার জেলার আইন-শৃঙ্খলা মিটিংয়ে তিনি গোয়েন্দা প্রতিবেদনগুলো তুলে ধরে যেকোনো ধরনের সহিংসতা মোকাবেলায় ২৪ ঘণ্টা প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেন।

সম্প্রতি মীরসরাইয়ে জঙ্গি আস্তানায় আত্মঘাতী হামলায় দুই জঙ্গির মৃত্যু হয়। র‌্যাবের দাবি, নিহত দুজন নব্য জেএমবির সক্রিয় সদস্য। তারা চট্টগ্রাম আদালতে হামলার পরিকল্পনা করেছিল। র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার মুখপাত্র কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তার হওয়া জঙ্গিদের জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে চট্টগ্রাম অঞ্চলে জেএমবির একটি গ্রুপের সক্রিয় থাকা ও তাদের কাছে অস্ত্র ও গোলাবারুদ থাকার তথ্য রয়েছে র‌্যাবের হাতে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিএমপির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, এখন অর্ধশত প্রশিক্ষিত জঙ্গি নব্য জেএমবিতে রয়েছে। এর বাইরে আরো কিছু সাধারণ সদস্য ও সমর্থক আছে। তাদের আক্রমণের পুরনো লক্ষ্যবস্তু বিদেশি নাগরিক, পীর-খানকা। এমনকি র‌্যাাব-পুলিশের ওপরও হামলা চালাতে পারে। এখন তারা এমন বেপরোয়া যে, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদেরও লক্ষ্যে পরিণত করতে পারে।

এদিকে চট্টগ্রামে নেই বোমা নিষ্ক্রিয় করার সরঞ্জাম। গত ১৩ সেপ্টেম্বর লালদিঘিতে নগর গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া ১৬ কোটি টাকার বোমা নিষ্ক্রিয়করণ সরঞ্জাম পুড়ে গেছে। তাই এখন বোমা নিষ্ক্রিয় করতে ঢাকা থেকে দল আসতে হয়।

নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার (উত্তর) ও বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দল চট্টগ্রামের প্রধান হাসান মো. শওকত আলী বলেন, বোমা নিষ্ক্রিয়করণের সরঞ্জাম নতুনভাবে সংগ্রহের চেষ্টা চলছে। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে।

সূত্র : দৈনিক আজাদী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!