ব্রেকিং নিউজ
Home | অন্যান্য সংবাদ | সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণে মহামানব যা বলেছিলেন

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণে মহামানব যা বলেছিলেন

hqdefault

ধর্ম ডেস্ক  : আধুনিক সভ্যতা ও মানবাধিকার যুগের সূচনায় পৃথিবীর ইতিহাসে যে ভাষণটির মর্যাদা সবচেয়ে বেশি, সেটি সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর বিদায় হজের ভাষণ। স্থান ও কালের গণ্ডি পেরিয়ে এই ভাষণ মানবজাতির ইতিহাসে এক অনবদ্য জায়গা করে নিয়েছে।

ভাষণটি যে সময়ে দেয়া হয়েছিল, এটি শুধু তখনকার প্রেক্ষাপটের জন্যই ছিল না। এর আবেদন থাকবে পৃথিবীর শেষ দিন পর্যন্ত। এমনকি এই ভাষণ শুধু আরবদের উদ্দেশ্যেও ছিল না ভাষণটি; বরং এর সামনে ছিল পুরো মানবজাতি।

বিদায় হজের ভাষণ ১০ম হিজরিতে অর্থাৎ ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে হজ পালনকালে আরাফাতের ময়দানে রাসুলের (স.) একটি কালজয়ী বক্তব্য। হজের দ্বিতীয় দিনে আরাফাতের মাঠে অবস্থানকালে জাবালে রহমত টিলার শীর্ষে দাঁড়িয়ে উপস্থিত সমবেত মুসলিমদের উদ্দেশ্যে তিনি এই ভাষণ দেন। ইসলামের প্রকৃত মূল্যবোধ অনুযায়ী মুসলিমদের করণীয় সম্পর্কে এই ভাষণে চূড়ান্ত দিকনির্দেশনা ছিলো।

সহিহ মুসলিমের বর্ণনা অনুসারে, টিলার ‍ওপর দাঁড়িয়ে রাসুলুল্লাহ বলতে শুরু করেন: ‘হে মানবজাতি! তোমরা মনোযোগ দিয়ে আমার বক্তব্য শোনো। আমি জানিনা, আগামী বছর এ সময়ে, এ স্থানে, এ নগরীতে তোমাদের সাথে আমার সাক্ষাৎ আর হবে কি না। হে মানবজাতি! সাবধান! সকল জাহেলিয়াতকে আমি আমার দু’পায়ের নিচে পিষ্ট করে যাচ্ছি।

নিরাপরাধ মানুষের রক্তপাত চিরতরে হারাম ঘোষিত হল। প্রথমে আমি আমার বংশের পক্ষ থেকে রবিয়া বিন হারেস বিন আবদুল মোত্তালিবের রক্তের দাবী প্রত্যাহার করে নিচ্ছি। সে বনি লাইস গোত্রে দুধ পান করেছে, হুযাইল তাকে হত্যা করেছে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র থেকে ‘সুদ’কে চিরদিনের জন্য হারাম ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হল। আমি আজ আমার চাচা আব্বাস ইবনে আবদুল মোত্তালিবের যাবতীয় সুদের দাবী প্রত্যাহার করে নিচ্ছি।

হে লোক সকল! বল আজ কোন দিন? সকলে বলল, আজ মহান আরাফার দিন, আজ হজ্বের বড় দিন।

সাবধান! তোমাদের একের জন্য অপরের রক্ত, তার মাল সম্পদ, তার ইজ্জত-সম্মান আজকের দিনের মত, এই হারাম মাসের মত, এ সম্মানিত নগরীর মত পবিত্র আমানত। সাবধান! মানুষের আমানত প্রকৃত মালিকের নিকট পৌঁছে দেবে। হে মানব সকল! নিশ্চয়ই তোমাদের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ একজন, তোমাদের সকলের পিতা হযরত আদম (আ.)। আরবের উপর অনারবের এবং অনারবের উপর আরবের কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই। সাদার উপর কালোর আর কালোর উপর সাদার কোন মর্যাদা নেই। ‘তাকওয়াই’ শুধু পার্থক্য নির্ণয় করবে।

হে লোক সকল! পুরুষদের নারী জাতীর ওপর নেতৃত্বের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। তবে নারীদের বিষয়ে তোমরা আল্লাহ তা’য়ালাকে ভয় কর। নারীদের ওপর যেমন পুরুষদের অধিকার রয়েছে, তেমনি পুরুষদের ওপর রয়েছে নারীদের অধিকার। তোমরা তাদের আল্লাহর জামিনে গ্রহণ করেছ। তাদের ওপর তোমাদের অধিকার হচ্ছে, নারীরা স্বামীর গৃহে ও তার সতীত্বের মধ্যে অন্য কাউকেও শরিক করবেনা। যদি কোন নারী এ ব্যাপারে সীমা লংঘন করে, তবে স্বামীদের এ ক্ষমতা দেয়া হচ্ছে যে তারা স্ত্রীদের থেকে বিছানা আলাদা করবে ও দৈহিক শাস্তি দেবে। তবে তাদের চেহারায় আঘাত করবে না।

আর নারীগণ স্বামী থেকে উত্তম ভরণ-পোষণের অধিকার লাভ করবে, তোমরা তাদের উপদেশ দেবে ও তাদের সাথে সুন্দর আচরণ করবে। হে উপস্থিতি! মুমিনেরা পরষ্পর ভাই। আর তারা সকলে মিলে এক অখণ্ড মুসলিম ভ্রাতৃসমাজ। এক ভাইয়ের ধন-সম্পদ তার অনুমতি ব্যতিরেকে ভক্ষণ করবে না। তোমরা একে অপরের উপর জুলুম করবেনা।

হে মানুষেরা! শয়তান আজ নিরাশ হয়ে পড়েছে। বড় বড় বিষয়ে সে তোমাদের পথভ্রষ্ট করতে সমর্থ হবে না। তবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়ে তোমরা সর্তক থাকবে ও তার অনুসারী হবে না। তোমরা আল্লাহর বন্দেগী করবে, দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত প্রতিষ্ঠা করবে, রমজান মাসের সিয়াম পালন করবে, যাকাত আদায় করবে ও তোমাদের নেতার আদেশ মেনে চলবে। তবেই তোমরা জান্নাত লাভ করবে।

সাবধান! তোমাদের গোলাম ও অধীনস্তদের বিষয়ে আল্লাহ তা’আলাকে ভয় কর। তোমরা যা খাবে, তাদের তা খেতে দেবে। তোমরা যা পরবে, তাদেরও সেভাবে পরতে দেবে। হে লোক সকল! আমি কি তোমাদের নিকট আল্লাহ তা’আলার বার্তা পৌঁছে দিয়েছি? লোকেরা বলল, ‘হ্যাঁ’। তিনি বললেন, আমার বিষয়ে তোমাদের জিঞ্জাসা করা হবে, সেদিন তোমরা কী সাক্ষ্য দেবে? সকলে এক বাক্যে বললেন, আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আপনি আমাদের নিকট রিসালাতের বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন। উম্মতকে সকল বিষয়ে উপদেশ দিয়েছেন। সমস্ত গোমরাহির আবরণ ছিন্ন করে দিয়েছেন ও অহীর আমানত পরিপূর্ণ ভাবে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব পালন করেছেন।

অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজ শাহাদাত আঙুল আকাশে তুলে তিনবার বললেন, ‘হে আল্লাহ তা’আলা, আপনি সাক্ষী থাকুন, আপনি সাক্ষী থাকুন, আপনি সাক্ষী থাকুন।

হে মানুষেরা! আল্লাহ তায়ালা তোমাদের সম্পদের মিরাস নির্দিষ্টভাবে বণ্টন করে দিয়েছেন। তার থেকে কম বেশি করবেনা। সাবধান! সম্পদের তিন ভাগের এক অংশের চেয়ে অতিরিক্ত কোন অসিয়ত বৈধ নয়। সন্তান যার বিছনায় জন্ম গ্রহণ করবে, সে তারই হবে। ব্যভিচারের শাস্তি হচ্ছে প্রস্তরাঘাত। (অর্থাৎ সন্তানের জন্য শর্ত হলো তা বিবাহিত দম্পতির হতে হবে। ব্যভিচারীর সন্তানের অধিকার নেই)। যে সন্তান আপন পিতা ব্যতীত অন্যকে পিতা ও যে দাস নিজের মালিক ব্যতীত অন্য কাউকে মালিক বলে স্বীকার করে, তাদের উপর আল্লাহ তা’আলা, ফেরেশতাকুল ও সমগ্র মানবজাতির অভিশাপ। তার কোন ফরয ও নফল ইবাদত কবুল হবে না।

হে কুরাইশ সম্প্রদায়ের লোকেরা! তোমরা দুনিয়ার মানুষের বোঝা নিজেদের ঘাড়ে চাপিয়ে যেন কিয়ামতে আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ না কর। কেননা আমি আল্লাহর আজাবের মোকাবেলায় তোমাদের কোন উপকার করতে পারবো না। তোমাদের দেখেই লোকেরা আমল করে থাকবে। মনে রেখ! সকলকে একদিন আল্লাহ তা’আলার নিকট হাজির হতে হবে। সে দিন তিনি প্রতিটি কর্মের হিসাব গ্রহণ করবেন।

তোমরা আমার পরে গোমরাহিতে লিপ্ত হবে না, পরস্পর হানাহানিতে মেতে উঠবনা। আমিই শেষ নবী। আমার পর আর কোন নবী আসবেনা। আমার সাথে অহীর পরিসমাপ্তি হতে যাচ্ছে। হে মানুষেরা! আমি নিঃসন্দেহে একজন মানুষ। আমাকেও আল্লাহ তায়ালার ডাকে সাড়া দিয়ে চলে যেতে হবে। আমি তোমাদের জন্য দুটি বস্তু রেখে যাচ্ছি, যতদিন তোমরা এই দুটি বস্তু আঁকড়ে থাকবে, ততদিন নিঃসন্দেহে পথভ্রষ্ট হবে না। একটি আল্লাহর কিতাব ও অপরটি রাসুলের (স.) সুন্নাহ।

হে মানবজাতি! তোমরা আমির বা নেতার আনুগত্য করো এবং তার কথা শ্রবণ করো, যদিও তিনি হন হাবশী ক্রীতদাস। যতদিন পর্যন্ত তিনি আল্লাহর কিতাব অনুসারে তোমাদের পরিচালিত করেন, ততদিন অবশ্যই তার কথা শুনবে, তার নির্দেশ মানবে ও তার প্রতি আনুগত্য করবে। আর যখন তিনি আল্লাহর কিতাবের বিপরীতে অবস্থান গ্রহণ করবে, তখন থেকে তার কথাও শুনবেনা ও তার আনুগত্যও করা যাবেনা।

সাবধান! তোমরা দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি থেকে বিরত থাকবে। জেনে রেখো, তোমাদের পূর্ববর্তীগণ এই বাড়াবড়ির কারণেই ধ্বংস হয়ে গেছে। (এ নির্দেশনাটি হচ্ছে অমুসলিমদের ক্ষেত্রে অর্থাৎ কোন বিধর্মীকে বাড়াবাড়ি বা জোরজবস্তি করে ইসলামে দীক্ষা দেয়া যাবে না। তবে একজন মুসলমানকে অবশ্যই পরিপূর্ণ ইসলামী জীন্দেগী অবলম্বন করে জীবন যাপন করতে হবে। এক্ষেত্রে সুবিধাবাদের কোন সুযোগ নেই)।

আবার বললেন, আমি কি তোমাদের নিকট আল্লাহর দ্বীন পৌছে দিয়েছি? সকলে বললেন, নিশ্চয়ই। হে উপস্থিতগণ! অনুপস্থিতদের নিকট আমার এ বার্তা পৌঁছে দেবে। হয়তো তাদের মধ্যে কেউ এ নসিহত তোমাদের চেয়ে বেশি গুরুত্বের সাথে আমল করবে। তোমাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক। বিদায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!