ব্রেকিং নিউজ
Home | উন্মুক্ত পাতা | ইলেকট্রিক সিগারেট নিরাপদ না কী ভয়ঙ্কর?

ইলেকট্রিক সিগারেট নিরাপদ না কী ভয়ঙ্কর?

339

ফিরোজা সামাদ: দৌড়াচ্ছে প্রযুক্তি, ছুটছে মানুষ, যাচ্ছে সময়, তার সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটছে অনিয়মের ঘোড়া লাগামছাড়া স্বদর্পে। সাথে সামাজিক ও মানবতাকে গ্রাস করছে হূদয় পিপাসু রাক্ষসরা। আজ মাদক, নেশা বিভিন্ন নাম করণে দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পরছে দেশের নামিদামি শহর পেরিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে। এতে আক্রান্ত হচ্ছে ভবিষ্যত্ তরুণ প্রজন্ম। হারাচ্ছে নৈতিকতা, মানবতা, দেশপ্রেম ও স্বজন প্রেম। পচাগলা যানি্ত্রক সমাজের কাছে জিম্মি আজকের তরুণ প্রজন্ম।

ইদানীং লক্ষণীয় যে তরুণ প্রজন্মের হাতে দেখা যাচ্ছে অত্যাধুনিক একটি ডিভাইস, যার নাম ইলেকট্রিক সিগারেট। এটা প্রকাশ্যে নেয়া যায়। আসলে এটা কী? কোনো অশনিসংকেত নয়তো? যদি তাই হয়, তো এখনই লাগাম ধরার সময়!!
উচ্চবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত তরুণ প্রজন্মের হাতে এই ডিভাইসটি দেখা যায়। অনেকটা স্মার্টফোনের আদলে দেখতে। ওই ডিভাইসে তরল কিছু ঢুকিয়ে মুখে টানলে ধোঁয়া বের হয়। অথচ দেখতে সিগারেট নয়। বেটারি রিচার্জাবল। তাই এর নাম ইলেকট্রিক সিগারেট। মাদক বা নেশাজাতীয় হলেও তরল পদার্থটি বিভিন্ন ফ্লেবারে পাওয়া যায়। গন্ধ শুঁকলে বোঝার কোনো উপায় নেই এটা মাদক না অন্যকিছু? এর বিনিময় মূল্যও সাধারণের নাগালের বাইরে। অভিনেতা-অভিনেত্রী এবং টাকাওয়ালাদের চাহিদা বেশি এবং এরাই এর নিয়মিত গ্রাহক।

ক্রমশ ভয়ঙ্কর হতে চলেছে ইলেকট্রিক সিগারেট। শহর থেকে শুরু করে মফস্বলেও পৌঁছে যেতে শুরু করেছে এই নামিদামি ইলেকট্রিক সিগারেট। মানুষের মাঝে নানান বিভ্রানি্ত ছড়াচ্ছে এই ইলেকট্রিক সিগারেট ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন ইলেকট্রিক সিগারেটে কোনো ক্ষতি নেই এবং স্বাস্থ্যর প্রতিও কোনো ধরণের ঝুঁকি নেই। কিন্তু সম্প্রতি এক রিপোর্টে দেখা যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রচস্টার স্কুল অফ মেডিসিন ও ডেনটিসট্রির তৈরি করা সেই রিপোর্টে বলা হয়েছে, সিগারেটের মতো ইলেক্ট্রিক সিগারেট দাঁত ও মাড়ির জন্য তামাক জাতীয় সিগারেট বা মাদকের মতো একইরকম ক্ষতিকর। আরও জানা যায়, এই ইলেকট্রিক সিগারেট মধ্যপ্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দেশগুলির যুবক সম্প্রদায় এই নেশাজাতীয় ডিভাইসে আক্রান্ত ও নির্ভরশীল। এর প্রতিক্রিয়া এমন যে যেৌবনেই আক্রান্ত হচ্ছে ক্যান্সার নামক অমরনাথ ব্যাধিতে। ইলেক্ট্রিক সিগারেটে যে বাষ্প তৈরি হয়, তাতে মানব দেহের কোষে প্রদাহ তৈরি হয়। ইলেকট্রিক সিগারেট হচ্ছে এমন এক ধরনের সিগারেট যা রিচার্জাবল ব্যাটারির সাহায্যে চালনা করা হয়। প্রথাগত কাগজে মোড়ানো তামাকজাতীয় সিগারেট বা অন্যান্য নেশাজাতীয় দ্রব্যের বিকল্প অনেককেই এখন এই ইলেকট্রিক সিগারেট নিতে দেখা যাচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অজুহাত থাকে সিগারেট বা মাদকাসক্তি ছাড়ার ইহা একটি উপকরন। তাহলে এটা কি? যে পদার্থটি নেশার বিকল্প হয়, সেটা আসলে কী? আধুনিক প্রযুক্তিগত কোনো নেশাজাতীয় পদার্থ নয় তো? কোনো ক্ষেত্রে হাল ফ্যাশনে গা ভাসানো প্রজন্মের আসক্ত হওয়ার আধুনিক স্মার্ট ডিভাইস। মোটের ওপর আজকাল ইলেক্ট্রিক সিগারেটে সুখটান দিচ্ছেন নেশাসক্ত উচ্চবিত্তদের সন্তানরা ও নতুন টাকাওয়ালারা। ছুটন্ত পাগলা ঘোড়াকে লাগাম না দিলে ভবিষ্যত্ প্রজন্ম ঝিমুনি রোগে আক্রান্ত হবে অচিরেই। ফলশ্রুতিতে দেশ হয়ে পরবে অপাঙক্তেয় এবং বঞ্চিত হবে সুযোগ্য নেতৃত্ব থেকে।

ইন্টারনেট ঘেটে ও বিভিন্ন প্রযুক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে দেখা যায় গবেষণা বলছে, এই ইলেকট্রিক সিগারেট স্বাস্থ্যের জন্য মোটেও নিরাপদ নয়। মাদক এবং সিগারেটের মতোই আসক্তি হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, ট্র্যাডিশনাল সিগারেটের মতো ইলেকট্রিক সিগারেট থেকে হতে পারে ক্যানসার। তার কারণ, এই ইলেকট্রিক সিগারেটের তরলেও রয়েছে নিকোটিন। ক্রমাগত শরীরে ঢুকতে থাকা এই তরল-নিকোটিন কিন্তু সিগারেটের মতোই আপনাকে নেশাগ্রস্ত করে ফেলতে পারে। যদিও, সিগারেটের মতো তামাক থাকে না এই সিগারেটে। নিকোটিন মিশ্রিত তরলই বাষ্পাকারে বেরিয়ে আসে। ধূমপায়ীরা ও নেশাসক্তরা সিগারেটেরই স্বাদ পান এই ইলেকট্রিক স্মোকিংয়ে।

গবেষকরা মনে করছেন, এই তরলে আসক্তি আরও বেশি। যা ভবিষ্যতে ফের ধূমপান বা অন্য কোনো নেশার দিকে আপনাকে টেনে নিয়ে যেতে পারে। ইলেকট্রিক সিগারেটকে গেটওয়েদার সঙ্গেই তুলনা করেছেন তারা। বলছেন, তিন ধরনের ফর্মে নিকোটিন থাকে। তার মধ্যে ফ্রি-বেস নিকোটিনই শরীর শোষণ করে। আর এই ফ্রি-বেস নিকোটিনই নেশায় পুনরায় আসক্তি আনতে পারে।

বর্তমানে রাজধানী থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এখন ইলেকট্রিক-সিগারেট পেৌঁছে যাচ্ছে মুহূর্তেই। ফলে তরুণ প্রজন্ম আরো বিপন্ন হতে বসেছে। একটু স্টাইলিস্ট কিংবা উন্নত ধরনের নেশা এটা। কিন্তু দিন দিন যে হারে ইলেকট্রিক সিগারেটের চাহিদা বাড়ছে তাতে দেশের জন্য কতটা মঙ্গলজনক তা প্রশ্নবদ্ধি? ইলেকট্রিক সিগারেট যুব সমাজকে ধ্বংস করার আরও একটি উপাদান। ক্রমশ এই স্টাইলিস্ট ইলেকট্রিক সিগারেট যুবক ও তরুণ প্রজন্মের হাতে পেৌঁছে যাচ্ছে। অন্যান্য নেশার মাঝে আরও একটি অত্যাধুনিক নেশা যোগ হলো। সুতরাং এই মরণব্যাধী ইলেকট্রিক সিগারেটের হাত থেকে যুব সমাজকে বাঁচাতে হলে পরিবারের প্রত্যেক অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। শুধু ইলেকট্রিক সিগারেটই নয় আপনার সন্তান কি করছে? কোথায় যাচ্ছে? কি খাচ্ছে? কাদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে? এটা দেখার দায়িত্ব প্রতিটি অভিভাবকদের। ইলেকট্রিক সিগারেট সম্পর্কে সকলকে এখনই সচেতন হতে হবে এবং সরকারের গোয়েন্দা বিভাগকে এই ব্যবসায় যারা জড়িত, তাদেরকে মনিটরিং করার জন্য সরকারের প্রতি সনির্বন্ধ অনুরোধ থাকবে।

তথ্য সূত্রে জানা যায়, ২০১০ সালেই এক আইনের মাধ্যমে অপ্রাপ্তবয়স্কদের কাছে ইলেকট্রিক সিগারেট বিক্রি নিষদ্ধি করেছে ক্যালিফোর্নিয়া সরকার। তখন দেখা যায়, নানা ফ্লেভারের ই-সিগারেটেও আসক্ত হয়ে পড়ছে তারা। ইলেকট্রিক সিগারেটে ধূমপান করে ২০১২ সালে সাত শিশু বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়। এদের সবার বয়স পাঁচ বছরের কম। অথচ গত বছর এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৫৪ জনে।

অনেকেই মনে করেন বা বিজ্ঞাপনেও দেখানো হয় ইইলেকট্রিক সিগারেট ধূমপানের অভ্যাস বা যে কোনো নেশা ত্যাগ করতে সাহায্য করে। কিন্তু এখানেই দেখা দিয়েছে বিতর্ক। ক্যানসার বিশেষজ্ঞদের মতে, ইইলেকট্রিক সিগারেট ধূমপান ছাড়তে সাহায্য করে এর কোনো প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর প্রভাব সাধারণ সিগারেটের চেয়েও ক্ষতিকারক বলে দাবি করছেন তারা। তারা জানাচ্ছেন, ইইলেকট্রিক সিগারেটের তরল মিশ্রণ (ইলেকট্রিক লিকুইড) এর মধ্যে থাকে প্রপেলিন গ্লাইসল, গি্লসারিন, পলিইথিলিন গ্লাইসল, নানাবিধ ফ্লেভার এবং নিকোটিন। গরম হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই রাসায়নিক গুলি থেকে সাধারণ সিগারেটের ধোঁয়ার দ্বিগুণ পরিমাণ ফরমালডিহাইড উত্পন্ন হয়। এছাড়াও ইলেকট্রিক সিগারেটের ধোঁয়ায় থাকে অতিসূক্ষ্ম রাসায়নিক কণা যা ভীষণ ক্ষতিকারক। এর থেকে গলা-মুখ জ্বালা, বমি বমি ভাব এবং ক্রনিক কাশি দেখা দিতে পারে। ক্যান্সার বিশেষজ্ঞরা সবচেয়ে বেশি চিনি্তত এর মধ্যে থাকা নিকোটিনের পরিমাণ নিয়ে। সিগারেট বা নেশা ছাড়তে চেয়ে যারা এটি ব্যবহার করেন তাদের এর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যা থেকে দেখা দিতে পারে ফুসফুসের বিভিন্ন অসুখ।

ইলেকট্রিক সিগারেট দিয়ে কোনোদিন সিগারেট ছাড়া যায় না। বরং বেশি খরচ করে মানুষ আরও বড় বিপদ ডেকে আনছে। জাপানে একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে ইলেকট্রিক সিগারেট সাধারণ সিগারেটের চেয়ে দশ গুণ বেশি ক্ষতিকারক।
আমাদের দেশেও এখনো পর্যন্ত ধনী বাবার উঠতি বয়সী সন্তানদের হাতে রাস্তায় প্রকাশ্যে দেখা যায় নতুন স্মাটফোনের অনুকরণে তৈরি এই ডিভাইসটি।

তাই তরুণ প্রজন্মের অভিভাবকদের এখনই সময় সতর্কতা অবলম্বনের। আর যদি কোনো অভিভাবক ইতোমধ্যেই এই ইলেকট্রনিক সিগারেটের প্রতি আসক্তি জমে থাকে আপনি এখনি তা পরিত্যাগ করে সন্তানকে স্নেহের ছায়াতলে আবদ্ধ করুন। অন্যথায় বিকৃত মসি্তষ্ক ভবিষ্যত্ বংশধর নিয়ে হতাশায় নিরাশায় দিন কাটাতে হবে জীবনের অবশষ্টিাংশ দিনগুলো নিশ্চিত।

লেখক : কবি লেখক ও কলামিস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!