Home | দেশ-বিদেশের সংবাদ | খেলা ও মেলায় মুখর লালদীঘি

খেলা ও মেলায় মুখর লালদীঘি

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

নিউজ ডেক্স : চারদিকে সাজ সাজ রব। প্রস্তুত মঞ্চও। আগ্রহ, আকর্ষণ, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠার যেন কমতি নেই। আর এতকিছুর কারণ একটাই। আর তা হলো কার মাথায় উঠছে এবারে জব্বারের বলী খেলার শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট। গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে জব্বারের বলী খেলার সেরার মুকুট পরা মুখটি ছিল একেবারেই পরিচিত। হয় মর্ম সিং ত্রিপুরা না হয় দিদার বলী। গত আসরে নিজের শেষ খেলাটি খেলে ফেলেছেন দিদার বলী। তারও আগে অবশ্য এই বলী খেলাকে বিদায় বলে দিয়েছেন মর্মসিং ত্রিপুরা। তাই এবারে শত বর্ষের জব্বারের বলী খেলা পাচ্ছে নতুন কোন এক চ্যাম্পিয়ন। আর সে চ্যাম্পিয়নকে বরণ করতে সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে আয়োজক কমিটি। চট্টগ্রামের দর্শকরাও আগ্রহ ভরে অপেক্ষা করছে কে হচ্ছেন এবারের জব্বারের বলী খেলার নতুন চ্যাম্পিয়ন সেটা দেখতে। এক ধরনের উম্মুখ হয়ে যেন আছেন সবাই।

এক সময়ের খাল, নদী বিদৌত চট্টগ্রাম আজ কালের পরিক্রমায় পরিণত হয়েছে ইট পাথরের নগরীতে। একে একে হারিয়ে যেতে বসেছে সবগুলো ঐতিহ্য। এক সময়ের সবুজে ঘেরা এই নগরী আজ একটুখানি সবুজের জন্য হাহাকার করছে। এমনই ঐতিহ্য বিচ্যুতির মিছিলের মাঝে ঠিকই মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে জব্বারের বলী খেলা। আজ যার ১০৯ তম আসর। এ উপলক্ষে আয়োজিত ঐতিহ্যবাহী বৈশাখী মেলা গতকাল থেকে শুরু হয়েছে অনুষ্ঠানিকভাবে। শেষ হবে আগামীকাল ২৬ এপ্রিল। গ্রামীণ বৈশিষ্ট্যের নাগরিক আয়োজন এ মেলা প্রতিবছর হয়ে উঠে ধর্ম–বর্ণ নির্বিশেষ মহামিলনের ক্ষেত্র। রোদের গণগণে আঁচ উপেক্ষা করে দূরদূরান্ত থেকে দোকানিরা হরেক রকমের পসরা নিয়ে গত দু’দিন ধরেই পছন্দের জায়গায় বসে পড়েছেন। আনুষ্ঠানিকতার অপেক্ষা না করেই চলছে বিকিকিনি। শত বর্ষীয় এ বলী খেলা ও বৈশাখী মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে বাংলালিংকের সৌজন্যে।

১৯০৯ সালে বদরপাতি এলাকার ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার সওদাগর ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের জন্য এলাকার তরুনদের উদ্ধুদ্ধ করেছিলেন এই বলী খেলার মাধ্যমে। সেদিনের সে বলী খেলা আজ শত বর্ষীয় এক ঐতিহ্য। দেশের নানা প্রান্তের বলীরা এসে নিজের ষ্ট্রেত্ব প্রমাণ করার জন্য প্রানান্তকর চেষ্টা করে এই বলী খেলায়। যুগে যুগে অনেকেই এই বলী খেলা থেকে নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। অনেকেই একেবারে জিরো থেকে হিরো হয়ে গেছেন। আবার অনেকেই হিরো থেকে জিরো হয়ে শেষ করেছেন ক্যারিয়ার। একাধিকবার শিরোপা জেতা অনেক বলী দেখা গেছে পরের বছর অখ্যাত নতুন কোন বলীর কাছে ধরাশায়ী হয়ে বিদায় নিয়েছেন। তবে এবারে তেমন সম্ভাবনা নেই। কারন এবারে থাকছেন না গত কয়েক আসরের নিয়মিত চ্যাম্পিয়ন রামুর দিদার বলী। কাজেই জব্বারের বলী খেলার এবারের আসর পাচ্ছে নতুন কোন হিরোকে। তবে গত আসরের রানার্স আপ উখিয়ার শামছু বলী গতকাল মোবাইল ফোনের মাধ্যমে নিশ্চিত করেছেন তিনি অংশ নিচ্ছেন এবারের আসরেও। কাজেই গতবারের রানার্স আপ শামসু জিততে পারেন কিনা এই ট্রফি নাকি নতুন আরেকজন এসে ছোঁ মেরে নিয়ে যান সেটাই এখন দেখার অপেক্ষা।

কারন গতকাল পর্যন্ত যে শতাধিক বলী তাদের আসা নিশ্চিত করেছে তাদের মধ্যে রয়েছেন পহেলা বৈশাখ অনুষ্ঠিত শাহাবুদ্দিনের বলী খেলার চ্যাম্পিয়ন কুমিল্লার শাহজালাল বলী এবং রানার্স আপ উখিয়ার কলিম উল্লাহ বলী। এছাড়া সীতাকুন্ডের রাশেদ বলীসহ অনেকেই তৈরী হয়ে আসছেন জব্বারের বলী খেলায় নিজেকে সেরা প্রমাণ করতে। তবে লড়াইটা যে হবে সেয়ানে সেয়ানে সেটা অনুমান করা যায়। ডিজিটাল এ যুগেও যে শত বছরের গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য বলী খেলা এখনো মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে সেটা বিশাল একটি ব্যাপার। আয়োজকরা জানিয়েছেন শত বছরের বেশি সময় ধরে চলে আসা জব্বারের বলী খেলা সময় যত গড়াচ্ছে ততই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। দেশের গন্ডি পেরিয়ে আজ দেশের বাইরেও ঐতিহ্য হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে জব্বারের এই বলী খেলা। ১০৮ বছর আগের ছোট্ট পরিসরের বলী খেলাটি আজ যেন ফুলে ফলে ভরা এক মহীরুহ।

আজ বিকাল তিনটায় লালদীঘি মাঠে বলী খেলার উদ্বোধন করবেন পুলিশ কমিশনার ইকবাল বাহার। আর পরে প্রধান অতিথি হিসেবে পুরষ্কার বিতরন করবেন সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন। বরাবরের মত এবারের আসরেও চ্যাম্পিয়নের জন্য থাকছে ট্রফি এবং মেডেলসহ নগদ বিশ হাজার টাকা পুরষ্কার। রানার্স আপের জন্য থাকছে ট্রফি এবং মেডেলসহ নগদ ১৫ হাজার টাকার পুরষ্কার। তবে পুরষ্কারের চাইতে এই ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করাতেই যেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সেরা বলীদের সবচাইতে বড় স্বপ্ন।

ওদিকে বলী খেলা উপলক্ষে ঐতিহ্যবাহী মেলায় দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ক্ষুদ্র–কুটির শিল্পসামগ্রী বিক্রেতারা তাদের পসরা নিয়ে এসেছেন। পেট্রোল পাম্প এলাকায় এসেছেন ঢাকার লালবাগ থেকে আনিসুর রহমান উজ্জ্বল। ধানমন্ডি থেকে এসেছেন ফিরোজ মিয়া। মাটির সরা, হাঁড়ি নিয়ে। রঙে বৈচিত্রে নজরকাড়া এসব মাটির পণ্য ভালো দামে বিক্রি হচ্ছে বলে জানালেন তারা। বগুড়া থেকে আসবাবপত্র নিয়ে এসে শহীদ মিনার এলাকায় বসেছেন আল আমিন, রফিকুল ইসলাম, মানিকসহ আরো কয়েকজন। এগার হাজার টাকা দামের সোফা সেট, পনের বিশ হাজার টাকায় খাট পালং, সাত হাজার টাকায় ড্রেসিং টেবিলসহ নানা ধরনের আসবাবপত্র বিক্রি হচ্ছে জানিয়ে তারা বলেন, ফার্নিচারের দোকান থেকে কিনলে এর ডবল দামে কিনতে হবে। নরসিংদী থেকে আতাউর নিয়ে এসেছেন মাছ ধরার পলো, মোড়া, হাতপাখা। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী তন্বী পলো কিনে দাম পরিশোধ করছিলেন। এত কিছু থাকতে হঠাৎ পলো কেন জানতে চাইলে সহাস্য বদনে উত্তর দিলেন, ড্রইংরূমে লাইটিং করতে লাগবে। হায় রে বাঙালি, মাছ ধরার পলো এখন পুকুর খাল বিল থেকে ড্রইং রুমে এসে উঠেচে। লালদীঘির উত্তর পাড়ে বিভিন্ন নার্সারি প্রদর্শন করছে লাল মরিচ, লেবু, কিংবা পেয়ারার চারাগাছ কিনছে অনেকে দেদারছে।

খাট থেকে শুরু করে সুঁই সুতায় বোনা নিপুণ নকশাদার রুমাল মিলছে এখানে চাওয়ামাত্রই। মেলা থেকে ফিরছে সবাই হাত ভর্তি জিনিসপত্র নিয়ে। ফুলঝাড়ু, হাত পাখা, শীতল পাটি, মাটির ব্যাংক নিয়ে ফিরছে সবাই হাসিমুখে ঘামে ভিজে। বাচ্চাদের পাশাপাশি বুড়োদের হাতেও শোভা পাচ্ছে বাঁশি, মাথার লাইট জ্বালানো শিং কিংবা ঢোল। ঢোল বাঁশি যখন হাতে তখন বাজাতেতো ইচ্ছে করবেই। বেসুরো সুরে, তালে বেতালে বাজছে বাঁশি বাজছে ঢোল।

প্রতি বছরের মতো এ বছরও মেলাকে ঘিরে সুযোগ সন্ধানি একটি চক্র ঠিকই গত দুদিন ধরে তাদের আখের গোছানোর কাজ শুরু করে দিয়েছে। এদের মধ্যে যেমন আছে প্রভাবশালী ছাত্র সংগঠনের নেতা–কর্মী, তেমনি আছে স্থানীয় বখাটে যুবক। দোকানিদের অভিযোগ কাকে টাকা দেবো তা নির্দিষ্ট করে জানি না। মেলায় বসতে হলে প্রতিদিন টাকা দিতে হচ্ছে বিভিন্ন জনকে। এখন এক গ্রুপকে দিলামতো ঘন্টা দুয়েক পরে আরেক গ্রুপ এসে টাকা দাবি করে বসলো। নইলে তুলে দেয়ার হুমকি দেয়। নগরীর কোতয়ালি মোড় এলাকার ব্যবসায়ি মাহতাব, আজিজ ও সোলেমান জানান, প্রতিবছরই তারা এ ধরনের ঘটনার মুখোমুখি হয়। পুলিশ যতোই বলুক, আসলে তাদের কিছুই করার থাকে না। গত সোমবার দুপুরে সরেজমিনে মেলার আশেপাশের এলাকা ঘুরে ব্যবসায়ীদের অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। বিভিন্ন ফুটপাত ও রাস্তায় কয়েকজন যুবক ছোট ছোট ঘর তৈরি করে দিচ্ছে নিজেরা দাঁড়িয়ে থেকেই। কেউ কেউ আবার রঙ দিয়ে নিজেদের নাম লিখে দিচ্ছে।

তবে বলীখেলা ও মেলার আয়োজনকে সুশৃঙ্খল রাখতে প্রতিবছরই সিএমপির পক্ষ থেকে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন আবদুল জব্বার স্মৃতি কুস্তি প্রতিযোগিতা ও বৈশাখী মেলা কমিটির সভপতি কাউন্সিলর জহরলাল হাজারী। তিনি বলেন, জব্বারের বলীখেলা ও মেলাকে ঘিরে নগরজুড়ে বিরাজ করে উৎসবের আমেজ। নগরবাসীর মনে দেখা দেয় বাড়তি আনন্দ। দূর–দূরান্ত থেকে বলীখেলা দেখতে ও মেলায় ঘুরতে আসে বিভিন্ন শ্রেণী, পেশা ও বয়সের মানুষ। তীব্র গরম ও ভিড় উপক্ষো করে সকলেই ঘুরে বেড়ায় মেলার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। প্রতি বছরের মতো এ বছরও আমরা সেই পরিবেশ নিশ্চিত করতে বদ্ধ পরিকর।

সূত্র : দৈনিক আজাদী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!