ব্রেকিং নিউজ
Home | উন্মুক্ত পাতা | লোহাগাড়ার পক্ষাঘাতগ্রস্থ যুবক শহিদুল ইসলামের স্বপ্নের দ্বীনি প্রতিষ্ঠান

লোহাগাড়ার পক্ষাঘাতগ্রস্থ যুবক শহিদুল ইসলামের স্বপ্নের দ্বীনি প্রতিষ্ঠান

log

মোঃ জামাল উদ্দিন : লোহাগাড়ার রশিদার পাড়ার আবু বকর ছিদ্দিক বাদশার পুত্র মুহাম্মদ শহিদুল ইসলাম (৩৭) একজন পক্ষাঘাতগ্রস্থ যুবক। তিনি লোহাগাড়ার পশ্চিম রশিদার পাড়ায় একটি দ্বীনি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে এলাকার ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদেরকে দ্বীনি শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন। দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণে তাঁর এ আত্মনিবেদন এলাকায় প্রশংসা কুড়িয়েছে। প্রতিদিন শিক্ষার্থীদের কলকাকলিতে মুখরিত থাকে প্রতিষ্ঠানটি। পক্ষাঘাতগ্রস্থ যুবক শহিদুল ইসলামকে একজন মালীর সাথে তুলনা করছেন। প্রতিষ্ঠানটি যেন একটি ফুলের বাগান। শিক্ষার্থীরা এ বাগানের নানা রকম ফুল। প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা জানালেন, তিনি এখানে এসে অত্যন্ত স্বাচ্ছন্দবোধ করেন। এটি লোহাগাড়া, আধুনগর ও আমিরাবাদ ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী বাইর খালের তীরে অবস্থিত। অত্যন্ত মনোরম পরিবেশ। মাদ্‌রাসা থেকে দক্ষিণে শাহপীর রোড পর্যন্ত এবং উত্তরে রশিদার পাড়া পর্যন্ত সড়কটি সর্পিল গতিতে চলে গেছে। শিক্ষার্থীরা নির্বিঘ্নে সড়ক অতিক্রম করে প্রতিষ্ঠানে যাতায়াত করেন। দক্ষিণ জেলা আওয়ামীলীগের উপ–প্রচার সম্পাদক মাওলানা নুরুল আবছারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় রাস্তাটি নির্মিত হয়েছে বলে এলাকাবাসীরা জানিয়েছেন। আগে এ স্থানে কোন প্রতিষ্ঠান না থাকায় এলাকার অসংখ্য শিক্ষার্থীরা ঝরে যেত। প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার পর তা আর নেই। স্থানীয় একটি অনলাইন পত্রিকার কর্মাধ্যক্ষ মারুফ খানকে সাথে নিয়ে এ প্রতিবেদক মাদরাসা চত্বরে গিয়ে শিক্ষক–শিক্ষার্থীদের কর্মতৎপরতা দেখে অবাক হয়ে যান। প্রতিষ্ঠানটি ২০১৩ সালে মাত্র ৬৫ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২১৩ জন। শিক্ষকের সংখ্যা ৮ জন। তারমধ্যে ৪ জন পুরুষ ও ৪ জন মহিলা। মাদ্‌রাসাটি ১১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি দ্বারা পরিচালিত হয়। শিক্ষকদের মধ্যে একজন প্রতিবন্ধী রয়েছেন। প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠার গল্প অত্যন্ত চমৎকার। প্রতিষ্ঠাতা জানালেন, তিনি পক্ষাঘাতগ্রস্থ যুবক ছিলেন না। ১৯৯৯ সালে দুঃস্কৃতিকারীদের আক্রমণে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিলেন। তাঁর পিতা একজন লব্দ প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। তখন তিনি কোমলপানীয় ব্যবসায় জড়িত ছিলেন এবং একটি নামকরা কোম্পানীর এজেন্ট ছিলেন। দুঃস্কৃতিকারীরা যুবক শহিদুল ইসলামকে ঘাড়ে ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত করে পালিয়ে যায়। দীর্ঘদিন তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন। এক পর্যায়ে তার শরীরের স্পাইনাল (স্নায়ু) ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং বুক থেকে নিচের দিকে অবস হয়ে যায়। তখন তিনি দুনিয়াকে নতুনভাবে উপলব্ধি করতে শেখেন। তিনি ভাবেন এ সংসার অসার। মানুষ আসে, মানুষ চলে যান। কিন্তু দাতব্য প্রতিষ্ঠান চিরদিন থেকে যায়। তিনি এ বোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে হতোদ্যম হনননি। রশিদার পাড়ায় একটি মুদির দোকান প্রতিষ্ঠান করে সেখানে ব্যবসা–বাণিজ্য চালাতে থাকেন। সুস্থ অবস্থায় আলহাজ্ব মোস্তাফিজুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের এইচএসসি প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন। লেখাপড়া বন্ধ হওয়ায় তিনি তাঁর গ্রহণ করা শিক্ষার আলো মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার ব্রত নেন। তিনি দেখতে পান অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা কষ্ট করে হলেও প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের জন্য পাশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যায়। কিন্তু ধর্মীয় শিক্ষায় অনেকে ছেলে– মেয়েদেরকে শিক্ষিত করেন না। প্রতিষ্ঠান নেই বলে। তাই তিনি তাঁর জমানো টাকায় একটি মাদ্‌রাসা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। তাঁর এ কর্মকান্ডে বর্তমান লোহাগাড়া উপজেলা পরিষদ ভাইসচেয়ারম্যান অধ্যাপক নুরুল আবছার এগিয়ে আসেন। তারই বদান্যতায় তদানীন্তন উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ ফিজনুর রহমান সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। উপজেলা উন্নয়ন তহবিল থেকে কিছু অনুদান দেয়া হয়। তবে প্রতিষ্ঠানটি সম্পূর্ণ ব্যয়ভার নির্বাহ করেন এ যুবক। মাদ্‌রাসাটি বর্তমানে ৬ষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত চালু আছে। পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত কোন বেতন নেয়া হয় না। ভবিষ্যতে তিনি উক্ত মাদ্‌রাসাটি দাখিল পর্যন্ত উন্নীত করতে আশাবাদী। তাকে এ প্রতিবেদক প্রতিবন্ধী কিনা জানতে চাইলে তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, লোহাগাড়ায় প্রতিবন্ধী থাকলেও তিনি প্রতিবন্ধী নন। তবে চলৎশক্তিহীন এক যুবক মাত্র। পক্ষাঘাতগ্রস্থ মানুষ হিসাবে তিনি নিজের জীবন অতিবাহিত করতে চান। সংসার ও বিয়ে–সাদী সদূর পরাহত। তাঁর এ জীবনে কেউ সঙ্গী হিসাবে নিজেকে সমর্পিত করবেন এমনটাই তিনি আশা করেন না। তবে মৃত্যুর পরে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাই হবে তাঁর অন্যতম শুভার্থী। তারা তাঁর আত্মার মাগফেরাতের জন্য আল্লাহর কাছে দু’হাত তুলে মোনাজাত করবেন এবং তিনি পরকালে শান্তি লাভ করবেন। অনেক সময় প্রতিবন্ধীদেরকে নিয়ে লোহাগাড়ার একটি চিহ্নিত মহল ব্যবসা করেন। প্রতিবন্ধীদেরকে তুচ্ছ–তাচ্ছিল্য করা হয়। একটি কম্বল দেয়ার নাম করে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে সুদূর গ্রাম থেকে অন্য আরো সবল দু’ব্যক্তির সাহায্য লোহাগাড়া সদরে নিয়ে আসেন। দেড়শ টাকার কম্বলের জন্য তিন ব্যক্তিকে সারাদিন বসিয়ে রাখা হয়। তাই তিনি মনে করেন প্রতিবন্ধীর হাত যেন ভিক্ষার হাতের বদলে কর্মের হাত হয়। এভাবে নতুনভাবে চিন্তাভাবন করতে হবে। সাংবাদিকদের এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালনের জন্য আহবান জানান। তাঁর মতে শিক্ষা মানুষকে কল্যাণের পথে, শান্তির পথে নিয়ে আসতে পারে। তাই প্রতিবন্ধীদেরকে অবশ্যই দ্বীনি শিক্ষায় শিক্ষিত করার প্রয়োজন রয়েছে। তাঁর প্রতিষ্ঠানে এ যাবৎ কোন দানশীল ব্যক্তি পদার্পণ করেননি। তিনি বলছেন, আমি অত্যন্ত প্রচারবিমুখ মানুষ। প্রচারে আমি বিশ্বাস করি না। তবে কাজ করে যাব। নীরব ফল্গুধারার মতো। যেখানে এক কালে এলাকার বাইর খালের সাথে মানুষের অশিক্ষার অশ্রুধারা একাকার হয়ে যেত। সেখানে যদি নতুন আলোর ঝর্ণাধারা প্রবাহিত হয় সেটাই হবে আমার অন্যতম তৃপ্তি। প্রতিষ্ঠানটি দেখতে গিয়ে আপনার বেগ পেতে হবে না। লোহাগাড়া রশিদার পাড়া রাস্তা ধরে সামান্য পশ্চিমে গিয়েই ডানে বাঁক ঘুরলেই মাদ্‌রাসাটি দেখতে পাবেন। অথবা শাহপীর সড়কে মনুফকিরহাটমুখী পথে সামান্য পশ্চিম দিকে গেলেই হাতের ডান দিকে বাইরখালের তীরে এ প্রতিষ্ঠানটি আপনাকে হাতছানি দিবে। আপনি অবিভূত হবেন। আর ভাববেন মানুষের ইচ্ছা শক্তিই যথেষ্ট। ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। তার জলন্ত উদাহারণ পক্ষাঘাতগ্রস্থ শহিদুল ইসলামের প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান “নূরীয়া হযরত আয়েশা ছিদ্দিকা (রাঃ) মহিলা মাদ্‌রাসা”।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!