ব্রেকিং নিউজ
Home | দেশ-বিদেশের সংবাদ | চট্টগ্রামে নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়ছে

চট্টগ্রামে নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়ছে

নিউজ ডেক্স : নারীর প্রতি সহিংসতা যে কোনো সময়ের চেয়ে বেড়েছে মাত্রাগতভাবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা হচ্ছে না বলেই নারী ও শিশু লাঞ্ছনার ঘটনা বেড়ে চলেছে। ধর্ষণ বাড়ছে, বাড়ছে ধর্ষণের পর হত্যা। একই সঙ্গে বাড়ছে নিষ্ঠুরতা। বিচারহীনতা ধর্ষণকারীদের উৎসাহিত করছে। আকস্মিক এ ধরনের যৌন সন্ত্রাসের দৌরাত্ম্যে সর্বত্র উদ্বেগ নেমে এলেও পুলিশ হাঁটছে সেই পুরনো পথেই। পুলিশ বলছে, এসব বিছিন্ন ঘটনা। মাঝে মাঝে এ জাতীয় অপরাধ একত্রে ঘটে বলে মনে হয়, হঠাৎ বেড়ে গেছে।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ জাতীয় অপরাধ আগেও ঘটত। এখন তার কলেবর বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রকাশও পাচ্ছে ব্যাপক হারে। এ জন্য দায়ী অনেকগুলো ফ্যাক্ট। আর অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত না করায় ঘৃণিত এই সহিংসতা প্রতিরোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রতিরোধ না করা গেলে সামনের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। চট্টগ্রাম নগর পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) শামসুল আলম বলেন, ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধ হলে আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে তদারকি করি। কেন ঘটনা ঘটলো, এর পেছনে কারণ কী- এ সব জানার চেষ্টা করি। যতক্ষণ এ ঘটনার রহস্য উন্মোচন না হয় ততক্ষণ আমরা লেগে থাকি। চট্টগ্রামে ধর্ষণের ঘটনা একটু বেশি হওয়ার কারণ হচ্ছে শিল্প কারখানা ঘিরে শ্রমিক থাকা।

সমাজবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. অনুপম সেনের মতে, নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা একটি সামাজিক সমস্যা। মানুষের মধ্যে যে আদিম প্রবৃত্তি, তা দমিয়ে রাখতে হলে শৈশব থেকে বা পরবর্তীতে স্কুল কলেজে যথাযথ জ্ঞান চর্চা, নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে। তিনি বলেন, এ ধরনের ঘটনার মধ্যে সাইকোলজিক্যাল একটি ব্যাপারও কাজ করে। কোনো স্থানে একজন করলো, তা প্রচার হওয়ার পর দেখা যায়, এক নাগাড়ে এখানে ওখানে হতেই থাকে। এটা হয় কারণ, যাদের মধ্যে সেই আদিম মনোবৃত্তি দমানো যায়নি, তারা ঘটনার সংবাদটি জেনে উদ্বুদ্ধ হয়। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, নিউইয়র্ক শহরে প্রচুর খুনের ঘটনা ঘটে। কিন্তু তারা সেটা সেভাবে প্রকাশ করে না, ওই একই কারণে। যখন কেউ ধর্ষণ করে বা হত্যা করে তখন সে আনকনশাস থাকে। অবদমিত প্রবৃত্তি তখন মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। এ ধরনের ঘটনা বাড়তে দিলেতো সামাজিকীকরণ থাকবে না। আইন কঠোর ভাবে প্রয়োগ হওয়া উচিত, পাশাপাশি পারিবারিক অনুশাসন ও মানুষে মানুষে সামাজিক সম্পর্কটা বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, আইনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হচ্ছে না। আইনের যথাযথ প্রয়োগটা হচ্ছে না। মূল্যবোধ, আদর্শের অবক্ষয় হচ্ছে। বিকৃত যৌন আগ্রহের সৃষ্টি হচ্ছে। সমপ্রতি কয়েকটি ঘটনায় দেখলাম ধর্ষকের ভূমিকায় বিবাহিতরাই। পরিবারে অভিভাবকের শাসনটাও হচ্ছে না, শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে যৌন শিক্ষার ধারণা না থাকায় যৌন আগ্রহটা বেশি। ধর্ষণের সময় ধর্ষক মনে করছে-আমরা এনজয় করছি।

ধর্ষণের ঘটনায় দায়ের হওয়া অর্ধশতাধিক মামলার নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ভুক্তভোগীদের বেশিরভাগই শিশু, কিশোরী এবং তরুণী। যাদের বয়স পাঁচ থেকে ২৫ বছর। শতকরা হিসাবে ৬০ শতাংশের বেশি ভুক্তভোগী হচ্ছেন এ সব বয়সের নারী। তারা হয় ফুসলিয়ে ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন নতুবা জোরপূর্বক ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। ধর্ষণের মামলায় শাস্তি বাড়ানো হলেও কমছে না এ অপরাধের সংখ্যা। উল্টো দিন দিন বাড়তির দিকে।

পুলিশ সূত্র জানায়, ২০১৭ সালে নগরে ধর্ষণের মামলা হয় ১০৮টি, ২০১৮ সালে ১৩০, ২০১৯ সালে ১৯৫, ২০২০ সালে ২৪৮, ২০২১ সালে ২৫১টি এবং ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত ৪২টি। অর্থাৎ প্রতি বছরই বেড়েছে ধর্ষণের ঘটনা।
গত ২১ জুলাই নগরীর সদরঘাটে আপন চাচাতো ভাইয়ের হাতে ১৫ বছরের এক কিশোরী ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ঘটনাটি আরও চারদিন আগে ঘটলেও বৃহস্পতিবার (২১ জুলাই) তা প্রকাশ পায়। কিশোরীর মা রিনা বেগম অসুস্থ হয়ে হাসাপাতালে থাকার সুযোগে অভিযুক্ত চাচাতো ভাই ওই কিশোরীকে একা পেয়ে ধর্ষণ করেন বলে সদরঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খাইরুল ইসলাম জানিয়েছেন।

১৯ জুলাই মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার সময় রাঙামাটি সরকারি কলেজের পার্শ্ববর্তী টিটিসি সংলগ্ন এলাকায় ছেলে বন্ধুর সাথে বেড়াতে যাওয়া এক পাহাড়ি কলেজ ছাত্রীকে তিন জন বাঙালি সেটলার যুবক জোরপূর্বক ধর্ষণের চেষ্টা চালিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে হিল উইমেন্স ফেডারেশন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘ। ১৭ জুলাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) ক্যাম্পাসে এক ছাত্রীকে যৌন হেনস্তা ও তার বন্ধুকে মারধরের অভিযোগ উঠেছে। রাত ১০টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রীতিলতা হল থেকে বোটানিক্যাল গার্ডেনে যাওয়ার রাস্তায় এ ঘটনা ঘটে। নির্যাতন-নিপীড়নের ঘটনায় গত ১৯ জুলাই রাতে হাটহাজারী থানায় বাদী হয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে একটি মামলা করেছেন ভুক্তভোগী ছাত্রী। ওই মামলায় অজ্ঞাতনামা ৫ জনকে আসামি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন হাটহাজারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রুহুল আমীন সবুজ। নগরীর জিইসি এলাকায় রোববার (১৭ জুলাই) রাত ১টার দিকে রিকশাযোগে ষোলশহরের দিকে যাওয়ার সময় এক গৃহবধূকে ৩ যুবক রিকশা থেকে নামিয়ে ফ্লাইওভারের নিচের একটি টং ঘরে নিয়ে যায়। আরো তিনজনসহ মোট ছয় জন তাকে সেখানে ধর্ষণ করে।

২৭ জুন বায়েজিদ বোস্তামী এলাকায় এক শিশুকে (৫) ধর্ষণের অভিযোগে বদরুল আলম (৫০) নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ২৩ জুন বরিশাল থেকে স্বামীর খোঁজে দেবরের সাথে চট্টগ্রাম আসার পথে স্টিমারে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক নারী। সাথে থাকা ৪ মাসের বাচ্চাকে মেরে ফেলার ভয় দেখিয়ে দেবরসহ ৩ জন মিলে রাতভর ওই নারীকে ৭ দফা ধর্ষণ করে। পরে চট্টগ্রাম এনে তাকে একটি বাসায় নিয়ে গিয়ে আবারও ধর্ষণচেষ্টা করে তারা। এ সময় রক্তক্ষরণ শুরু হলে তাকে রাস্তায় ফেলে রেখে যায় ধর্ষকরা। ১৯ জুন এক নারী চট্টগ্রাম আদালতে যেতে দুপুরে অক্সিজেন মোড় থেকে একটি বাসে উঠেছিলেন। বাসে অন্য কোনো যাত্রী ছিল না। বাসে তাকে ধর্ষণ করা হয়। ৪ জুন বোয়ালখালীতে ৯ম শ্রেণির এক স্কুলছাত্রী (১৪) গণধর্ষণের শিকার হয়েছে।

৩১ মে প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করতে চট্টগ্রাম থেকে এক বান্ধবীকে নিয়ে কক্সবাজারে ছুটে গিয়েছিল দশম শ্রেণির স্কুল শিক্ষার্থী সামিহা আফরিন মৌ (১৬)। কিন্তু প্রতারক সেই প্রেমিক মৌর সঙ্গে দেখা করেনি। সেখানে তার অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে একটি হোটেলে তুলে সেখানকার টমটম চালক। হোটেলে ধর্ষণের শিকার হয় মেয়েটি। পরদিন মৌকে চট্টগ্রামের বাসে তুলে দেওয়া হয়। বিষয়টি নিয়ে পরিবারের সদস্যরা তাকে বকাঝকা করে। আর এ সব ঘটনা সহ্য করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করে সে। নগরের শাহ আমানত সেতু সংযোগ সড়কের রাহাত্তারপুল এলাকায় চলন্ত বাসে এক পোশাক শ্রমিককে ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগে গত ২৫ মে এক বাস চালক এবং তার সহকারীকে গ্রেপ্তার করেছিল বাকলিয়া থানা পুলিশ। ১৮ মে আনোয়ারা উপজেলায় কবিরাজি চিকিৎসার জন্য বৈদ্যর কাছে যাওয়ার পথে এক গৃহবধূকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে।

চট্টগ্রামের সলিমপুর পাক্কার মাথা এলাকায় বাক প্রতিবন্ধী এক তরুণীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে ৭ মে বিকেলে। ৬ মে এক কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগে রৌফাবাদ এলাকা থেকে দুইজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

১৮ এপ্রিল মীরসরাইয়ের ধুমঘাট ব্রিজ এলাকা থেকে উদ্ধার হওয়া অজ্ঞাতনামা নারীর লাশের পরিচয় জানতে সক্ষম হয়েছে রেলওয়ে থানা পুলিশ। আনুমানিক ৩৫ বছর বয়সী ওই নারী কিশোরগঞ্জের বাসিন্দা বলে জানিয়েছে তারা। ওই নারী মৃত্যুর আগে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

১৩ মার্চ হালিশহরে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক ছাত্রীকে (১৪) হাত-পা বেঁধে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধ করে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। ১২ ফেব্রুয়ারি সাতকানিয়ায় খালা-ভাগ্নিকে একসঙ্গে তুলে নিয়ে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে।

চট্টগ্রামে ধর্ষণের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি। বুধবার (২০ জুলাই) সংগঠনটির সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম ও সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু স্বাক্ষরিত এক বিবৃতির মাধ্যমে এমন দাবি জানানো হয়। বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, নারী ও কন্যার প্রতি দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানায় এবং এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে আইনশৃক্সখলা রক্ষাকারী বাহিনী, স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নিয়ে যথাযথ দায়িত্ব পালনেরও দাবি জানায়। -আজাদী প্রতিবেদন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!