Home | দেশ-বিদেশের সংবাদ | রায়হানের কাছে সব বাধাই তুচ্ছ!

রায়হানের কাছে সব বাধাই তুচ্ছ!

b28ad09cff09c54c27dba4dec713111b-58e53e891a05f

প্রথম আলো : এক হাত নেই। কাটা পড়েছে আরেক হাতের কনুই পর্যন্ত। দারিদ্র্যও থামাতে চেয়েছে বারবার। মনোবল আর সাহস যাঁর সঙ্গী, তাঁকে ঠেকায় কার সাধ্য! বাহার উদ্দিনের কাছে পরাস্ত হয়েছে সব বাধা। মুখ ও হাতের কনুই দিয়ে লিখেই পাস করেছেন উচ্চমাধ্যমিক। থেমে থাকেননি। এখন তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হয়েছেন কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ইতিহাস বিভাগের স্নাতক প্রথম বর্ষে।
বাহার উদ্দিন সবার কাছে পরিচিত রায়হান নামে। বাড়ি কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার লক্ষ্যারচর ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের জহিরপাড়ায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার জন্য এখন তিনি শহরবাসী। নগরের নতুন ব্রিজ এলাকায় আত্মীয়র বাড়িতে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াত করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা-যাওয়াও তাঁর জন্য কম ঝক্কি নয়। প্রথমে টেম্পোতে নতুন ব্রিজ থেকে দুই কিলোমিটার দূরত্বের বটতলী রেলস্টেশনে, এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটল ট্রেন। এভাবেই ২৫ কিলোমিটার দূরের ক্যাম্পাসে আসা-যাওয়া তাঁর।
এত কষ্ট করে লেখাপড়া? রায়হানের মুখে হাসি। বললেন, ‘কই কষ্ট। পড়াশোনা না করলে ক্যারিয়ার গড়ব কীভাবে।’ কথাগুলো বলার সময় তাঁর কণ্ঠ দৃঢ়। রায়হানের সঙ্গে কথা হয় গত মঙ্গলবার দুপুরে প্রথম আলোর চট্টগ্রাম কার্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেড়টার ট্রেনে ফিরেছেন।
রায়হান বলেন, ‘জন্মের আগে হারিয়েছি বাবাকে। অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী। হাত হারানোর পরও আমি বসে থাকিনি। কিছু না কিছু নিয়ে ব্যস্ত থেকেছি।’

পাখি দেখতে জীবন বিপন্ন

২০০৪ সালের ৩০ অক্টোবর। বিকেল সাড়ে পাঁচটা। সেদিন ছিল শবে বরাত। রায়হান তখন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। দুরন্তপনায় মাতিয়ে রাখতেন পাড়া। জহিরপাড়ায় পল্লী বিদ্যুতের সরবরাহ লাইন টানা হয়েছে সবে। গ্রাহকদের বিদ্যুৎ–সংযোগ দেওয়া হয়নি। বাড়ির পাশে বৈদ্যুতিক খুঁটিতে বসানো ট্রান্সফরমারে একটি ছোট পাখি ঢুকে পড়ে। রায়হান কিছুক্ষণ অপেক্ষার পরও দেখেন পাখি বেরোচ্ছে না। এরপর নিজেই পাখির অবস্থা দেখার জন্য খুঁটি বেয়ে ওপরে উঠতে থাকেন। ট্রান্সফরমারের কাছে এসে তারে হাত দিতেই বিকট শব্দে ছিটকে পড়েন নিচে। ঝলসে যায় তাঁর দুই হাত, বুকের কিছু অংশ ও পায়ের তালু। আত্মীয়স্বজন তাঁকে উদ্ধার করে ভর্তি করেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে। পাঁচ দিনের মধ্যে কেটে ফেলা হয় রায়হানের এক হাত ও আরেক হাতের কনুই পর্যন্ত। ১৬ দিন পর জ্ঞান ফেরে তাঁর। দেখেন হাত নেই। পুরো শরীর ব্যান্ডেজে মোড়ানো। চিকিৎসকেরা পরামর্শ দেন, ভারতের মাদ্রাজ নিয়ে চিকিৎসা করাতে। কিন্তু অর্থের অভাবে সম্ভব হয়নি। আত্মীয়স্বজন চমেক হাসপাতালে চিকিৎসা করানোর সিদ্ধান্ত নেন। যত দিন বাঁচে! বুকের ধনকে আগলে রাখেন মা খালেদা বেগম। ধীরে ধীরে সুস্থ হন রায়হান। বাড়ি ফেরেন ছয় মাস পর।

ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প

হাসপাতাল থেকে ফিরে কিছুদিন ঘরে কাটিয়েছেন রায়হান। একদিন খালাতো বোন বললেন, ‘তুই তো পায়ে কিংবা মুখে লিখতে পারিস। চেষ্টা করে দেখ।’ রায়হান কাজে লেগে যান। মুখে কলম নিয়ে লেখার চেষ্টা করেন। প্রথমে কিছুই হয় না। কয়েক দিন যেতেই অক্ষর লেখাটা আয়ত্ত হয়ে যায়। রায়হানের ভাষায়, ‘সেই দিনটি আমার ভীষণ আনন্দের। আমি আবার লিখতে পারছি।’ লেখা শিখতে শুরু করার দুই মাস পর ২০০৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে তাঁদের গ্রামের আল রায়েদ কমপ্লেক্স নামের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হন রায়হান। শিক্ষক ও আত্মীয়স্বজনের পরামর্শে আবার তৃতীয় শ্রেণি থেকে পড়া শুরু করেন। এরপর ২০০৮ সালে ভর্তি হন চকরিয়া সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে। রায়হানের পড়ার আগ্রহ দেখে বিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক নুরুল কবির চৌধুরী বইপত্র কিনে দেন। ২০১৪ সালে ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ থেকে জিপিএ–৩.৪১ পেয়ে এসএসসি পাস করেন রায়হান। এরপর ব্যবসায় শিক্ষা পাল্টে মানবিক বিভাগ নিয়ে ভর্তি হন চকরিয়া কলেজে। বরাবরের মতো এগিয়ে এলেন আত্মীয়স্বজন। তাঁকে দেখে কলেজের শিক্ষকেরা সাহস জোগান। কলেজের অধ্যক্ষ এ কে এম গিয়াস উদ্দিন তাঁর বেতন মওকুফ করেন।

রায়হান বলেন, ‘২০১৬ সালে এইচএসসি পরীক্ষার সময় স্যারেরা আমাকে শ্রুতলেখক নিতে বোর্ডে আবেদনের পরামর্শ দেন। আমি বলেছি, জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষা নিজে লিখে পাস করেছি। এইচএসসিতেও নিজে লিখব। পরীক্ষা শেষে দেখলাম, স্যারদের কথায় সঠিক হলো। খুব কম নম্বর নিয়ে পাস করি। জিপিএ ২ দশমিক ৩৩। তবে নিজের তৃপ্তি লাগে, নিজের খাতায় নিজে লিখেছি। তা ছাড়া আমি বাড়তি ১৫ মিনিটও নিইনি।’

মুখ ও হাতের কনুইয়ের সাহায্যে লেখেন রায়হান l প্রথম আলো

এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পর আর্থিক সংকটে পড়েন রায়হান। মা অন্যের খেতে-খামারে শ্রমিকের কাজ করে সংসার চালাচ্ছিলেন। ওই সময় মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। রায়হানও একটি চাকরির জন্য করেন দৌড়ঝাঁপ। কিন্তু কাজ হয় না। শেষে নিজের জমানো ও পরীক্ষার সময় পাওয়া টাকা একত্র করে একটি কম্পিউটার কিনে বাড়িতে কয়েকজন ছাত্রছাত্রী নিয়ে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলেন। সেখানে যা আয় হয়, তা দিয়ে মা-ছেলে দুজনের সংসার চলে যাচ্ছিল। কিন্তু এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি আবেদনের সময় চলে আসে। কিন্তু ভর্তির আবেদনের জন্য তো টাকা নেই। এগিয়ে এলেন তাঁর এক আত্মীয়। ২ হাজার ৫০০ টাকা দিলেন আবেদন করার জন্য। পরে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে প্রতিবন্ধী কোটায় ইতিহাস বিভাগে ভর্তির সুযোগ পান রায়হান। এবারও আত্মীয়স্বজনেরা এগিয়ে এলেন। ৭ হাজার ৭০০ টাকা দিয়ে ভর্তি হলেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ডিন মো. সেকান্দর চৌধুরী বলেন, ‘মৌখিক পরীক্ষায় তাকে দেখে আমরা অনুপ্রাণিত হই। এখন তার পড়া চালিয়ে যাওয়ার জন্য যা করা দরকার আমরা করব। সে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাবে।’

সমাজসেবায়ও রায়হান
২০১৫ সালে চকরিয়া কলেজে পড়ার সময় ব্রিটিশ কাউন্সিলের দ্য হাঙ্গার প্রজেক্টের আওতায় ‘অ্যাকটিভ সিটিজেন ইয়ুথ লিডারশিপ’ প্রশিক্ষণ নেন। এরপর অক্টোবরে ওই প্রজেক্টের অধীনে ঢাকায় চার দিনের ট্রেইনার প্রশিক্ষণ নেন। এরপর ১৫ জন স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে গঠন করেন ‘স্মাইল ফর চিলড্রেন’ নামের সংগঠন। তাঁরা গ্রামের ঘরে ঘরে গিয়ে বাল্যবিবাহ ও মাদকের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতন করেন। প্রচারণা চালান শিশু হেল্প ডেস্ক ১০৯৮ নম্বরের।
ইউটিউবে রায়হানের নামে রয়েছে নিজস্ব চ্যানেল—‘বাহার রায়হান’। সেখানে রায়হান নিজের কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সচেতন করেন লোকজনকে। তিনি বিভিন্ন ব্লগেও লেখালেখি করেন অধিকার ও সচেতনতা নিয়ে। ফেসবুকে রয়েছে নিজের পেজ (bu the raihan)। এক বন্ধুর সঙ্গে মিলে গড়ে তুলছেন ‘কেমনে যাব ডটকম’ নামের একটি ওয়েবসাইট। এতে দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে যাওয়ার দূরপাল্লার বাসের তথ্য থাকবে। এ ছাড়া রায়হান তাঁর উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামের নারীদের অক্ষরজ্ঞানও দেন।
রায়হান বলেন, ‘এখন আগের মতো সময় দিতে পারি না। আমাকে শহরে থাকতে হয়। তারপরও ছুটি পেলে চলে যাই গ্রামে।’
কথাও গড়ায় শেষের দিকে। রায়হানেরও বাসায় যাওয়ার তাড়া। সব শেষে জানতে চাই রায়হানের স্বপ্ন কী? সোজাসাপটা উত্তর, ‘চাকরি করব। পাশাপাশি আমার মতো মানুষের পাশে দাঁড়াতে চাই।’ কণ্ঠে শুরুর সেই দৃঢ়তা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!