নিউজ ডেক্স : মর্জিনা বেগম বাংলাদেশের কক্সবাজারে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির কুতুপালং ক্যাম্পে থাকেন। গত মাসেই ১৪ বছর বয়সী মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন তিনি।
মর্জিনা বলেন, ‘মাইয়ারা সহরে সহরে বিয়া দিলে হিয়ান হইলো সুন্নত।’ নিজের ভাষায় সরল উত্তর। তিনি বলছেন, মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়া সুন্নত। তিনি আরও বলেন, ‘বার্মার দেশের লোকেরা ছেলে মাইয়ারে সকালে সকালে বিয়া দিয়া দেয়। বাংলাদেশের এলাকাতে হইলো ছোট মাইয়াগো বিয়া দেয় না। তাগো পড়ালেখা করায়। বার্মার দেশের লোকেরা এডি চায় না।’
জিজ্ঞেস করেছিলাম কেন? কিন্তু সেই কেন’র কোনও উত্তর পাওয়া গেল না কুতুপালং ক্যাম্পে।মর্জিনা বেগম যেমন সহজ করে বলছিলেন তেমনি সহজ করেই ‘কেন’ প্রশ্ন শুনে হাসতে আরম্ভ করলেন। মেয়েদের আগেভাগে বিয়ে দেওয়া প্রসঙ্গে আলাপ তুলতে গিয়ে এমন প্রতিক্রিয়া বেশ পাওয়া গেল সেখানে। ক্যাম্পে চোখে পড়লো বাচ্চা কোলে অসংখ্য কিশোরীর। বাল্যবিয়ে হয়তো তাদের সামাজিক ও ধর্মীয় রীতি। তবে ভিন্ন কারণও পাওয়া গেল প্রচুর।
মোহাম্মদ সেলিম গত অক্টোবরে মিয়ানমারের কারারুপাং এলাকা থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছে। ঠাঁই নিয়েছেন কুতুপালং ক্যাম্পে। অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত পরিবারের এই তরুণ বলছেন তারা যখন মিয়ানমারে বসবাস করতেন তখন থেকেই রোহিঙ্গাদের মধ্যে মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়ার প্রচলন।
যার মূল কারণই হলো নিরাপত্তা। বাংলাদেশে আসার পরও সেটিই বড় কারণ হিসেবে রয়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘যদি আমার বোনটাকে আমি বিয়ে না দেই, তাহলে সে এদিক ওদিক চলাফেরা করবে আর ওরা ওর গায়ে হাত বাড়াবে।’ তাই আমরা তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দেই। তাতে করে সে তার শ্বশুর বাড়িতে থাকবে। বাজারে যাবে না, এদিক ওদিক যাবে না। আমরা আমাদের ইজ্জতের জন্য এইটা করতেছি।’
কিন্তু অভাব, অনিশ্চয়তা আর রোহিঙ্গা শিবিরগুলোর ভয়াবহ ঘনবসতি সম্পর্কে বলছিলেন কুতুপালং শিবিরের মসজিদে আকসার ইমাম আক্তার হোসেন। তিনি বলেন, ‘এরকমও কিছু পরিবার আছে যাদের ১০-১১ জনের পরিবার। ছোট বাসায় দেখা যায় দুইজন যুবক ছেলে আর দুইজন যুবক মেয়ে। তখন তাদের দুইটি আলাদা রুম দিতে হয়।’
আক্তার হোসেন আরও বলেন, ‘এত ছোট বাসা সেজন্য কিছু লোক মনে করে একটা মেয়ে উপযুক্ত হইয়া গেছে। ওদের যদি আমি বিবাহ দিতে পারি তাহলে কিছুটা সুবিধা হবে।’
এর কিছুটা ধারনা পাওয়া গেলো মুসতফা খাতুনের ঘরে গিয়ে। বড়োজোর ১০ ফুট আকারের একটি ঘরে থাকছেন তিনি ও তার ১০ জনের পরিবার। বছরখানেক আগে মিয়ানমারের নাসাগ্রো এলাকা থেকে তিন দিন হেঁটে বাংলাদেশে এসেছেন সবাই।
ঘরে কোনও আসবাব নেই। মাটির ওপর পাটি পেতে রাখা। মুসতফা খাতুন বলেন, বাল্যবিয়ের ক্ষতি সম্পর্কে তিনি ঠিকই জানেন। তিনি বলেন, ‘আমরা সবই জানি কিন্তু কি করবো ছেলেমেয়েরা তো আজকাল পছন্দ করেই বিয়ে করে ফেলছে।’ তার ১৫ বছর বয়সী কিশোরী মেয়ে নিজে পছন্দ করে যে ছেলেকে বিয়ে করেছে তার বয়স ১৭ বছর।
রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে কথা বলতে গিয়ে ছেলেমেয়েদের নিজেদের পছন্দে বিয়ে করে ফেলার প্রসঙ্গটি বার বার এলো। কিন্তু রোহিঙ্গাদের মধ্যে বাল্যবিয়ের হার আসলে কতটা- তা নিয়ে কোনও সংস্থাই সেভাবে তথ্য দিতে পারেনি। তবে রোহিঙ্গাদের মধ্যে বাল্যবিয়ের হার অনেক বেশি বলে মনে করছেন উন্নয়নকর্মীরা।
কক্সবাজারে ইউনিসেফের কর্মকর্তা অ্যলেস্টেয়ার লসন ট্যানক্রেড। তিনি বলেন, ‘আপনি জানেন রোহিঙ্গারা সামাজিকভাবে বেশ রক্ষণশীল এবং তার যদি একটি ধারণা দেই; আমি সেদিনই ক্যাম্পে গিয়েছিলাম। সেখানে ছয়জন ইমামের সঙ্গে আমার কথা হচ্ছিল। তারা সবাই একমত যে প্রথমবার মাসিক হওয়ার পর মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া একদম গ্রহণযোগ্য।’
আর যেহেতু বাল্যবিয়ের ক্ষেত্রে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের আইনের আওতায় পড়েন কিনা তা নিয়ে দ্বিধা রয়েছে তাই এমন বিয়ে প্রতিরোধ করাও কর্তৃপক্ষের জন্য মুশকিল বলে মনে করছেন ইউনিসেফের এই কর্মকর্তা।
ট্যানক্রেড বলেন, ‘যদিও বাংলাদেশে বাল্যবিয়ে আইনিভাবে নিষিদ্ধ কিন্তু ক্যাম্পে যেরকম অনানুষ্ঠানিকভাবে বিয়েটা হয়, সেখানে এমন আইন প্রয়োগ করা খুবই কঠিন। দেখা যায় ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আয়োজন করে একটা বিয়ে হয়ে গেল। তবে রোহিঙ্গাদের বাল্যবিয়ে নিয়ে জ্ঞান দেওয়ার আগে আমাদের সতর্ক হতে হবে। এটা সত্যি যে তারা ভয়াবহ অনিশ্চিত জীবনযাপন করছে। আমাদের চোখে বাল্যবিয়ে যত জঘন্য মনে হোক না কেন ক্যাম্পের জীবন নিরাপত্তাহীন সেটি তো সত্যি।’
তবে রোহিঙ্গারা বাল্যবিয়ে নিয়ে এখন অন্তত খোলামেলা কথা বলছেন। মসজিদে পুরুষদের জন্য সেনিয়ে বয়ান দেওয়া হচ্ছে। নারীদের সংগেও কথাবার্তা বলার নিরাপদ জায়গা তৈরি করা হয়েছে সকল ক্যাম্পে। মর্জিনা বেগমের মতো নারীরাই সেখানে অংশ নেন। ক্যাম্পের কমিউনিটি সেন্টারে এসব নিয়ে নাটিকা গান বাজনাও হয়। -বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন