ব্রেকিং নিউজ
Home | দেশ-বিদেশের সংবাদ | সর্বস্তরের ভোটারের ভালোবাসায় সিক্ত মাশরাফি

সর্বস্তরের ভোটারের ভালোবাসায় সিক্ত মাশরাফি

114755Mash_narail

নিউজ ডেক্স : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা ও দেশপ্রেমের অনন্য নজির ক্রিকেট মাঠে বারবার অন্য এক উচ্চতায় স্থাপন করে চলেছেন মাশরাফি বিন মর্তুজা। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল পায় দুর্লঙ্ঘ্য এক সাহস। নড়াইলে জন্ম নিলেও মাশরাফি এখন পুরো দেশের মানুষের কাছে আস্থার প্রতীক।

দেশে বর্তমানে বইছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের উচ্ছল হাওয়া। এরই মধ্যে এক মাস আগে নড়াইল-২ আসনে বর্তমানে বাংলাদেশ ওয়ানডে ক্রিকেট দলের অধিনায়ক, নড়াইল এক্সপ্রেস খ্যাত মাশরাফি বিন মর্তুজাকে নৌকার প্রার্থী ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। ওই ঘোষণার পর গতকাল শনিবার প্রথম নির্বাচনী এলাকায় গেলেন নড়াইলবাসীর অতি প্রিয় মুখ নৌকার প্রার্থী মাশরাফি। প্রিয় মাশরাফি নড়াইলে আসছেন, এই সংবাদ জেনে নড়াইল সদর ও লোহাগড়ার মানুষ মেতে ওঠে উৎসবের আমেজ নিয়ে। সকাল থেকে ফুলের তোড়া, দলে দলে মিছিল করে মাশরাফিকে বরণ করে নিতে হাজির হয় হাজারো মানুষ মধুমতী নদীর কালনা ও শঙ্করপাশা ঘাটে। একসময়ের খরস্রোতা মধুমতীর যৌবন হারিয়ে গেলেও মাশরাফিকে ঘিরে গতকাল হাজারো মানুষের প্রাণবন্ত স্রোত ফের রূপ নেয় পুরনো খরস্রোতা মধুমতীর মতো। আওয়ামী লীগ ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সর্বস্তরের নড়াইলবাসী মাশরাফিকে বরণ করতে, একনজর দেখতে, হাজির হয় কালনা ও শঙ্করপাশা ঘাটসহ লোহাগড়া ও নড়াইল সদর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে। কালনা-যশোর মহাসড়কের দুই পাশে হাজার হাজার মানুষ দিনভর ফুলের তোড়া হাতে নৌকার স্লোগান দিয়ে মাতিয়ে তোলে সেখানকার পরিবেশ। এ সময় মাশরাফি হাত নেড়ে উপস্থিত সবাইকে শুভেচ্ছা জানান। কালনা ফেরিঘাট থেকে নড়াইল সদরে গাড়ি করে যেতে লাগে সর্বোচ্চ ২০ মিনিট। অথচ গতকাল উপস্থিত সর্বস্তরের ভোটারের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে মাশরাফির নড়াইল সদর পর্যন্ত পৌঁছাতে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে যায়।

ফরিদপুরের ভাঙ্গা-গোপালগঞ্জ মহাসড়কের কাশিয়ানী উপজেলার ভাটিয়াপাড়া গোলচত্বরে গতকাল দুপুরে ফুলের তোড়া, হাতে তৈরি নৌকা প্রতীক নিয়ে মাশরাফির জন্য অপেক্ষা করছিল দুই শতাধিক যুবক। সকাল ৯টা থেকে দুপুর পর্যন্ত ঠায় অপেক্ষার পরও কারো চোখে-মুখে ক্লান্তির ছাপ নেই। এই যুবকদের একজন শাখাওয়াত হোসেন। মাশরাফির দারুণ ভক্ত। বগুড়ার শাহজাহানপুরের শাখাওয়াত গত ১৬ ডিসেম্বর নড়াইলে এসেছেন মাশরাফির জন্য ভোট চাইতে। বুকে-পিঠে মাশরাফির ছবি সংবলিত ব্যানার, মাথায় লালসবুজের পতাকা বেঁধে মাশরাফির জন্য ভোট চাইছেন এই যুবক। গত এক সপ্তাহে নড়াইল সদর ও লোহাগড়া উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে বিরতিহীন তিনি মাশরাফির জন্য ভোট প্রার্থনা করে চলেছেন। নির্বাচন পর্যন্ত তিনি নড়াইলে থেকে মাশরাফির জন্য ভোট চাইতে ভোটারদের বাড়ি বাড়ি যাবেন।

বগুড়ার আযিযুল হক কলেজের ছাত্র মাশরাফি-পাগল শাখাওয়াত কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি ছোটবেলা থেকে মাশরাফি ভাইয়ের ভক্ত। নির্বাচন পর্যন্ত নড়াইলে থাকব। এর জন্য পরিবারের অনুমতি নিয়ে নড়াইলে এসেছি। মাশরাফির নির্বাচনী এলাকার প্রতিটি ইউনিয়নে গণসংযোগ করেছি। দেশপাগল, ক্রিকেটপাগল মাশরাফির জন্য ভোট চাইতে পেরে অনেক ভালো লাগছে।’

মহাসড়কের পাশেই হাতে ফুল নিয়ে বসে আছেন প্রতিবন্ধী মো. সাগর মিয়া। মাশরাফির কথা জানতে চাইলে সাগর বলেন, ‘মাশরাফি ভাইকে না দেখে গেলে পেটে একটা দানাও পড়বে না। উনার জন্য সকাল থেকে বসে আছি।’

সিলেটের জিন্দাবাজারের মিরা পাবলিকেশন লাইব্রেরির মালিক দিদার রহমানও মাশরাফির জন্য নড়াইলের ভোটারদের কাছে ভোট চাইতে এসেছেন। পাঁচ দিন ধরে লোহাগড়ায় থেকে তিনি মানুষের কাছে নৌকার জন্য ভোট চাচ্ছেন। দিদার রহমান বলেন, ‘তিনি মাঠে খেলছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে। পুরো দেশেই নির্বাচনে এমপি প্রার্থীরা নিজেদের জন্য ভোট চাইছেন। অথচ খেলার কারণে মাশরাফি তাঁর নির্বাচনী এলাকায় ভোট চাইতে পারছেন না। এ কারণে সিলেট থেকে মাশরাফির জন্য ভোট চাইতে নড়াইলে এসেছি।’

শাখাওয়াত হোসেন, দিদার রহমান, প্রতিবন্ধী সাগর এঁরাই নন শুধু, নড়াইল সদর আর লোহাগড়ার মানুষও শুধু নন, দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা অসংখ্য যুবককে স্বেচ্ছায় মাশরাফির হয়ে নৌকার পক্ষে কাজ করতে দেখা গেছে।

গতকাল দুপুর ২টায় মধুমতি নদীর শংকরপাশা ফেরিঘাটে মাশরাফির জন্য অপেক্ষা করছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজামউদ্দিন খান নিলু, সদর পৌরসভার মেয়র জাহাঙ্গীর হোসেন বিশ্বাস, লোহাগড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা চেয়ারম্যান সৈয়দ ফয়জুন আমির লিটু, উপজেলা যুবলীগের সভাপতি ও লোহাগড়া পৌর মেয়র আশরাফুল আলমসহ নড়াইল আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ  ও ছাত্রলীগের কয়েক হাজার নেতাকর্মী মাশরাফির জন্য অপেক্ষা করছিলেন। লোহাগড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল শিকদার বলেন, ‘আমাদের নেত্রী মাশরাফিকে প্রার্থী দিয়েছেন, তাঁকে বরণ করতে আমরা এখানে অপেক্ষা করছি। দল-মত-নির্বিশেষে নড়াইলের সর্বস্তরের মানুষ নৌকার জন্য মাঠে নেমেছে। বিপুল ভোটে পাশ করবেন মাশরাফি।’

লোহগড়ায় কালনা ফেরিঘাটের পাশে এক পথসভায় মাশরাফি বিন মর্তুজা স্থানীয় নেতাকর্মী ও ভোটারদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমি আসছি আপনাদের সঙ্গে দেখা করতে। নড়াইলের প্রতিটি ইউনিয়নে আমি যাব। সবার সঙ্গে কথা বলব। আমি আপনাদেরই সন্তান। আপনারা জানেন আমার প্রতীক হচ্ছে নৌকা। ইনশাআল্লাহ আপনারা নৌকায় ভোট দেবেন। আপনারা যোগ্য মনে করলে আমাকে নৌকায় ভোট দিয়ে বিজয়ী করবেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে আপনাদের সেবা করার সুযোগ দিয়েছেন। সে জন্য আমি প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই।’

লোহাগড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক শেখ সিহানুর রহমান বলেন, ‘এই আসনে মাঠে যুদ্ধ নেই। আমরা অপেক্ষায় আছি কত ভোটের ব্যবধানে মাশরাফিকে জেতানো যায়। ঘরের বউ-ঝিরাও মাঠে নেমেছে। কিশোর-তরুণরা দল বেঁধে ভোট চাইছে। ১৯৭১ সালের পর এমন উৎসবের আমেজে আর কোনো দিন ভোট করেনি নড়াইলবাসী। মাশরাফির জন্য সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করছে।’

নড়াইল সদর ও লোহগড়া উপজেলা সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, নড়াইল-২ আসনে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট সুভাষ চন্দ্র বোসসহ নৌকার টিকিট পেতে ১৬ জন জোর লবিং চালিয়ে গেলেও শেষ পর্যন্ত নৌকার টিকিট তুলে দেওয়া হয় মাশরাফির হাতে। আর মাশরাফিকে পেয়ে আওয়ামী লীগের সব মনোনয়নপ্রার্থীই এখন ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাশরাফিকে জেতাতে মরিয়া হয়ে কাজ করছেন। তবে সব কিছু ছাপিয়ে আলোচনায় উঠে এসেছে আরেকটি বিষয়, মাশরাফির শ্বশুরবাড়ির এলাকা লোহাগড়ায় বেশি ভোট পাবেন, নাকি নিজের জন্মভিটা নড়াইল সদরে বেশি ভোট পাবেন। দুই উপজেলায় মাশরাফিকে কত বেশি ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী করা যায়, তা নিয়ে চলছে উভয় উপজেলার মানুষের মধ্যে শীতল প্রতিযোগিতা।  মাশরাফির নিজের বাড়ি নড়াইল সদর উপজেলার মাইজপাড়া ইউনিয়নের চারিখাদা গ্রামে। আর শ্বশুরবাড়ি লোহাগড়া উপজেলার নোয়াগ্রাম ইউনিয়নের দেবীগ্রামে।

লোহাগড়ার সিঅ্যান্ডবি চৌরাস্তায় কথা হয় লোহাগড়া উপজেলার ইটনা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান ও সাংগঠনিক সম্পাদক সাইফুল ইসলাম শায়েখের সঙ্গে। মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘মাশরাফির বিজয় নিয়ে শঙ্কার কিছু নেই। কিন্তু কত ব্যবধানে বিজয়ী হবেন, সেটাই আমরা ভাবছি। মাশরাফির নিজের উপজেলার চেয়ে শ্বশুরবাড়ির উপজেলায় যেন বেশি ভোট পান সে জন্য আমরা ভোটারদের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরছি।’

ইটনা যুবলীগের সভাপতি প্রকাশ কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘নিজের উপজেলার চেয়ে শ্বশুরবাড়ির উপজেলায় দ্বিগুণের বেশি ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হবেন মাশরাফি। আমরা সেভাবেই কাজ করছি।’

মাশরাফির জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট চাইছেন মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ আনিসুর রহমান। তিনি নড়াইল সদর পৌর এলাকার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা। তিনি বলেন, ‘ক্রিকেট খেলে যে ছেলে দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে পারে, সেই মাশরাফি যদি আমাদের এমপি হয়, সেটা আমাদের নড়াইলবাসীর  সৌভাগ্য। নিশ্চয়ই নেত্রী মাশরাফিকে আরো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেবেন।’

নৌকার প্রার্থী মাশরাফিকে নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, সমর্থকদের মধ্যে নির্বাচনী উত্তেজনা বিরাজ করলেও বিএনপি জোটের প্রার্থী ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) চেয়ারম্যান এ জে এম ফরিদুজ্জামান ফরহাদের ধানের শীষ প্রতীকের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে পুলিশের ধরপাকড় এবং হতাশা ছড়িয়ে পড়েছে। মাশরাফিকে নিয়ে যেখানে দুই উপজেলার ভোটাররা উৎসবে মেতে উঠেছে, সেখানে ধানের শীষের প্রার্থী ফরহাদ গতকাল সকাল থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত নিজ বাড়িতেই শুয়ে-বসে দিন কাটিয়েছেন। জানতে চাইলে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রচারণায় নামার সুযোগ নেই। দিনে প্রচারণায় নামলে রাতেই পুলিশ অভিযান চালায় নেতাকর্মীদের বাড়িতে।’ বিএনপির নেতাকর্মীদের অভিযোগ, ধানের শীষের প্রার্থীর পোস্টার-ব্যানার ছিঁড়ে ফেলা হচ্ছে, প্রচারণায় নামতে দেওয়া হচ্ছে না।

তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বলছে, এনপিপির নেতার নামই অনেকে শোনেনি। মাশরাফির জনপ্রিয়তার কাছে ধোপে ঠিকছে না ধানের শীষ। প্রচারণায় বের হবে কিভাবে? দল-মত-নির্বিশেষে সবাই মাশরাফির নৌকার পক্ষে শামিল হয়েছে।

নির্বাচনী এলাকায় মাশরাফির ৫ পথসভা : নিজ এলাকায় নতুনরূপে মাশরাফি। প্রতিনিয়ত নড়াইলে এলেও এবারের আসা অন্য রকম। সংসদ সদস্য প্রার্থী মাশরাফি এলেন সুসজ্জিত দলীয় প্রতীক নৌকায়। গতকাল ভোর থেকে নড়াইলের কালনা ঘাটে মানুষের অধীর অপেক্ষা। চারদিক থেকে সবাই ছুটছে কালনা ফেরিঘাটে। নড়াইলের ঘরের ছেলে আজ (গতকাল) বাড়ি ফিরে আসছেন, নির্বাচনে অংশ নেবেন।

গতকাল  দুপুর ২টায় কালনা ঘাটে নেমে একটি সাজানো নৌকায় নড়াইলে পৌঁছেন তিনি। এ সময় কয়েক হাজার মানুষের চাপে আর ভক্তদের ভিড়ে কিছুটা অসুস্থ বোধ করেন তিনি। কালনা ঘাট থেকে সড়কপথে স্ত্রী-সন্তান, বাবাসহ হাজারো ভক্তের সঙ্গে নড়াইলে পৌঁছেন তিনি। এরপর কালনা ঘাটে স্থাপন করা মঞ্চে এক পথসভায় অংশ নিয়ে নিজের দেরিতে পৌঁছার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন।

গাড়িবহর এগিয়ে চলে ধীরগতিতে। এরপর কয়েকটি পথসভায় অংশ নেন তিনি। লক্ষ্মীপাশা, এড়েন্দা, দত্তপাড়া ও নাকশীতে পথসভায় যোগ দিয়ে নৌকা মার্কায় ভোট চান মাশরাফি। বিকেল ৫টায় নড়াইল পৌঁছে মাশরাফির গাড়িবহর। এরপর নড়াইল পুরনো টার্মিনালে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানান প্রথমবার জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেওয়া মাশরাফি বিন মর্তুজা। পরে জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে নেতাদের সঙ্গে সভা করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!