Home | সাহিত্য পাতা | আতঙ্ক (লেখক- শীলা ঘটক, কলকাতা)

আতঙ্ক (লেখক- শীলা ঘটক, কলকাতা)

Shila

পার্কসার্কাসে সাবিরদের বাড়িটা অনেক পুরনো, কত বছর আগের বাড়ি তা কে   জানে! বাড়িটা আশপাশ ঝোপঝাড়ে ভ’রে গেছে। ঝোপঝাড়ের পাশ দিয়ে কিছুটা এগোলে সদর দরজা।   সদর দরজা দিয়ে ঢুকলে একটা বড় উঠোন, উঠোনের চারপাশ ঘিরে ঘর। গোটা সাতেক ঘর। দেওয়ালের পালাস্‌টার খসে পড়ছে। রঙের  চিহ্নমাত্র নেই। অনেকদিনের পুরনো বাড়ি, বেশ কয়েক পুরুষের বাস এই বাড়িটায়। চারদিক দেখলেই বোঝা যায় বাড়িটার জীর্ণ দশা!  উঠোনের এক পাশ দিয়ে সিঁড়ি উঠে গেছে ওপরে যাবার। ওপরে তিনটে ঘর বাকিটা  ন্যাড়া ছাদ। ওপরের ঘরগুলোতে ছাদ চুইয়ে বৃষ্টির জল পড়ে বলে ওখানে কেউ  থাকেনা। আগে  সাবিররা ওপরেই থাকতো, কিন্তু বৃষ্টির জল ছাদ থেকে ঘরে পড়ার জন্য ওরা নীচের  ঘরে নেমে এসেছে।  আগে এই বাড়িতে অনেকগুলো ভাড়াটে ছিল, কিন্তু বাড়ির এই  দৈন্যদশা দেখে তারা বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে।

সাবিরের বাবা আনিকুল ইসলামের বাড়ির কাছাকাছি একটা দোকান আছে, সেই দোকান থেকে যা আয় হয় কোনমতে দিন চলে যায়। খুবই কষ্ট করে সংসার চালাতে হয়ে সাবিনাকে। ছেলের পড়াশোনার খরচটা এই বছর থেকে আর লাগছে না, ছেলে বি কম পাশ করে চাকরির খোঁজ করছে, ওর একটা চাকরি হয়ে গেলে হয়তো এতটা অভাব থাকবে না। সারাবাড়ির গায়ে অভাবের ছাপ লেগে আছে। সাবির বিভিন্ন জায়গায় ইন্টার্ভিউ দিচ্ছে যদি একটা চাকরি হয়ে যায় তাহলে আব্বুকে আর অতো পরিশ্রম করতে হবেনা। সকালে সামান্য কিছু খেয়ে বেরিয়ে পড়ে সাবির, বিভিন্ন অফিসে যায়, ইন্টার্ভিউ দেয়, যদি একটা চাকরি হয়! বাড়ি  ফিরতে ফিরতে তিনটে চারটে বেজে যায়। সাবিনার খুব মনখারাপ হয় ওকে দেখলে……

উঠোনের একপাশে একটা টাইম কলের চাতাল। চাতালটার চারপাশে পার বাঁধানো। কিন্তু অনেক জায়গায় ভেঙে গেছে, আর ভীষণ শ্যওলা। একটু অসাবধান হলেই পা পিছলে যাবার ভয় আছে। বাড়ির অবস্থা দেখে সাবিরের মনখারাপ হয়ে যায়! চাকরি পেলে আগে বাড়িটা ভালো করে মেরামত করে তারপর রঙ করবে ঠিক করেছে।

আনিকুলের বাড়ির ফিরতে ফিরতে প্রায় দশটা বেজে যায়। ছোটখাটো একটা মুদিখানার দোকান। কোনমতে দোকানটা চলে।

সেদিন আনিকুল বাড়ি ফিরল অনেক রাত করে, সাবিনা দরজায় কড়া নাড়া শুনে তাড়াতাড়ি করে দরজা খুলে দিতে গেলো। দরজা খুলে আনিকুলকে দেখে সাবিনা বুঝলো কিছু একটা হয়েছে,

কি হয়ে তোমার ? মুখটা এতো গম্ভীর কেন? কিছু হয়েছে? খুব শঙ্কিত হয়ে সাবিনা প্রশ্ন করে।  দরজাটা বন্ধ করে দাও, বলতে বলতে আনিকুল বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল। দরজা বন্ধ করে সাবিনা আনিকুলের পিছে পিছে চলল, কি হয়েছে বলবে তো?

কলপাড়ে বেশ কিছু বালতিতে জল ভরা থাকে রাতের ব্যবহারের জন্য। মুখ হাত পা  ধুতে ধুতে আনিকুল বলল, দোকানে শিবু মাস্তান এসেছিল, বাড়িটা চায় প্রোমোটিং করার জন্য। বলল, চাচা প্রোমোটিং এ দিয়ে দাও তোমাদের অভাব বলে কিছু  থাকবেনা।

শুনে সাবিনার বুকটা ধক্‌ করে উঠলো! পাড়ার সবাই শিবু মাস্তানের নাম শুনলে  ভয় পায়! অনেকগুলো মার্ডার কেসের আসামী। কিন্তু বর্তমান শাসকদলের হাত তার মাথার ওপর আছে, তাই জেলে দুদিনের জন্য যায় আর বেল পেয়ে গিয়ে বের হয়ে আসে।

সাবিনা শঙ্কিত হয়ে বলল, ওর চোখ পড়েছে আমাদের বাড়িটায়,  তাহলে তো গেল, ও তো নিয়েই ছাড়বে। শুনে আনিকুল বলল, প্রাণ থাকতে এবাড়ি আমি দেবোনা। আম্মি, আব্বু শুয়ে আছে এই বাড়ির জমিতে, আর আমি দিয়ে দেবো! সাবিনা বলল, তুমি তো ওকে চেনো কি সাংঘাতিক লোকটা!  না পেলে যদি সাবিরের কোন ক্ষতি করে দেয়! মায়ের মন প্রথমেই কেঁদে ওঠে ছেলের জন্য।

তুমি খেতে দাও, সাবির কোথায়? আনিকুল মুখ মুছতে মুছতে বলে।

সে ঘুমিয়ে পড়েছে, সারাদিন ঘুরে বেড়ায় একটা চাকরির জন্য।

বিছানার সামনে গিয়ে সাবিনা, সাবিরের পা ধরে ডাকে, উঠে পড়ো বেটা, আব্বু এসে গেছে ভাত খাবে তো। সাবির তাড়াতাড়ি উঠে চোখমুখে জল দিয়ে এসে খেতে বসে। ঘড়িতে প্রায় রাত বারোটা। এতোবড় বাড়িটায় মোটে তিনজন মানুষ। খেতে বসে বাবার মুখে সব কথা শুনল সাবির, কিছুটা চিন্তায় পড়ে গেল! ছেলের মুখ দেখে আনিকুল বলল, ভাবিসনা রে আল্লাহ আছেন, উনি ঠিক আমাদের রক্ষা করবেন দেখিস।

শিবু মাস্তানের লোকেরা সারাদিন বাড়িটার ওপর খেয়াল রাখে। কেউ বাড়িতে এলো কিনা, দোকানে গিয়ে শিবু প্রায় রোজই একবার করে আনিকুলকে জিজ্ঞেস করে, কি চাচা কিছু ভাবলে বাড়িটা নিয়ে? চারদিকে কত বাড়ি উঠছে দেখছো তো, তুমি রাজি হয়ে যাও। দেখবে আর কোন অভাব নেই। এতখানি জায়গা নিয়ে কি করবে? তোমার তো একটা ছেলে, তোমাদের জন্য ফ্ল্যাট, টাকা পয়সা সব দেওয়া হবে, তুমি কোন চিন্তা কোরনা। আমি আছি তো, সব ঠিক করে দেবো।

আনিকুল অনেকক্ষণ ধরে কথাগুলো শুনল, কিছুটা গম্ভীরভাবে বলল, আমি আমার বাড়ি প্রোমোটিং এ দিতে পারবো না শিবু।

শুনে শিবুর আসল ভাষা মুখ থেকে বের হওয়া শুরু হোল। কেন বাওয়াল করচেন, পাড়ায় থাকবেন, পাড়ার লোকের কতা সুনবেন না,  একানে টেকা মুসকিল হয়ে যাবে চাচা। কিচাইন না করে ভালো চান তো রাজি হয়ে যান, যত্তসব(……) জুটেছে মাইরি।

আনিকুল বলল, আমার মা, বাবার কবর আছে এই বাড়ির পেছনের জমিতে……  কথা শেষ হতে পারেনা শিবু হুকার দিয়ে ওঠে, মা,বাবার সেন্টু মারবেন না ওসব অনেক শুনেছি।  আমার তো (…..)  বাপটা কে তাইই জানিনা। বিশ্রীভাবে মুখভঙ্গি করে বলল,  বাপ দেকাচ্ছে বাপ।  আরে বাপ তো জন্ম দিতে লাগে আর কিসে লাগে বাপকে? মা টা গেচিল সুখ মারতে, ব্যস পেটে ঢুকিয়ে দিয়ে পগার পার। মুখে এক কুৎসিত তাচ্ছিল্যের হাসি হাসতে হাসতে শিবু কথাগুলো বলতে থাকলো।

আনিকুল মাথা ঠিক রাখতে পারলো না, রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল, শিবু খবরদার বলছি, মুখের ভাষা সংযত করো। এতো খিস্তি তোমার মুখে ছিঃ …… তোমার লজ্জা করেনা এইসব কথা বলতে? ছিঃ নিজের মা, বাবার সম্বন্ধে এইসব কথা বলো? দূর হয়ে যাও এখনই চোখের সামনে থেকে। শিবুর সাথে আরও দুটো চ্যেলা ছিল, সে দুটো আনিকুলের দিকে তেড়ে গেল। শিবু হাত বাড়িয়ে তাদের আটকে দিয়ে বলল, আবার বলছি চাচা একটু ভেবে দেকবেন।

কালো, বেঁটে, মোটা, পান খাওয়া লাল ছোপপড়া দাঁত বের করা শিবুর বিশ্রী হাসিমুখটা মাঝে মাঝে আনিকুলের চোখের ওপর ভেসে ওঠে।  বাড়ির সামনে প্রায়ই কিছু ছেলেকে ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়। বোঝা যায় এরা শিবু মাস্তানের লোক। তারা বাড়ির ওপর নজরদারি করে। ছেলেগুলো আনিকুলের চেনা নয়। সাবির বাড়ি ঢোকার সময় ওরা নানারকম আকার ইঙ্গিত করে, সাবির বুঝতে পারে বাড়িটার ওপরে অশান্তির কালো মেঘ ঘনীভূত হচ্ছে। সাবির ওদের সাথে কথা বলেনা, পাশ কাটিয়ে চলে আসে।

সেদিন রাতে ঘুমাতে যাবার সময় সাবির আব্বুকে প্রশ্ন করে, আব্বু বড়া আব্বু আর বড়ি আম্মিকে এখানে কেন কবর দেওয়া হয়েছিল?

তখন আনিকুল বলতে শুরু করে তার সেই যন্ত্রণার অতীত। সাবিনা খাওয়ার শেষে বাসন ধুতে গেল, আনিকুল ছেলের পাশে শুয়ে বলতে থাকলো……

আব্বু (রফিকুল ইসলাম) ছিলেন ভারতীয় সৈনিক। ১৯৭১ সালে যখন পাকিস্থানের সাথে বাংলাদেশের যুদ্ধ শুরু হোল আমার বয়স তখন দশ বছর। সন্ধ্যে হলেই সারা কোলকাতা অন্ধকার করে দেওয়া হত, কারোর ঘরে আলো জ্বালানো হতনা। কেউ যদি আলো জ্বালত তাহলে কাগজ দিয়ে মুড়ে দেওয়া হোত বাল্বটা, যাতে কোনভাবে পাকিস্থানিরা আমাদের এখানে বম্ব না ফেলে। সেই সময় বাবার ডাক পড়লো,  বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যেতে হবে। ভারতীয় সৈনিকদের পাঠানো হয়েছিল সেই মুক্তিযুদ্ধে,  বাংলাদেশের হয়ে লড়াই করার জন্য।

আব্বু যাবার সময় আম্মি (ফতেমা বেগম) কে বলে গেছিল, যদি যুদ্ধেতে আমি মরি, আর যদি আমার লাশ পাও তাহলে বাড়ির পেছনে যে বাগানটা আছে ওখানে আমাকে কবর দিও। আম্মি কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, এইসব বলে যেওনা, আমার  মাথায় হাত দিয়ে বলেছিল এইটুকু ছেলেটাকে নিয়ে আমি কি করবো?! কিভাবে বাঁচবো! সেদিন আম্মির কান্না দেখে আমি আমার চোখের জল ধরে রাখতে পারিনি!  ঝর্‌ঝর্‌ করে আমিও কেঁদে ফেলেছিলাম আব্বুকে জড়িয়ে ধরে। আব্বু তখন তৈরি হচ্ছেন যাবার জন্য।  মিলিটারি পোশাকে আব্বুকে দেখতে কি সুন্দর লাগতো! মনে হোত আমার আব্বুই আমার কাছে হিরো। খুব ভালবাসতাম আব্বুকে। দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাবার সময় আমি আর আম্মি পেছন পেছন গেলাম যতদূর যাওয়া যায়। পেছন ফিরে আব্বু বলল, আর এসো না, বাড়ি চলে যাও। দাঁড়িয়ে পড়লাম রাস্তায়  আমি আর আম্মি, গাড়িতে উঠে পড়লো আব্বু।

তখন মোবাইলের ব্যবহার তো কিছু ছিলনা, তাই অপেক্ষা করতে হত একটা চিঠির জন্য, পিওনকে দেখলেই দৌড়ে যেতাম কোন চিঠি আছে নাকি। দিনের পর দিন হতাশ হয়ে ফিরে আসতাম।

যুদ্ধ শেষ, বেতারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের কণ্ঠ ভেসে আসছে,  আমি আর  আম্মি তখন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি আব্বু কবে ফিরবে !!

একদিন সন্ধ্যায় আব্বু ফিরে এলেন বাড়ি, আব্বুকে দেখে আমার সেকি আনন্দ ! আম্মি আনন্দে চোখের জল ধরে রাখতে পারলেন না। জড়িয়ে ধরলাম আব্বুকে ! সেদিনটা চোখের ওপর ভাসছে। আম্মি বলল, দেখলে তো আমি সবসময় আল্লাহ  কে স্মরণ করতাম আর বলতাম, মানুষটাকে ঘরে ফিরিয়ে দাও। আল্লাহ আমার মনের কথা শুনেছেন। আম্মি দুহাত ঠেকিয়ে ওপর দিকে তাকিয়ে আম্মি, আল্লাহকে ডাকলেন।

সাবির এতক্ষণ খুব মন দিয়ে শুনছিল। শুনতে শুনতে মনটা মিশে গেছিল সেদিনের সেই সময়ের সাথে। আব্বুর কথাগুলো এতো জীবন্ত যে মনে হচ্ছিল তার চোখের সামনেই ঘটনাটা ঘটেছে।

তারপর? সাবির কিছুটা উত্তেজিত হয়েই প্রশ্ন করলো।

তারপর আব্বু ফিরল ঠিকই কিন্তু সাথে নিয়ে এলো মারণব্যাধি যক্ষ্মা। দীর্ঘদিন ঠিক মতো খেতেও পায়নি আব্বু। খুসখুসে শুকনো কাশি। কাশির সাথে সাথে বের হত ছিটে ছিটে রক্ত। ডাক্তার দেখতে আসতো, হাসপাতালে ভর্তির জন্য লিখে দিয়ে গেল। কিন্তু আব্বু ভর্তি হতে চাইলো না। বলল, ডাক্তারবাবু যে কয়দিন আছি বাড়িতেই থাকি, অনেকদিন ওদের ছেড়ে আছি। আর ছেড়ে থাকতে মন চাইছেনা। আম্মির সেই কথা শুনে কি কান্না তোকে বলে বোঝাতে পারবোনা। আমারও তখন বয়স অনেক কম, কিছুই বুঝিনা ভালো করে।  আমার ঢোকা নিষেধ হয়ে গেল আব্বুর ঘরে। দরজার বাইরে থেকে আব্বুকে দেখতাম। খাবার থালা, বিছানা সব আলাদা। আমি আর আম্মি একটা ঘরে থাকতাম আর আব্বু আর একটা ঘরে। তখন সারা বাড়ি ভর্তি লোক ছিল, সব ঘরগুলোতে ভাড়াটে ছিল। তারাও আসতো, আম্মির সাথে কথা বলত, আর আব্বুকে কে দূর থেকে দেখে চলে যেত। কি যে কষ্ট  পেতাম বলে বোঝাতে পারবোনা। চোখ দুটো জলে ভিজে যেত আমার।

দিন যত যায়, অবস্থা খারাপের দিকে যেতে থাকে। ঘন ঘন ডাক্তার আসতো। একদিন ভোরবেলায় আব্বু আমাদের ছেড়ে চিরবিদায় নিলেন। আম্মি কান্নায় ভেঙে পড়লেন। সারা বাড়ি ভর্তি লোক। আব্বুর সাথে যারা সেই মুক্তিযুদ্ধে গেছিলেন সেই মনোহর কাকু, নগেন কাকু খবর পেয়ে এসে উপস্থিত হলেন আব্বুকে দেখার জন্য।

আম্মির কথা মতো আব্বুকে বাড়ির পেছনের বাগানে চিরকালের জন্য ঘুমানোর ব্যবস্থা করে দেওয়া হোল মাটি কেটে। আব্বুকে একটা সাদা কাপড় মুড়ে শুইয়ে দেওয়া হোল আর সকলে মাটি ছুড়তে লাগল।

অনেকক্ষণ চুপ করে থাকতে দেখে সাবির বলল, আর বলতে হবেনা, থাক তুমি ঘুমিয়ে পড়ো।

না শেষটুকু বলি, আজ আর আমার ঘুম আসবেনা।  তুই যখন এক বছরের ছেলে আম্মি হঠাৎ একদিন সন্ধ্যেবেলায় নামাজ পড়তে পড়তে বুকে হাত দিয়ে বসে  পড়লো। সাথে সাথে হাসপাতালে নিয়ে ছুটলাম। তাড়াতাড়িই পৌঁছালাম।  এমারজেন্সির বেডে শোয়ানো হোল আম্মিকে। ডাক্তার হাতের নাড়ি ধরে বললেন, আম্মি বেঁচে নেই। চার ঘণ্টা এখন হাসপাতালে রাখতে হবে। যেহেতু রাস্তায় মারা গেছেন তাই তার দেহ কাটা ছেঁড়া করে দেখবে, আম্মির অস্বাভাবিক মৃত্যু কিনা!

ওপর দিকে তাকিয়ে বললাম, হায় আল্লাহ, এই ছিল কপালে!

আম্মিকেও হারালাম বড় অসময়ে! হাসপাতালে বসেই ঠিক করলাম আব্বুর পাশেই আম্মিকেও রাখবো, ওরা দুজনে আমার কাছেই তো রইল। যখন মনখারাপ হয় কবরের পাশে গিয়ে বসি, হাত বুলাই কবরের ওপর মনে হয় আব্বু, আম্মি কোথাও  যায়নি, আমার কাছেই আছে। কথাগুলো বলতে বলতে চোখদুটো জলে ভ’রে ওঠে আনিকুলের। এই বাড়ি  শিবু চাইছে প্রোমোটিং এর জন্য!  আম্মি, আব্বুর কবর চাপা দিয়ে তৈরি হবে বিশাল বাড়ি, সেই বাড়ির লোকজন ওই কবরের ওপর দিয়ে হেঁটে চলে  বেড়াবে, ভাবতে পারছিস!  সাবিরও চোখের জল ধরে রাখতে পারেনা। ছোটবেলা থেকে দেখে আসছে তার বাবা, মাকে ওই কবর দুটোয় ফুল দিতে। মা,বাবা দেখাদেখি সে নিজেও ফুল দেয়।

সব শুনে সাবির বলল, দেখি কি করা যায়, তুমি চিন্তা কোরনা, একটা ব্যবস্থা ঠিক হয়ে যাবে। সাবিনা সেইসময়ে ঘরে ঢোকে, সাবিরের কথা শুনে বলে, না না তুই বেটা ওদের কিছু বলতে যাবিনা, আমার খুব ভয় করছে। বাড়ি ছেড়ে দিতে পারবো, কিন্তু তোর কোন ক্ষতি হলে মানতে পারবো না।  সাবির বলল, এতো চিন্তা করো কেন? চুপচাপ হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে? তাতে কি লাভ হবে?  কাল আমাকে একটু সকাল সকাল বের হতে হবে একজনের সাথে দেখা করতে হবে। সেইই পারবে এই সমস্যার সমাধান করতে। তুমি আমাকে সকাল ছয়টার মধ্যে ডেকে দেবে, আমি একটু বের হবো।

সকাল বেলায় ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুতে গিয়ে দ্যাখে কলে জল পড়ছেনা।  কি হোল!    জানার জন্য সাবির বাড়ির দরজা খুলে রাস্তার দিকে এগিয়ে গেল, দেখলো রাস্তার কলে তো জল পড়ছে, তাহলে আমাদের বাড়ির কলে কি হোল! রাস্তার ওপারে একটা কল থেকে জল পড়ে যাচ্ছে, তখনো কেউ আসেনি জল নিতে।  সাবির বেশ কিছু বালতি জল ভরে নিয়ে এসে রাখল, সারাদিন জল তো লাগবে। বুঝতে পারলো কিছু একটা হয়েছে নাহলে এমনি এমনি তো আর জল বন্ধ হয়ে যাবেনা! সারাদিনে জলের প্রয়োজন অনেক, একদম জল পড়ছে না তাই যতটা পারলো জল তুলে রেখে চা, রুটি খেয়ে সাবির বের হোল।

কোথায় যাচ্ছিস তুই বেটা? পেছন থেকে সাবিনা প্রশ্ন করে।

ফিরে এসে বলবো, দরজাটা বন্ধ করে দাও। বলে সাবির বেরিয়ে গেল।

সাবির বাস ধরে চলল ময়দানের দিকে, ওখানে একজনকে এই ঘটনাটা জানানোর  খুব প্রয়োজন। বাস থেকে নেমেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেল যেখানে ক্রিকেট খেলা হয়। ক্রিকেট খেলা হচ্ছে ঠিকই কিন্তু যাকে খুঁজছে তাকে দেখছেনা……

কিরে সাবির কেমন আছিস? অনেকদিন পর তোকে দেখলাম, ভালো আছিস তো? সাবির সে কথার কোন উত্তর না দিয়ে বলল, শুভ আসেনি আজ খেলতে? ছেলেটির নাম রৌনক, বলল, না তো, ও রোজ আসেনা, ব্যবসা নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, নতুন ব্যবসা শুরু করেছে তো। কি দরকার তোর ওকে? কিছুটা আনমনা হয়ে সাবির বলল, এখন ওর বাড়ি গেলে ওকে পাবো? খুব দরকার আছে রে। রৌনক আর জানতে চাইলো না, কিসের এতো দরকার। বলল, হ্যাঁ পাবি এখন দ্যাখ গিয়ে সে এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি। আমি তাহলে আসি রে, পরে কথা হবে।

সাবির ছুটল বাসস্ট্যান্ডের দিকে, বাস ধরে চলল শুভর বাড়ি। ঠিক তাই, শুভ এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি। বাইরে থেকে শুভ শুভ করে ডাকতেই শুভর মা দরজা খুলে দিয়ে, শুভর ঘরটা দেখিয়ে দেয়, ততক্ষণে সাবিরের গলার আওয়াজে শুভর ঘুম ভেঙে গেছে। ধড়ফড় করে উঠে বিছানা থেকে নেমে এসে ঘর থেকে বের হবার মুখেই দ্যাখে সাবির দাঁড়িয়ে আছে ওর ঘরের সামনে।

আয় আয় ভেতরে আয়, শুভ হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল ঘরের ভেতর সাবিরকে। একটা চেয়ারে বসতে দিয়ে বলল, তুই বস আমি আসছি এখনি।

সাবির বসে রইল, কিছুক্ষণের মধ্যেই শুভ এসে বলল, চা খাবি? সাবির বলল, নারে ভাই আমি কিছু খাবনা। খেয়ে বের হয়েছি, তোকে আমার খুব দরকার ভাই, খুব বিপদে পড়েছি।

কি হয়েছে? শুভ খুব শান্তভাবে প্রশ্ন করলো।

সাবির সমস্ত ঘটনা সবিস্তারে শুভকে বলে চলল…… যা যা ঘটেছে আজ পর্যন্ত।

সব শুনে শুভ বলল, জল বন্ধ করা ওই প্রোমোটারের কাজ, এরপর আরও কিছু বন্ধ করবে… অতো ভাবিসনা, দেখছি কি করা যায়। তখনো ঘুমের আলসেমি কাটেনি, হাই তুলতে তুলতে বলল, আমার ফোন নম্বরটা সেভ কর তোর মোবাইলে। চিন্তা করিসনা, আমি এরমধ্যেই তোর বাড়ি একদিন যাবো। শুনে সাবির  আকুতির সুরে বলল, হ্যাঁ ভাই তুই একবার আয়। বুঝতেই তো পারছিস আমরা একা থাকি, আম্মি, আব্বুর বয়স হয়েছে।

সাবির বাড়ি ফিরে গেল।

বাড়ি ফিরেই জানতে পারলো ঘরে কারেন্ট নেই, জল, কারেন্ট সব বন্ধ। কি দুর্বিষহ অবস্থা, এইভাবে গরমে টেকা যায়?

সেইদিন দুপুরের দিকে শিবু মাস্তান আর তার সাথে দশ বারো জন আনিকুলের দোকানে গিয়ে হাজির। শিবুকে দেখে আনিকুলের রক্ত মাথায় চড়ে গেল, বলল, আমি তো জানিয়ে দিয়েছি, আমি আমার বাড়ি দেবোনা। কি ভেবেছ তুমি? জল, কারেন্ট বন্ধ করে দিয়ে ভেবেছ আমি রাজি হয়ে যাবো? তুমি যা পারো করো, আমি বাড়ি দেবোনা।

শিবুর সাথে তার চ্যালারা তেড়ে গেল আনিকুলের দিকে, বেসি চিল্লাবি না বুজলি  গলার নলি কেটে রেকে দেবো, ওদের মধ্যে থেকে একজন হুঙ্কার দিল। এমনসময়ে শিবু প্যান্টের পকেট থেকে ছোটো একটা রিভালবার বের করে আনিকুলের কপালে ঠেকিয়ে বলল, এটা দেকতে খেলনার মতো, কিন্তু কাজ করে ভালো। একবার  চালিয়ে দিলে এদিক থেকে ঢুকে মাথার পেছন দিয়ে বেরিয়ে যাবে বুজলে চাচা? আর একটা কথা, থানায় জানিয়ে কোন লাভ হবেনা, মামারা সব আমার পোষা কুত্তা বুঝলে? রিভালবারটা আবার পকেটে ঢুকিয়ে নিয়ে বলল, দুদিনের মধ্যে তোমার বাড়ি যাচ্ছি, কাগজে সইটা মেরে দিও চাচা। সদলবলে শিবু চলে গেল…… তখনো রাগে, দুঃখে, ভয়ে আনিকুলের শরীর ঠক্‌ ঠক্‌ করে কাঁপছে। পাশের দোকানের অনেকেই দেখলো কিন্তু শিবুর ভয়ে কেউ এগিয়ে এলো না।

বাড়ি ফিরে সাবিনাকে আর সাবিরকে আনিকুল সব বলল, শুনে সাবির বলল, শুভকে সব জানিয়ে এসেছি, দ্যাখো ও কি করে। ওর ওপর আমার ভরসা আছে। সেইদিন সন্ধ্যেবেলায় শুভ গেল সাবিরের বাড়ি। বাড়িটা একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার। বাইকে থামিয়ে দরজায় কড়া নাড়ল। সাবিনা দরজা খুলে দিল। ভেতরে গেল শুভ। মোমবাতি জ্বালিয়ে সাবির বসে আছে। শুভকে দেখে ওরা যে স্বস্তি পেল। সাবির বলল, তোর বাড়ি থেকে এসে দেখি কারেন্ট নেই বাড়িতে, কি অবস্থা দ্যাখ আমাদের। শুভ বলল, আমি যা বলবো তাইই করবি। আমি তোকে ফোনে জানিয়ে দেবো।

শুভ, সাবিরের বাড়ি থেকে বের হয়ে বাইকে পা দেবার সাথে সাথেই কয়েকটা ছেলে শুভকে ঘিরে ধরল। ওদের মধ্যে থেকে একজন বলল, তুই কে রে?  শুভ বলল, আমি সাবিরের বন্ধু, কেন? কি দরকার? এই কথা শুনে ওদের মধ্যে থেকে একজন গালিগালাজ করে বলল, আর যেন না দেখি এখানে, কোথায় থাকিস তুই? শুভ বলল, তোদের কি দরকার আমি কোথায় থাকি? এই শুনে কয়েকজন শুভকে মারতে উদ্যত হোল। শুভ সাইকেলের চেন বের করে সাপাসাপ চালালো। কয়েকটা জখম হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। কয়েকটা পালিয়ে গেল। বেশী বাড়াবাড়ি করিসনা বলতে বলতে শুভ বাইক চালিয়ে চলে গেল।

প্রায় দুইদিন হয়ে গেল বাড়িতে জল, কারেন্ট নেই, এইভাবে কি বাস করা যায়!  কোলকাতার গরমে মানুষ এমনিতেই টিকতে পারেনা, তারপর বাড়ির এই অবস্থা আনিকুলের মন খারাপ হয়ে যায়। কিন্ত কিছু করারও নেই, স্থানীয় থানা শিবুর  হাতে। সেখানে গিয়ে জানালে যে কোন কাজ হবেনা সেটা আনিকুল খুব ভালো বুঝতো।  আর এটাও জানতো , থানায় জানালে ফল আরও খারাপও হতে পারে।  বাধ্য হয়ে চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া উপায় নেই। মনে মনে ভাবে যদি একান্তই এই বাড়িটা ওদেরকে দিয়ে দিতে হয় তাহলে ছেলে, বউকে নিয়ে সারা জীবনের মতো  এই এলাকা ছেড়ে চলে যাবে। হয়তো এই দেশ ছেড়েই …… সাবির বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো বাবার মন ভালো নেই, খুব গভীরভাবে কিছু একটা ভাবছে…… সাবির বলল, আব্বু চিন্তা কোরনা। শুভকে যখন জানিয়েছি একটা ব্যবস্থা ও ঠিক করবে দেখে নিও। আনিকুলের পাশে গিয়ে বসল সাবির। সাবিরের  মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে আনিকুল বলল, বেটা, শুভও তো বাচ্চা ছেলে, তোর মতোই বয়স, এই শয়তানদের মুখের সামনে ওকে কি করে ঠেলে দি বল…… ওর জীবনের দাম কি কিছু কম আমাদের কাছে? সাবির বলল, তুমি তাহলে ওকে  চেনোনা এখনো, শুভ যখন জানতে পেরেছে এই ঘটনা…… কিছু একটা করবে।

সাবিনার মন মেজাজ ভালো থাকেনা, একটা অস্বস্তিকর অবস্থা! ভালো লাগেনা আর…… বাবা, ছেলের কথাবার্তা কানে আসছে কিছু কিছু রান্নাঘরে কাজ করতে করতে মাঝে মাঝে আনমনা হয়ে শুনছে ওদের কথা…… এক সময়ে ঘরে এসে সাবিরকে বলল, তুই শুভকে তো সব জানালি, শুভ বলল তোকে ফোন করবে, কিন্তু এখনো তো ফোন করলো না। বেশ বিমর্ষ লাগছিল সাবিনাকে।

মায়ের দিকে তাকিয়ে সাবির বলল, আম্মি তুমি ওকে তাহলে এখনো চিনতে পারোনি, ও যখন কথা দিয়েছে তখন ঠিক কথা রাখবে।

কিন্তু দুদিন তো হয়ে গেল, ফোনও করলো না আর এলোও না……

বললাম তো তুমি ওকে নিয়ে চিন্তা কোরনা। তুমি কিছু খেতে দাও তো, আমাকে বের হতে হবে, কাজ আছে।

সাবিনা রান্নাঘরে চলে গেল।

আনিকুল পুরনো ট্র্যাঙ্ক খুলে তার মা, বাবার পুরনো কিছু পোশাক, ছবি, বাবার মিলিটারি পোশাক আরও বেশ কিছু জিনিসপত্র বের করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগল, ট্র্যাঙ্কের নীচের দিকে সযত্নে রাখা আছে কোরান শরিফটি…… সেটি হাতে নিয়ে সাবিরকে দেখিয়ে বলল, আমার আম্মি, আব্বু খুব ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন জানিস।  নামাজ পাঠের নির্দিষ্ট সময়ে ওঁরা নামাজ পাঠ করতেন। সাবির সেটি বাবার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে আবার যথাস্থানে রেখে দিয়ে ট্র্যাঙ্কটি বন্ধ করে দিয়ে বলল, যাও রেডি হও দোকানে যেতে হবে। সাবির বুঝতে পারলো, এগুলো নিয়ে বেশী ঘাটাঘাটি করলে আব্বুর মন আরও খারাপ হবে। আনিকুলের স্মৃতি মধ্যে যেন হঠাৎ হঠাৎ উল্কাপাত হচ্ছে, মাঝে মাঝেই একটা করে কথা বলে উঠছেন, জানিস বেটা, আব্বু,  আম্মিকে কখনো বোরখা পরতে দিতো না। বলতো, আমি চাইনা তুমি  পর্দানশীন বিবি হয়ে থাকো। খুব আধুনিক ছিলেন তোর বড়া আব্বু। সাবির হাসতে হাসতে বলল, সেতো তুমিও পরতে দাওনা আম্মিকে।

সাবির বাড়ি থেকে বের হতেই দেখা হোল শিবুর এক সাগরেদের সাথে। হাত নেড়ে ডেকে বলে, এই শোন, শোন শোন…… সাবির এগিয়ে যায়। ওইদিন যে ছেলেটা এসেছিল তোদের বাড়ি,  মালটা কে রে?

সাবির মাথা চুলকাতে চুলকাতে কিছুটা এড়িয়ে যাবার ভঙ্গিতে বলল, কে ছেলেটা?   মনে পড়ছে নাতো! লোকটা কিছুটা মারমুখী হয়ে তেড়ে এসে বলল,কানের গোড়ায় একটা চাপর দিলে না সব মনে পড়ে যাবে…… কোনো টিকটিকি যদি ফিট করেছিস তাহলে বাপ-বেটা দুটোকেই খাল্লাস, বুজলি ……  যা ভাগ এখান থেকে।

সাবির আর কথা না বাড়িয়ে চলে গেল।

শুভ বলেছিল, আমি ঠিক সময়মত ফোন করবো, আজ দুদিন হয়ে গেল শুভ ফোন  করছে না দেখে সাবির কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়লো।

আজ ধর্মতলার একটা অফিসে সাবিরকে ডেকেছে,  সাবির কিছুটা আশাবাদী হয়েই আজ যাচ্ছে সেই অফিসে, রাস্তা পার হবার সময় হঠাৎ বুকপকেটের মোবাইলটা বেজে উঠলো, তাড়াতাড়ি পকেট থেকে বের করে দ্যাখে শুভ ফোন করছে, দ্রুত ফোন কানে দিয়েই বলল, বল ভাই ……………

সাবিরের চাকরিটা হয়ে গেছে ওরা মাসের এক তারিখ থেকে জয়েন করতে বলেছে। আজকের দিনটা খুব ভালো দিন একদিকে শুভর ফোন, আর একদিকে চাকরিটা হয়ে গেল, ভেবে সাবির আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠলো !!

সাবির বাড়ি ফিরে আম্মু আম্মু করে চিৎকার করতে করতে ঢুকলো, চাকরিটা  আমার হয়ে গেছে আম্মু, খুব বড় কোম্পানি…… সাবিনাকে জড়িয়ে ধরে সাবির উঠোনের ওপর বন্‌বন্‌ করে ঘুরতে লাগলো। ছেলের আনন্দ দেখে সাবিনার আনন্দ হচ্ছে না যে তা নয়, কিন্তু বিষাদ যেন ছেড়ে যেতে চায়না! বলল, ছাড় ছাড় পড়ে যাবো তো…… সাবির এবার মাকে ফিস্‌ফিস্‌ করে বলল, শুভ ফোন করেছিল, কাল ভোরবেলা ফার্স্ট বাস ধরে লেকটাউনে সৌরদের বাড়ি আমাদের চলে যেতে বলেছে, যতক্ষণ না ও বলছে ফিরে আসতে আমরা যেন ফিরে না আসি। কিছু জামাকাপড় নিয়ে নাও ওখানে কয়দিন থাকতে হবে। তুমি ব্যাগ গুছিয়ে নাও।  সাবির ঘরে চলে গেল।

সাবিনা যেন স্বস্তি পাচ্ছে না  কিছুতেই। আবার সাবিরের পিছে পিছে ওর ঘরে গিয়ে বলল, বেটা,  সৌর তো হিন্দু, আমাদের কি ওখানে থাকা ঠিক হবে?!

সাবির কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল, আম্মি এসব আমরা মানিনা, জাতপাত, ধর্ম, এসব আমরা বন্ধুরা বিশ্বাস করিনা, তাই যদি বলো, শুভও তো হিন্দু, ও কেন আসবে  আমাদের পাশে!  ধর্ম ঘরের ভেতর থাকুক, বাইরে আমাদের একটাই ধর্ম, তাহলো ‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য’ । সাবিরের মুখের কথাগুলো সাবিনা  মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিল। খুব ভালো লাগছিল ওর।

আনিকুল বাড়ি ফিরতেই সাবিনা সব ঘটনা আনিকুলকে জানাতে, আনিকুল দুহাত আকাশের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, সব আল্লাহর মেহেরবানী !!

সারারাতই প্রায় জাগা সাবিনা আর আনিকুল। মাঝরাতে উঠে তৈরি হতে থাকলো প্রথম বাস ধরতে হবে ওদের। তখনো ভালো করে আলো ফোটেনি ঘরে তালা মেরে বের হয়ে এলো ওরা বাড়ি থেকে। সদর দরজায় তালা দিতে যাবার সময় সাবির বলল, আব্বু, সদর দরজায় তালা দিওনা, ওটা এমনি বন্ধ করে দিয়ে চলো।

বাড়ি তো তাহলে খোলা পড়ে থাকবে বেটা, সেটা কি ঠিক হবে? শুনে সাবির বলল, শুভ আমাকে যা বলেছে তাইই করতে হবে।

দরজাটা চেপে বন্ধ করে দিয়ে ওরা বাসস্ট্যান্ডের দিকে এগিয়ে গেল।

সৌরদের বাড়ি ওরা অনেক্ষণ পৌঁছে গেছে। সৌরর বাবা, মা খুব ভালোমানুষ।  ওনাদের খুব যত্নআত্তি করছেন। সন্ধ্যেবেলায় শুভ গেল সৌরদের বাড়ি। সবার সাথে কমবেশি কথা বলে শুভ সাবিরের কাছে বাড়ির চাবিটা চাইলো। আনিকুল চাবিটা শুভকে দিয়ে বলল, বেটা ওরা খুব বাজে লোক, তুমি ওদের সাথে ঝামেলা করতে  যেওনা। ওরা মানুষ খুন করে। শুভ বলল, কাকু আপনি চিন্তা করবেননা। আমি ওদের সাথে কথা বলবো না, কথা দিলাম। শুভ চাবি নিয়ে বেরিয়ে গেল।

মুহূর্তের মধ্যে শুভ আবার ফিরে এসে বলল, আমি যতক্ষণ না ফোন করছি  এখানেই থাকবি। আর একটা কথা আমি ফোনে বলে দেবো কি কি করতে হবে সেই মতো করবি বুঝলি? শুভ বেরিয়ে গেল।

আনিকুলের দোকান বন্ধ। শিবুর সাকরেদরা তোলা তুলতে এসে দোকান বন্ধ দেখে বুঝতে পারে ওরা এখানে নেই।

গুরু, চাচা মনে হয় বউ ছেলে নিয়ে ভেগেছে, শিবুর বাড়ি গিয়ে শিবুকে খবরটা দিয়ে এলো এক চ্যালা।

শিবু দলবল নিয়ে আনিকুলের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো, দরজায় তালা নেই দেখে শিবু বলল, দুস, কোথাও যায়নি, গেলে কি দরজা খুলে রেখে যেত? কাছাকাছি গেচে কারোর বুদ্দি নিতে, কি ভাবে বাঁচবে!! কথাগুলো বলে সেই বিশ্রীভাবে দাঁত  বের করে হাসতে লাগল। কিছুক্ষণ উঠোনে ঘোরাঘুরি করে বলল, চল রাতে এসে দেকা যাবে মালটা গেচে কই, বউ ছেলে নিয়ে…… শিবুরা বেরিয়ে গেল। দরজাটা  বন্ধ করেও গেলনা। একেবারে খোলা পড়ে রইল সারাদিন।

রাত প্রায় বারোটা শুভ কাঁধে একটা কালো ব্যাগ নিয়ে বাড়িটার সামনে এসে দেখল বাড়ির সদরদরজা খোলা, বাড়ির চারপাশটা একবার তাকিয়ে নিল, কেউ কোথাও আছে কিনা, বাড়ির ভেতরটা একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার। দেখার চেষ্টা করলো ভেতরে কেউ আছে কিনা, বাড়িটা বিশাল। না কেউ নেই ভেতরে থাকলে তো আওয়াজ পাওয়া যেত। আস্তে করে পা টিপে টিপে  শুভ বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল।  সদরদরজাটা বন্ধ করলো না, যেমন খোলা তেমনই পড়ে রইল। সারাবাড়ি ঘিরে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা! বাড়িটা একেবারে ভুতুড়ে বাড়ির চেহারা নিয়েছে,  কিছুক্ষণ উঠোনে দাঁড়িয়ে থেকে মোবাইলের আলো জ্বেলে দেখে নিল বাড়ির চারদিক। বাড়ির পেছনের বাগানে কয়েকটা বড় বড় গাছ আছে,  কতকগুলো পাখি ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে উড়ে গেল বাড়িটার ওপর দিয়ে। অনেকদিন আগে শুভ একবার এই বাড়িতে এসেছিল, কিছুটা সময় থেকে চলে গেছিল। মনে মনে ভাবলো আজ বেশ অনেকটা সময় পাওয়া গেছে সারা বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখা যাবে। মোবাইল পকেটে রেখে ব্যাগ থেকে টর্চ বের করে, জ্বালিয়ে একতলাটা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো। রাত প্রায় একটা বেজে গেছে। মাঝে মাঝে সদর দরজার দিকে তাকিয়ে দেখছে কেউ আসে কিনা, মনে মনে ভাবে এইরাতে আর কে আসবে!

কলপাড়ের পাশ দিয়ে উঠে গেছে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি, কলের আশপাশ খুব শ্যাওলা। ভালো করে দেখে নিয়ে শুভ সাবধানে সিঁড়িতে পা দিল…… সিঁড়িঘরটা খুব চাপা, প্রশস্ত নয়, আগেরকার বাড়ি বলেই হয়তো এমন। একটা ধাপ উঠে একটু দাঁড়িয়ে দেখে নিল সিঁড়ির বাকি অংশটা।   একটা মোড় নিয়ে সিঁড়ির বাকি অংশটা উঠে গেছে দোতলার দিকে।  এতো সরু সিঁড়ি যে একজন উঠলে আর একজন  নামতে পারবেনা। অনেকদিনের পুরনো বাড়ি বলেই হয়তো এমন।  সিঁড়িটার অনেক জায়গায় ভেঙে গেছে।

দোতলায় পৌঁছে শুভ টর্চ নিভিয়ে দিল। অন্ধকারেই এগিয়ে গেল ঘরগুলো দেখার জন্য। তিনটে ঘরের মধ্যে তালা দেওয়া দুটো ঘর।  শেষের ঘরের দরজাটা অল্প  খোলা। শুভ দরজাটার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে কান খাড়া বোঝার চেষ্টা করলো কেউ  আছে কিনা ভেতরে।  এতো অন্ধকার যে কিছুই বোঝা যায়না……… বন্ধ ঘরের চাবিও শুভর কাছে আছে, কিন্তু ওই দুটো ঘর না খুলে শুভ শেষের খোলা ঘরটায় আস্তে করে দরজাটা ঠেলল। দরজা খুলতেই বিশ্রী একটা গন্ধ নাকে এলো। অনেকদিন না ব্যবহার করা ঘরের ভেতর হয়তো এমনই গন্ধ হয়ে যায়। এবার মোবাইলের আলো জ্বেলে শুভ দেখলো ঘরের এককোনে পুরনো ছেঁড়া  লেপ,তোষক রাখা, আর তাতে একটি বেড়ালের সুন্দর পরিপাটি সংসার। মা বেড়ালটা চারটে বাচ্চা নিয়ে ঘুমতে ব্যস্ত, আর হুলোবেড়ালটা  শুভকে  দেখে  কিছুটা ভয়ে কিছুটা রাগে কট্‌কট্‌ করে তাকিয়ে রইল। অন্ধকারে বেড়ালের চোখদুটো ভয়ানক দেখাচ্ছিল। মোবাইলের আলোয় শুভ বুঝল, হুলোটা কালো রঙের।

শুভর পশু, পাখীদের পোষ মানানোর এক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। ঘরের ভেতর ঢুকে গিয়ে ব্যাগ থেকে বিস্কুট বের করে হুলোটাকে দিতেই ব্যাস, হুলো কাছে এসে শুভর পায়ে মাথা ঘসতে থাকল। ততক্ষণে বাকি বেড়ালগুলো জেগে গিয়ে শুভকে দেখছে। শুভ ওদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ঘরের একপাশের কিছুটা অংশ একটু ছেঁড়া তুলো আর লেপের কাপড় দিয়ে মুছে সেখানেই চাদর পেতে ব্যাগটা মাথার ওপর রেখে শুয়ে পড়লো। বাচ্চা বেড়ালগুলো মিটমিট করে তাকিয়ে দেখতে থাকলো শুভর দিকে।

ঘড়িতে দুটো বেজে গেছে, চোখে ঘুম জড়িয়ে আসছে ………

ঘণ্টা দুয়েক ঘুমিয়ে ভোর চারটের সময় শুভ ব্যাগে চাদর, টর্চ ভ’রে নিয়ে, বের হবার জন্য প্রস্তুত হোল। বেড়ালগুলোর দিকে তাকিয়ে দ্যাখে মা বাচ্চাদের নিয়ে একইভাবে ঘুমোচ্ছে, কিন্তু হুলোটা নেই।

পূবের আকাশ একটু ফর্সা হতে শুরু করেছে, শুভ নেমে এলো বাড়ির একতলায়। উঠোনে হুলোটা ঘুরে বেড়াচ্ছে।  কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে বিস্কুটের প্যাকেট থেকে কয়েকটা বিস্কুট ভেঙে ভেঙে উঠোনে ছড়িয়ে দিয়ে, হুলোটার মাথায় হাত বুলিয়ে শুভ সদরদরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। মুখ বাড়িয়ে একটু এদিক ওদিক দেখে নিয়ে দরজা খোলা রেখেই শুভ বেরিয়ে গেল।

পরেরদিন একটু আগেই শুভ ঢুকে পড়লো বাড়িটায়। সোজা সিঁড়ি দিয়ে ওপরে চলে গেল। তখন রাত নয়টা হবে। তার কিছুক্ষণ পর শিবু সদলবলে ঢুকল বাড়িতে।  একজন বলল, গুরু আজ ক্যান্ডেল পার্টি হয়ে  যাক। শিবু বলল, হয়ে যাক তবে।  তোরা সব নিয়ে আয়, বলে পকেট থেকে টাকা বের করে দিল। উঠোনের মধ্যে  একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে ওরা তাস খেলতে বসল। আর কয়েকজন বাইরে গেল। শুভ ঘর থেকে সন্তর্পণে বের হয়ে এসে ন্যাড়া ছাদে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের কীর্তিকলাপ দেখছিল। বাইরে যারা গেছিল তারা মদ, চানাচুর, চিকেন রোস্ট সব নিয়ে এসে মজলিশ করে খেতে বসলো। নিজেদের মধ্যে খুব হৈ হুল্লোড় করছিল ওরা।

এইসব যখন চলছে, ঠিক তার কিছুক্ষণ পরই শুভ একটা দরজার খিল ছাদের মেঝেতে ঠুকতে লাগলো। আওয়াজটা শুনে ওরা চুপ করে গেল। একজন বলল, গুরু ওরা ওপরে লুকিয়ে আছে, চলো গিয়ে দেখে আসি তো……… এরপর ওরা কয়েকজন সিঁড়ি দিয়ে ওপরের দিকে আসবে শুভ সেটা অনুমান করেছিল। শুভ হুলোবেড়ালটার ল্যাজে কিছুটা পেট্রোল ঢেলে দিল । বেড়াল, পেট্রোলের গন্ধ সহ্য করতে পারেনা।  পাগলের মতো সিঁড়ির দিকে ছুটে যেতে লাগলো, কয়েকজন উঠে আসছিল ওপরদিকে হাতে মোমবাতি জ্বেলে। বেড়ালটা ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আঁচড়ে কামড়ে দিল। মোমবাতিটা গেল নিভে। শুভ অন্ধকারে সেই খিলটা দিয়ে সিঁড়ির বাঁকে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল,ওদের কয়েকজন ওপর দিকে উঠছে, শুভ পায়ের আওয়াজে বুঝতে পারলো।  ও তখন এলোপাথাড়ি ঘোরাতে থাকলো  খিলটা। ঘুটঘুটে অন্ধকারে কিছুই দেখা যায়না। তবে বোঝা গেল খিলের আঘাতে তারা ধুপধাপ করে  সিঁড়ি থেকে পড়ে গেল। বাবাগো মাগো  বলে সব চিৎকার করতে করতে দৌড় দিতে গিয়ে একজন কলের চাতালে পড়ে গিয়ে মাথা ফাটাল। সে কি ভয়ঙ্কর অবস্থা! অন্ধকারের মধ্যে হৈচৈ, চিৎকার……   কিন্তু ওই অন্ধকারে কেউ শুভকে দেখতে পেলোনা। ওরা ভাবলো নিশ্চয়ই এটা ভুতের কাজ। বেড়ালটা তখনো দৌড়োদৌড়ি করছে পাগলের মতো। নিমেষের মধ্যে বাড়ি ফাঁকা হয়ে গেল। সব এদিক ওদিক দিয়ে পালাল।

ঘণ্টা দুয়েক পর শুভ, সাবিরকে ফোন করে বলল, সকাল হলে কাকু, কাকিমাকে নিয়ে সোজা লালবাজার যাবি। ওখানে পুলিশে ডাইরি করবি, আর পুলিশ ভ্যান নিয়ে আসার চেষ্টা করবি। বাড়ির অবস্থা দেখে ওনারা ঠিক সব বুঝতে পারবেন।

ফোনটা আসার পর থেকে সেই যে ঘুম ভাঙল সাবিরের, আর ঘুম আসেনা, আকাশ পাতাল চিন্তা হচ্ছে ওর। ভাবছে শুভ একা একা কি করছে কে জানে! ওরা সব সাংঘাতিক লোকজন, শুভকে একা পেয়ে যদি কিছু করে ! গা টা শিউরে উঠলো সাবিরের। পাশ ফিরে শুয়ে চোখ বুজে আল্লাহ্‌ কে স্মরণ করতে লাগলো।

সকাল হতেই সাবির ডেকে তুলল মা, বাবাকে। আজ মা,বাবাও যেন শান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছে, কোন সাড়া নেই, সাবির আব্বুর গায়ে একটা মৃদুভাবে ঠেলা দিয়ে বলল, উঠে পড়ো আমাদের আজ বাড়ি যেতে হবে, শুভ  ফোন করেছিল।  আনিকুল ধড়ফড় করে উঠে বলল, শুভ বেটা ঠিক আছে তো?!! সাবির বলল, সব ঠিক আছে। পাশে সাবিনা শুনছিল ওদের কথাগুলো। ওরা তিনজনে বের হবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে এমন সময় সৌরর মা এসে বলল,  এতো তাড়াতাড়ি কোথায় যাচ্ছেন? চা জল খাবার খেয়ে তারপর না হয়…… কথাটা শেষ হবার আগেই আনিকুল বলল, মেহেরবানী করে আজ আমাদের যেতে দিন, আবার একদিন ঠিক আসবো আপনার হাতের চা খেতে, কথা দিলাম। আজ বিশেষ প্রয়োজন আমাদের যেতেই হবে , শুভ কাল রাতে ফোন করেছিল। শুভর কথা শুনে সৌরর মা আর কথা বাড়াল না, বলল, ঠিক আছে আবার আসতে হবে কিন্তু। সাবিনাকে খুব ভালো লেগেছে আমার আর আপনাকেও। আনিকুল আর সাবিনা  হাতজোড় করে নমস্কার জানিয়ে বের হয়ে পড়লো।

রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বাসস্ট্যান্ডের দিকে যাবার সময় সাবির বলল, আগে আমাদের লালবাজার যেতে হবে। লালবাজারের নাম শুনে আনিকুল একটু  ভয় পেয়ে প্রশ্ন করলো, লালবাজার কেন? শুনে সাবির বলল, শুভ কাল আমাকে জানিয়েছে লালবাজারে গিয়ে একটা ডাইরি করতে হবে, এবং লোকাল থানাও যে শিবুর কাজকম্মের সাথে যুক্ত এটা জানাতে হবে।

শুভর কথা মতো সাবির লালবাজারে পৌঁছে গিয়ে অফিসারের সাথে দেখা করে সব জানালো। শুনে উনি তখনি একটা পুলিশ ভ্যান বের করতে বললেন এবং সাবিরদের নিয়ে রওনা হলেন।

দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো ভ্যানটা। গাড়ি থেকে সব একে একে নামলো সাবির, সাবিরের মা, বাবা, আরও তিনজন পুলিশ সাথে ওই অফিসার। বাড়িটাতে ঢুকেই বোঝা যাচ্ছিল কাল ত্যান্ডপ হয়েছে এখানে,  সাড়া বাড়ি মদের বোতল, মুরগির মাংস, চানাচুর সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। কলতলায় চাপ চাপ রক্ত। একজন পুলিশ, সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল ছাদে ওঠার জন্য, উঠতে গিয়ে দেখল সিঁড়িতে মোবাইল   আর মোমবাতি পড়ে আছে। সেগুলো তুলে নিয়ে এসে অফিসারের হাতে দিল।  অফিসার সেগুলো দেখে একটা প্লাস্টিক প্যকেটের ভেতর রেখে বলল, গাড়িতে রেখে আসুন। এরপর উনি লোকাল থানার অফিসারকে ফোন করে ডাক দিলেন। মিনিট পনেরোর মধ্যে লোকাল থানার অফিসার আসলেন, ওনাকে দেখেই সেই লালাবাজারের অফিসার বললেন শিবুর বাড়িতে নিয়ে চলুন আমাদের। গাড়িতে সবাই উঠে পড়লো গাড়ি স্টার্ট দিল……

যথা সময়ে শিবুর বাড়ির সামনে গাড়িটা দাঁড়ালো এবং শিবুকে এরেস্ট করে নিয়ে গেল। সাকরেদগুলোর  মধ্যে কয়েকটা হাসপাতালে ভর্তি হোল। কারোর মাথা ফেটেছে, কারোর নাক ফেটেছে। সবার নাম উঠলো লালবাজারের ডাইরির খাতায়।

এদিকে বাড়ি ফিরে ওরা তিনজনে এদিক ওদিক তাকিয়ে একেবারে স্থম্বিত!! কি অবস্থা বাড়িটার ! আনিকুল সাবিরকে বলল, তুই এখনি শুভকে ফোন কর আমি কথা বলবো, সাবির নম্বর মিলিয়ে ফোনটা বাবার হাতে দিল, হ্যালো শুভ বেটা, তুমি ঠিক আছ তো? ও প্রান্ত থেকে ভেসে এলো আমি ঠিক আছি  কাকু, আমাকে নিয়ে ভাব্বেন না। আপনাদের আর কেউ কোনদিন বিরক্ত করবে না সেই ব্যবস্থা করে দিয়েছি। আনিকুলের চোখে জল, বলল, আল্লাহ্‌ তোমায় অনেক দোয়া করবেন বেটা। একদিন এসো আমাদের বাড়ি। ওদিক থেকে শুভ বলল, আসবো কাকু।

সেদিনের সেই ঘটনার পর লোক মুখে প্রচার হয়ে যায় বাড়িটাতে ভুত আছে। বাড়িটা এখন সবাই ভুতেরবাড়ি বলেই জানে। আর কেউ কোনদিন ওদের বিরক্ত করতে আসেনি।

সাবির অনেকবার  জানতে চেয়েছিল শুভর কাছে, কিভাবে কি করলো ও। শুভ বলেছিল, সব ভুতে করেছে, আমি কিছু করিনি।

সেদিনের মার যে ভুতে দিয়েছিল সেটা সবাই বিশ্বাস করে।

————————————————————————
লেখক : শীলা ঘটক, কোচবিহার, কলকাতা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!