Home | দেশ-বিদেশের সংবাদ | শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ : গরমের আরাম ডাকছে বিপদ

শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ : গরমের আরাম ডাকছে বিপদ

নিউজ ডেক্স : বাসাবাড়ি, অফিস বা বিপণিবিতানে গরম থেকে স্বস্তির জন্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের চাহিদা যখন ক্রমশ বেড়েই চলেছে, তখন ঘর শীতল করার এই যন্ত্রের মাধ্যমে আশপাশের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও সার্বিক পরিবেশের ক্ষতি নিয়ে সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, এসি ঘরকে ঠাণ্ডা করলেও বাইরের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়। কোনো একটি নির্দিষ্ট এলাকায় বিপুল সংখ্যক এসির ব্যবহার পুরো এলাকার গড় তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে। তাছাড়া এসি থেকে নির্গত গ্যাস পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

এক সময় এয়ার কন্ডিশনার বা শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র বিলাসিতা হলেও এখন উচ্চ মধ্যবিত্তের ঘরেও এ যন্ত্র অনেকটা ‘স্বাভাবিক’ হয়ে উঠেছে। গরম পড়তে না পড়তেই এসি ও কুলার কেনার হিড়িক দেখা যায় শহরগুলোতে। শীতাতপ সুবিধা ছাড়া শহরে গাড়ি, দোকান, সিনেমা হল, হোটেল, রেস্তোরাঁ এখন কল্পনাই করা যায় না।

গত বছর চৈত্র-বৈশাখের গরমে অতিষ্ঠ হয়ে শেষমেশ এসি কেনেন রাজধানীর মগবাজারের বাসিন্দা লুৎফর রহমান। ঢাকার ইসলামপুরে কাপড়ের ব্যবসা আছে তার। সামর্থ্য অনুযায়ী নিজের ও মেয়ের ঘরের জন্য দুটো এসি কেনেন তিনি। তিনি বলেন, ঢাকা শহরে এত জ্যাম, বাইরে এত গরম; গরমের দিনে ঘরেও টেকা মুশকিল। আমার বাসা টপ ফ্লোরে। বাচ্চারা অসুস্থ হয়ে যায়। তাই গতবছর বৈশাখ মাসে দুই রুমের জন্য দুইটা এসি কিনে ফেলি। তবে ওই এসি কী করে পরিবেশের ক্ষতি করতে পারে, সে বিষয়ে একদমই অবগত নন লুৎফর। তিনি বলেন, এসি ব্যবহার করাটা দরকার, তাই ব্যবহার করি। এটা যে পরিবেশের জন্য কেন ক্ষতিকর, তা জানা নাই। পরিবেশের ক্ষতির কথা জানলেও গরম থেকে রেহাই পেতে এসির কোনো বিকল্প দেখছেন না পূর্ব রামপুরার তুনাজ্জিনা জাহান। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত তুনাজ্জিনা বলেন, আমি জানি এসি ব্যবহারে লং টার্মে পরিবেশের ওপর একটা খারাপ প্রভাব পড়ে। কিন্তু ঢাকা শহরের ভ্যাপসা গরম অসহ্য হয়ে ওঠায় এসি ব্যবহারের আসলে আর কোনো বিকল্প নেই। আমি গরম একেবারেই সহ্য করতে পারি না। গরম ও ঠাণ্ডা দুই আবহাওয়াতেই এলার্জি আর হাঁচি-কাশির সমস্যা রয়েছে এই তরুণীর। গরমে দিনের কিছুটা সময় এসি চালিয়ে রাখেন, আর রাতে এসি চালিয়েই ঘুমান।

বাড়ির আটটি কক্ষের মধ্যে পাঁচটিতেই এসি রয়েছে জানিয়ে তুনাজ্জিনা বলেন, যদিও একেক সময় একেক রুমে এসি চালু থাকে, কিন্তু গরমের সময়ে রাতের বেলায় সবগুলো রুমেই এসি অন রাখা হয়। চাহিদা বাড়তে থাকায় এখন সামর্থ্য বুঝে কম থেকে বেশি দামের এসি মিলছে বাজারে। ক্রেতাদের প্রযুক্তি নিয়ে তেমন ধারণা না থাকায় দামে পোষালেই এসি কিনে নিচ্ছেন। এ নিয়ে সতর্ক করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সস্তা প্রযুক্তির এসিতেই বেশি ক্ষতি হচ্ছে পরিবেশের।

এসি ঘরকে শীতল করলেও বাইরের বাতাসকে কী করে গরম করে তুলছে, তা ব্যাখ্যা দিলেন স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার। তিনি বলেন, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের স্বতঃস্ফূর্ত ব্যবহার তিনভাবে পরিবেশের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে; প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ এবং এসির বাইপ্রোডাক্টের মাধ্যমে।

তিনি বলেন, পুরো ধানমণ্ডি এলাকায় এক হাজার ১৬৮টি দালান রয়েছে। প্রতিটিতে গড়ে দশটি করে ফ্লোর ধরা হলে তার সংখ্যা দাঁড়ায় ১১ হাজারের বেশি। একটি ফ্লোরে কমপক্ষে দশটি এসি থাকলে ধানমণ্ডি এলাকাতেই এসি থাকে এক লাখের বেশি। প্রতিটি এসি যদি এক বর্গফুট এলাকাকেও উত্তপ্ত করে তবে এই এক লাখ এসি এক লাখ বর্গফুট এলাকাকে উত্তপ্ত করে দিচ্ছে। এসির ব্যবহার বাড়তে থাকায় বিদ্যুতের ওপরও যে চাপ পড়ছে, সে কথাও বলেন অধ্যাপক কামরুজ্জামান।

তিনি বলেন, একটা বাসায় লাইট-ফ্যান দিয়ে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ ব্যবহার হয়, তার কয়েক গুণ বেশি খরচ হয় এসিতে। লাইট-ফ্যানের বিল যদি এক হাজার টাকা আসে, এসি ব্যবহারে সেই বিল হবে সাড়ে তিন থেকে চার হাজার টাকা; অর্থাৎ ইলেকট্রিসিটি কনজিউম হচ্ছে। ফলে এটি আমাদের মোট বিদ্যুৎ ব্যবহারের ওপর একটা চাপ সৃষ্টি করছে। বিদ্যুতের চাহিদাও বেড়ে যাচ্ছে। সেটা মেটাতে সরকার বিভিন্ন পাওয়ার প্ল্যান্ট তৈরি করছে, সেগুলোও আবার পরিবেশের একটা বিরাট অংশের ক্ষতি সাধন করছে।

এসিতে ব্যবহার হওয়া গ্যাস রেফ্রিজারেন্ট নামে পরিচিত। নব্বইয়ের দশকেও এসিতে ক্লোরোফ্লুরোকার্বন (সিএফসি) রেফ্রিজারেন্ট ব্যবহার হত, যা ফ্রেয়ন বা আর-২২ নামেও পরিচিতি। বায়ুমণ্ডলের ওজন স্তরের ওপর এই গ্যাসের বিরূপ প্রভাব নিয়ে শঙ্কার প্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র ২০১০ সাল থেকে দেশটির বিশুদ্ধ বাতাস নীতিমালার অধীনে আর-২২ গ্যাসের উৎপাদন ও আমদানি বন্ধ করে। যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশ সুরক্ষা সংস্থা ইপিএ বলছে, নব্বইয়ের দশকে দেশটিতে সিএফসির ব্যবহার বন্ধ হয়। এখন তারা হাইড্রোক্লোরোফ্লুরোকার্বন (এইচসিএফসি) বন্ধের পর্যায়ে রয়েছে।

ওজন স্তরের সুরক্ষায় ভিয়েনা কনভেনশনের অধীনে ১৯৮৭ সালে মন্ট্রিয়ল প্রটোকল নামে আন্তর্জাতিক চুক্তি হয়। এতে শিল্পায়নের কারণে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সিএফসি ও এইচসিএফসির মত পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক রাসায়নিক গ্যাসের ব্যবহার বন্ধের সিদ্ধান্ত রয়েছে। বাংলাদেশ ১৯৯০ সালে এই চুক্তিতে সই করে। ২০১৮ সালে ওজন স্তরের ক্ষয় রোধে মন্ট্রিয়ল প্রটোকল বাস্তবায়নে নেওয়া বিভিন্ন কার্যক্রমের সফলতায় বাংলাদেশকে সার্টিফিকেট অফ অ্যাপ্রিসিয়েশন অর্থাৎ প্রশংসা সনদ দেয় জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি (ইউএনইপি)।

তবে হাইড্রোফ্লুরোকার্বনের (এইচএফসি) ব্যবহার এখনও বাংলাদেশের পরিবেশের ক্ষতি করে যাচ্ছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন-বাপার যুগ্ম সম্পাদক অধ্যাপক কামরুজ্জামান মজুমদার। তিনি বলেন, এসি তৈরিতে যে পরিমাণ কার্বন ব্যবহার করা হয়, যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ হয়, সেটা গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের ক্ষেত্রে বিশাল ভূমিকা রাখে। এসির লাইফটাইম শেষ হয়ে গেলে তখনও ওই এসিতে যে ক্ষতিকর গ্যাস ব্যবহার করা হয় সেগুলো নিঃসরিত হয়।

শহরের আবাসিক এলাকাগুলোতে রাতেও তাপমাত্রা বেশি থাকার কারণ হিসেবে এসিকে দায়ী করে তিনি বলেন, যেখানে দিনের চেয়ে রাতের তাপমাত্রা কম থাকার কথা, রাতের বেলা এসি ব্যবহারের কারণে আরবান হিট আইল্যান্ডের প্রভাবে সেসব এলাকায় রাতেও তাপমাত্রা বেশি থাকে। মহামারীর এই সময় ঘরে এসি চালু রাখা বাড়তি স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করছে বলেও সতর্ক করেন তিনি।

এই অধ্যাপক বলেন, ভাইরাসের জীবনকাল আর্দ্রতার ওপর নির্ভরশীল। এসি ছাড়ার ফলে একটি কক্ষের আর্দ্রতা তুলনামূলকভাবে বেড়ে যায়। এতে করে তা করোনা ভাইরাসের জীবনকাল বৃদ্ধি করে এর প্রোটিনকে বাঁচিয়ে রাখে। এছাড়া এসি ব্যবহারে রুমের ভেতরে যেভাবে এয়ার সার্কুলেশন হয়, তাতে রুমের একজনের সংক্রমণ হয়ে থাকলে তার মাধ্যমে এসির বাতাসে পুরো রুমের সবার আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

এসিতে ক্ষতিকারক গ্যাস এইচএফসির ব্যবহার বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বলে জানালেন পরিবেশ অধিদপ্তরের বায়ুমান ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিচালক জিয়াউল হক। তিনি বলেন, বাংলাদেশে ‘শিগগিরই’ পরিবেশবান্ধব শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ব্যবহারের পরিকল্পনা রয়েছে। এইচএফসি গ্যাসের বদলে পরিবেশবান্ধব গ্যাস ব্যবহারে দেশের এসি ও রেফ্রিজারেটর প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলোকে ইতোমধ্যে নির্দেশনা দেওয়ার কথা জানিয়েছেন তিনি। আগামী বছরের জানুয়ারি মাস থেকে এসি উৎপাদনের ক্ষেত্রে এই নির্দেশনা কার্যকর হবে, বলেন পরিবেশ অধিদপ্তরের এই কর্মকর্তা। একই সঙ্গে বাংলাদেশে ২০৪৫ সালের মধ্যে সিএফসি গ্যাসের ব্যবহার ৯৭ দশমিক ৫ শতাংশ কমিয়ে আনার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে বলে জানান জিয়াউল। খবর বিডিনিউজের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!