ব্রেকিং নিউজ
Home | দেশ-বিদেশের সংবাদ | অপেক্ষা বৃষ্টির, গন্তব্য বঙ্গোপসাগর

অপেক্ষা বৃষ্টির, গন্তব্য বঙ্গোপসাগর

নিউজ ডেক্স : বঙ্গোপসাগরে প্রবেশের অপেক্ষায় শহর ও শহরতলীসহ কক্সবাজার জেলার খাল-বিল ও নদী-নালাগুলোর টনকে টন প্লাস্টিক বর্জ্যের সারি। একটু ভারী বৃষ্টি হলেই ঢলের সাথে সেই বর্জ্যগুলো চলে যাবে সাগরে। সেখান থেকে একসময় জোয়ারের সাথে ভাসতে ভাসতে ফের আঁচড়ে পড়বে সমুদ্র সৈকতে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সরেজমিনে কক্সবাজার শহর ও শহরতলীসহ জেলার নালা-নর্দমা ও খাল-বিলগুলো পরিদর্শনে এমনই উদ্বেগজনক পরিস্থিতিই চোখে পড়ে।

কক্সবাজার শহরে ছোট-বড় ১৯টি খাল ও পাহাড়ি ছড়া রয়েছে, যেগুলো সরাসরি অথবা বিভিন্ন খাল ও নদী হয়ে সাগরে নেমে গেছে। এছাড়া জেলার চার পৌরসভা ও ৭১ ইউনিয়নে রয়েছে প্রায় চার শত খাল ও পাহাড়ি ছড়া। এসব খাল-নদী-ছড়া তীরকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠেছে লোকালয়। আর লোকালয়ের প্রায় সকল বর্জ্যই ফেলা হচ্ছে পার্শ্ববর্তী জলাধারগুলোতে।

পরিদর্শনে সমুদ্র তীরবর্তী হোটেল মোটেল জোনসহ কক্সবাজার শহরের অধিকাংশ এলাকার নালা-নর্দমা ছাড়াও সুদুর রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে ঈদগাঁও এর মুহুরী খাল পর্যন্ত প্লাস্টিক বর্জ্য ছাড়া পানির দৃশ্য আর চোখে পড়ে না।

দেখা যায়, প্লাস্টিক বর্জ্যে ভর্তি নালা-নদর্মাগুলো চরম দূষণ সৃষ্টির পাশাপাশি মশাসহ নানা জাতের কীটপতঙ্গের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। এসব নালা-নর্দমাতে প্রতিদিন কোটি কোটি মশা ডিস ছাড়ছে আর সে ডিমগুলো পূর্ণ বয়স্ক মশায় পরিণত হয়ে পর্যটকসহ স্থানীয় বাসিন্দাদের অতিষ্ঠ করে তুলছে। সম্প্রতি, এ কারণে এলার্জি ও সংক্রামক ব্যাধিসহ নানা ধরনের রোগব্যাধির বিস্তার বেড়েছে বলে মনে করছেন চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা। সেই সাথে খাল বিলের পানি বিষাক্ত হয়ে পড়ায় তা মানুষের পাশাপাশি পশু-পাখিদেরও ব্যবহারের অযোগ্য পড়েছে। পানি বিষাক্ত থাকায় সমুদ্র মোহনার নিকটবর্তী জেলার অধিকাংশ খাল এখন মৎস্যশূণ্য হয়ে হয়ে পড়েছে। ফলে এসব প্রাকৃতিক মৎস্য অভয়ারণ্যগুলোতে এখন মাছের পরিবর্তে উৎপাদিত হচ্ছে মশাসহ নানা কীটপতঙ্গ। গত ১২ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারে সী-উইডজাত পণ্য মেলার উদ্বোধনকালে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ.ম রেজাউল করিম বলেছিলেন, ভূমির বর্জ্য যাতে সরাসরি বঙ্গোপসাগরে যেতে না পারে তা বন্ধের উদ্যোগ নেয়া হবে। অনুষ্ঠানে পদস্থ সরকারী কর্মকর্তারা ছাড়াও কঙবাজারের জেলা প্রশাসক এবং জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা উপস্থিত ছিলেন। তবে এরপর প্রায় দুমাস সময় অতিবাহিত হলেও ভূমির বর্জ্যের সরাসরি সাগরে গমন রোধে কোনো ব্যবস্থা পরিলক্ষিত হয়নি বলে জানান পরিবেশবাদী সংগঠন ‘ইয়েস কঙবাজার’ এর প্রধান নির্বাহী ইব্রাহিম খলিল মামুন।

তিনি বলেন, একদিকে অপচনশীল প্লাস্টিক বর্জ্যে খাল-বিল-নালাগুলো বিষাক্ত হয়ে জীববৈচিত্র্যের বারোটা বাজাচ্ছে, অন্যদিকে মানবজাতির জন্য ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ বৃদ্ধিতে ব্যাপক সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।সাম্প্রতিককালে ভূমি বর্জ্যের কারণে সাগরে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াসহ বিভিন্ন জীবাণুর উপস্থিতি বেড়ে গেছে বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এ কারণে বঙ্গোপসাগরের প্রাণবৈচিত্র্য ঝুঁকির মুখে বলেও সতর্ক করছেন তারা।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞান ইন্সটিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. ওয়াহিদুল আলম বলেন, সম্প্রতি বিজ্ঞানীদের পরীক্ষায় চট্টগ্রাম ও সেন্টমার্টিন সমুদ্র সৈকতের পানিতে মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া ধরা পড়েছে। প্লাস্টিক বর্জ্যসহ নানা দূষণের প্রভাবে বঙ্গোপসাগরের প্রাণবৈচিত্র্য ঝুঁকির মুখে পড়েছে। এর নেতিবাচক প্রভাব আমাদের উপরই পড়বে। এজন্য আমাদের আরো সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

প্লাস্টিক বর্জ্যসহ নানা দূষণের কারণে দেশের একমাত্র প্রবালসমৃদ্ধ দ্বীপ সেন্টমার্টিনের প্রবালগুলো এবং এরসাথে সংশ্লিষ্ট প্রাণবৈচিত্র্য হারিয়ে যেতে বসেছে। এরফলে দ্বীপটি ক্ষয় বা ভাঙনের শিকার হয়ে দিনদিন ছোট হয়ে আসছে। তবে, সম্প্রতি সেন্টমার্টিনের বিশাল উপকূলীয় এলাকাকে মেরিন প্রটেক্টেট এরিয়া ঘোষণা এবং দ্বীপ রক্ষায় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় গৃহীত নানা পদক্ষেপের কারণে এখন পরিস্থিতি উন্নতি হচ্ছে বলে জানান বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দর।

প্রসঙ্গত, গত ১৯ মার্চ কঙবাজার শহরের কলাতলী সৈকতের প্রায় এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে দিন ও রাতের সামুদ্রিক জোয়ারের সাথে ভেসে আসে হাজার হাজার মরা মাছ। আবার পরদিন সকালে উখিয়ার পাটুয়ারটেক সৈকতে ভেসে আসে একটি মরা ডলফিন। প্রায় ২ বছর আগে ২০২০ সালের এপ্রিল মাসের শুরুতেও দুটি মরা ডলফিন ভেসে আসে টেকনাফ সৈকতে। এর কয়েকদিন আগে ডলফিন দুটিকে কঙবাজার শহরের কলাতলী সৈকতে খেলা করতে দেখা যায়, যা মোবাইলে ভিডিও করে প্রচার করেন অনেকেই। একই বছরের জুলাই মাসের ১১ ও ২৬ তারিখে কঙবাজার সৈকতের দরিয়ানগর থেকে হিমছড়ি পর্যন্ত প্রায় ৬ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে প্লাস্টিক বর্জ্যের পাহাড় আচঁড়ে পড়ে। একই সময়ে ভেসে আসে কয়েক ডজন মরা কাছিম, সামুদ্রিক সাপসহ নানা প্রাণী।

গতবছর এপ্রিল মাসের ৯ ও ১০ তারিখ পরপর দুদিনে দুটি মরা তিমি ভেসে আসে হিমছড়ি সৈকতে। আর এজন্য প্লাস্টিক বর্জ্যসহ নানা দূষণকেই দায়ী করছেন বিজ্ঞানীরা। দূষণের কারণে গত বছর টেকনাফ সৈকতে হার্মফুল এ্যালগাল ব্লুম বা ক্ষতিকর শৈবালের বিস্তার ঘটার কারণে কঙবাজার সৈকতেও লাল জোয়ার আচঁড়ে পড়ে। -আজাদী প্রতিবেদন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!