Home | সাহিত্য পাতা | সমান্তরাল

সমান্তরাল

153

তুমি? তুমি এখানে? ফাহিমের চোখে বিস্ময়!

তাই তো! তুমি এখানে কী করে! মিতুও অবাক হয়ে বললো।

ফাহিম পূর্ণ দৃষ্টিতে মিতুর চোখের দিকে তাকালো। চোখে চোখ পড়তেই মিতু চোখ নামিয়ে নিলো।

মুখোমুখি থেকে পাশাপাশি হলো ওরা।

কোনো কথা না বলেই হাঁটলো কিছুক্ষণ।

-ফাহিমই মুখ খুললো, এবার বলো কেমন আছো। কী কারণে ঢাকায় আসা? কোথায় উঠেছো? কবে ফিরছো?

-হেসে ফেললো মিতু। তুমি তো দেখছি আগের মতোই আছো, অস্থির।

-তুমিও, একটু উত্তেজিত হয়ে বললো ফাহিম।

-মানে?

-তুমি হাসলে এখনো বসন্ত আসে চারপাশে!

-যাহ! কী সব বলো! লাজুক স্বরে বললো মিতু। ছেলেমানুষি রাখো তো! তোমার খবর বলো।

-প্রশ্ন কিন্তু আমিই আগে করেছিলাম। কাজেই …

-হঠাত কী ভেবে হাঁটা থামাল মিতু। ফাহিমের মুখের দিকে তাকিয়ে বুক ভর্তি দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

-সেই দীর্ঘশ্বাস যেনো বুকের খুব গভীরে কোথাও প্রবলভাবে নাড়িয়ে দিয়ে গেলো ফাহিমকে। স্মৃতিকাতর হয়ে পড়লো সে।মূহূর্তের মধ্যে চোখের সামনে ভেসে উঠলো পুরোনো সব দিন।

না না, অমলিন স্মৃতিময় মধুমাখা দিনগুলোকে কিছুতেই পুরোনো বলতে রাজি নয় ফাহিম। সেসব দিন পুরোনো হবার নয়! দিনগুলোর স্মৃতি তার কাছে অমূল্য সম্পদের মত। এখনো সব স্মৃতি আঁকড়ে ধরে আছে ফাহিম। যখনই নিজের করে এতটুকুও সময় পায়, ফেলে আসা দিনগুলোর কথা ভাবতে শুরু করে। এই ভাবনার সময়টুকুই একঘেয়ে জীবনের পরম আনন্দের সময়। দম বন্ধ করা মূহুর্তে একঝলক দখিনা বাতাস।দুজনেই যেনো হারিয়ে গেলো সুগভীর স্মৃতির অতল গহবরে।

-চলো কোথাও বসি। ফাহিমের কথায় হঠাত যেনো সম্বিৎ ফিরে পেলো মিতু। কোনো কথা না বলে ফাহিমকে অনুসরণ করলো।

বসুন্ধরা সিটির নীচতলাতেই দেখা হয়েছিল ওদের। কর্ণারের লিফটের সামনে এসে দাঁড়াতেই খুলে গেলো লিফট!উঠেই টপ ফ্লোরের বাটনে প্রেস করলো ফাহিম। এই ফ্লোরে ফুড কোর্ট আর সিনেপ্লেক্স। দেয়ালে বিউটি এন্ড দ্য বিস্টের বিশাল বিশাল পোস্টার। ছবির নায়িকাটি দারুণ দেখতে! গভীর মনোযোগে দেখলো মিতু।

বামে ঘুরে একদম শেষ মাথায় একটু নিরিবিলিতে বসলো ওরা।

-তারপর?বলো…। মিতুই প্রথমে কথা বললো।

-এতোক্ষণে ফাহিম মিতুকে গভীরভাবে দেখার সুযোগ পেলো। কচি পাতার মত উজ্জ্বল সবুজ রঙের শিফনের শাড়ি পড়েছে মিতু। লম্বা চুলগুলো হালকা করে ক্লিপে বাধা। সামনের ছোট চুলগুলো এলোমেলোভাবে মুখের ওপর ছড়িয়ে- ছিটিয়ে আছে। এতে ওর লাবণ্য যেনো আরো লালিত্য পেয়েছে। গভীর কালো চোখজোড়া সেই আগের মতোই আকর্ষণীয় আছে। এই চোখের ঘোর- লাগা দৃষ্টিই একদিন ফাহিমের বুকে ঝড় তুলেছিল।

– একটু ঝুঁকে এলো ফাহিম মিতুর দিকে। ওর মাথা যখন মিতুর মাথা্র সাথে প্রায় ছুঁইছুঁই করছিল তখনই কাতর হয়ে পড়লো ফাহিম। মদির সৌরভ ভেসে আসছে মিতুর চুলের গোছা থেকে। একটা সময় ছিল যখন এই চুলের ঘ্রাণ না শুঁকে কিছুতেই বাড়ি ফিরতো না ফাহিম। মুহূর্তের মধ্যেই ফাহিম যেনো পৌঁছে গেলো ফেলে আসা সেই প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা দিনে। কল্পনায় চলে যায় টগবগিয়ে ছুটে চলা সদ্য-যুবক হওয়া সেই সব দিনে। নিজেকে যখন অন্যরকম মানুষ ভাবতে ভালো লাগতো। কবিতা আবৃত্তি করতে করতে রক্ত চঞ্চল হয়ে উঠতো। চারপাশের সবকিছু মনে হতো বিস্ময়কর! রাতদিন ভেসে যেত খামখেয়ালির স্রোতে। সন্ধ্যার অপরূপ দৃশ্য মাতাল করে তুলতো ওকে। মাথা উঁচু করে আকাশের দিকে তাকিয়ে দু’হাত ছড়িয়ে দিত প্রসারিত করে। মনে হতো পুরো পৃথিবীটা শুধুই ওর!  প্রতিনিয়ত নতুন করে আবিস্কার করতো নিজেকে! অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে বুঝে নিতো কোথাও কোনো উজ্জ্বল নক্ষত্র ওর জন্যেই ফুটে আছে! সবকিছুর মধ্যেই নতুন কিছু খুঁজে পেতে ছিল সলজ্জ আকুতি। নারীর ধারণা, নারীর অবয়ব, নারীর প্রতিমূর্তি সবই যখন আবছাভাবে ভেতরে ভেতরে ধরা দিতে শুরু করেছে কেবল ঠিক তখনই মিতুর সাথে ফাহিমের পরিচয়। এতো সুন্দর হয় মানুষ! এত সুন্দর হয় নারী! ওকে দেখার পর থেকেই এতদিনের আবছা অবয়ব যেনো পূর্নতা পে্যে স্পষ্ট হয়ে শিহরণ জাগিয়ে তোলে দেহ-মনে। ফাহিমের সমস্ত চিন্তা- চেতনা গ্রাস করে নেয় মিতুর রমণীয় সৌন্দর্য। ওর একহারা ছিপছিপে গড়ন, চাঁপা – ফুলের মত গায়ের রঙ, পিঠ-ছাপানো লম্বা কোমল চুল, বুদ্ধিদীপ্ত চোখ আর ফোলানো পুরুষ্ঠু ঠোঁট নিমেষেই পৃথিবী দখল করে নিলো ফাহিমের। যেখানে যায়, যেদিকে তাকায় চারিদিকেই ওই একটিই মুখ। প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা ওই হাসিমুখের জন্য এক মুহূর্তেই জীবন বিসর্জন দিতে প্রস্তুত ছিল ফাহিম। ওকে দেখলেই ড্রাম পেটানোর শব্দ হতো বুকে! মিতুকে ছাড়া বেঁচে থাকা অসম্ভব মনে হতো তখন ফাহিমের!

আসলেই কী মিতুকে ছাড়া এখন বেঁচে আছে ফাহিম? একে কী বেঁচে থাকা বলে? এখনও কী গভীর রাতে মিতুর কথা ভেবে বুকের ধুকপুকানি নিয়ে জেগে ওঠেনা ফাহিম! মিতুই ওর প্রথম আর শেষ প্রেম।

-কী এত ভাবছো বলো তো?

-চোখে চোখ রেখে ফাহিম বললো, তুমি কেমন আছো মিতু?

-হঠাত খুব অসহায় বোধ করলো মিতু। আমি ভালো আছি। তুমি…?

-হা হা হা। তুমি ভালো তো আমিও ভালো আছি।

-অফিসের একটা সেমিনার এটেন্ড করতে এসেছিলাম। রাতের ট্রেনে চট্টগ্রাম ফিরবো। এই বাড়তি সময়টুকু কীভাবে কাটানো যায় তা ভাবতে ভাবতেই বসুন্ধরা সিটিতে আসা।

-বাহ! চমৎকার! আমিও রাতের ট্রেনেই ফিরছি। ভালোই হলো, একসঙ্গে গল্প করতে করতে যাওয়া যাবে।

-একথা শুনে মিতুর মুখ প্রথমে উজ্জ্বল হয়ে উঠলেও পরমুহূর্তেই যেনো দপ করে নিভে গেলো।

-ব্যাপারটা ফাহিমের দৃষ্টি এড়ালো না। তবু ও এ প্রসঙ্গে কিছু বললো না।

-তোমার কথা বলো, কেনো এসেছো ঢাকায়? অফিসের কাজে?

-তা অফিসের কাজে বলতে পারো। মহাখালী এসেছিলাম। ডিজি হেলথ এ। পোস্টিং এর ব্যাপারে। প্রায় দু’বছর ধরে রাঙামাটি মেডিকেল কলেজে আছি। চট্টগ্রাম মেডিকেলে আসার ট্রাই করছি। তোমার এনজিওর খবর কী?

-এইতো চলছে। নতুন একটা প্রজেক্ট এর কাজ শুরু হতে যাচ্ছে। সে উপলক্ষ্যেই আজকের সেমিনার।

-আচ্ছা, আমাদের দিন কী একেবারেই গেছে?

-আবৃত্তি করোনা এখন?

-শুনতে চাও কী’না বলো!

-দিন কখনো যায়না ফাহিম। দিন থাকে দিনের মত। আমরাই সময়গুলোকে উপভোগ করতে ব্যর্থ হই। আজ তোমার আবৃত্তি শুনবো। বারণ করলে মানবো না কিন্তু!

-শোনাবো। তবে এখানে এভাবে নয়। কানে কানে শোনাবো।

-লজ্জায় গাল দুটো লাল হয়ে উঠলো মিতুর।

-তর্জনী দিয়ে বাম গালে আলতো ছুঁয়ে দিলো ফাহিম।

বলগা হরিণের মত ছুটে চলা দিনগুলোতে মিতুর কোলে মাথা রেখে ফাহিম আবৃত্তি করতো আর মিতু মাথা ভর্তি ঘন চুলে হাত বুলাতো। ফাহিমের লম্বা পেটানো শরীর আর ভরাট কন্ঠস্বরের প্রেমে পড়েছিল মিতু। তবে তার চেয়েও বেশি ভালো লাগতো ওর অস্থিরতা আর ছটফটে স্বভাব। তবে ভালো লাগাটা প্রকাশ করতো না মিতু! বরং এই ছটফটে স্বভাবের জন্য ওর ওপর প্রায়ই অভিমান করতো। ফাহিমের দিন কেটে যেতো মান-অভিমান ভাঙাতে ভাঙাতে! ওদের প্রেমকাহিনী ছিল সব বন্ধুদের মুখে মুখে! কখন সকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতো কিছুই টের পেতো না ও। ফাহিম পাশে থাকলে চোখের পলকে কেটে যেত রাত্রি দিন। শিল্পকলা একাডেমির চত্ত্বর, চায়ের দোকান, চট্টেশ্বরী রোড, জিলিপি পাহাড়, কালেভদ্রে মেহেদিবাগের কফি কর্ণার দুজনে মিলে চষে বেড়াতো ওরা। একটু আড়াল খুঁজতে গলদঘর্ম হতে হতো ফাহিমকে। টাকার অভাবে আলো- আঁধারি ঘেরা রেস্টুরেন্টগুলোতে যেতে পারতো না খুব একটা। ফাহিম খুব অস্থির হয়ে পড়তো মিতুর চুলের ঘ্রাণ নিতে, ওকে তীব্রভাবে জড়িয়ে ধরতে আর চুমু খেতে। ভাবতে ভাবতে অদ্ভুত এক শিহরণ খেলে যায় মিতুর শরীর জুড়ে! ফাহিমের মানিব্যাগে থাকতো মিতুর চুল। প্রথম দিন দেখে ভারি অবাক হয়েছিল মিতু! কখন কোন ফাঁকে ওর মাথার চুল জড়িয়ে নিয়ে পার্সে রেখেছিল মিতু টেরই পায়নি! বাঁধনহারা সেসব দিন! জীবনের তাগিদে হয়তো দুজন এখন ভিন্ন ভিন্ন জগতের বাসিন্দা কিন্তু ফাহিমকে কী একমুহূর্তের জন্যেও ভুলতে পেরেছে মিতু? এখনও কী ঘুম ভেঙ্গে ওর কথাই ভাবেনা রোজ?

-উহু! আমাকে সামনে বসিয়ে রেখে এভাবে অন্যমনস্ক হবে আর আমি তা মেনে নেবো তা কিন্তু ভেবোনা ম্যাডাম!

-কী খাবে বলো?

-ওয়েটার এসে দু’একবার ঘুরে গেছে। ডিস্টার্ব করেনি ওদের। এখন মিতুই ডাকলো।

দুটো স্যান্ডউইচ আর কোক অর্ডার দিলো।

-আমার সঙ্গে রাঙামাটি যাবে মিতু? হাসপাতালের কাছাকাছিই সুন্দর একটা বাসা নিয়েছি। চারপাশে শুধু সবুজ আর সবুজ! তোমার খুব ভালো লাগবে মিতি, আমি নিশ্চিত।

-একদিন নিশ্চয় যাবো বেড়াতে

-শুধু বেড়াতে? থাকতে যাবেনা?

-তুমি বিয়ে করছো না কেনো ফাহিম?

-হা হা হা। আমাকে কে বিয়ে করবে মিতু?

-কেনো? বিয়ের বাজারে ডাক্তার ছেলেদের অনেক দাম!

-এখন আর সেই দিন নেই মিতু বেগম। সিম্পল এমবিবিএস কে কেউ মেয়ে দিতে চায় না আজকাল। পাছে না খেয়ে মরতে হয়!

-এসবই তোমার বাড়াবাড়ি। এখন সরকারী চাকুরেদের বেতন অনেক বেশি। এজন্যেই কী বিয়ে করছো না? না কী অন্য কোন কারণ?

-কী মনে হয় তোমার?

-তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই।

-যদি বলি শুধুমাত্র তোমাকে কনে হিসেবে পেলেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে রাজি।

-পাগলামি করোনা ফাহিম। বাস্তবতা অনেক কঠিন। তুমি তো সব জানো। তবু … কেনো অবুঝের মত করো। আমি চাই তোমার জীবনটা সুন্দর হোক, গোছানো হোক।

-একদম না! মোটেও তুমি তা চাও না মিতু!চাইলে আমাকে এতো কষ্ট দিতে পারতে না তুমি! চিৎকার করে উঠলো ফাহিম।

-প্লিজ ফাহিম, শান্ত হও! প্লিজ। ফাহিমের হাত দুটি চেপে ধরলো মিতু! এখানে এভাবে কথা বলো না। আমার অপারগতার কথা কী তোমার জানা নেই?

-আমার কী দোষ বলতে পারো? আমি যে সর্বস্ব উজাড় করে তোমাকে ভালোবেসেছিলাম মিতু। অন্য কাউকে জীবনসঙ্গী করে তাকে আমি ঠকাতে চাইনা। আমার ভালোবাসা কিছু অবশিষ্ট নেই মিতু!

-ভালোবাসা অনেক বড় শক্তির মত! ভালোবাসা কখনো ফুরোয় না ফাহিম। ধরণটা পালটায় শুধু। দেখো তুমি আবার ভালোবাসতে পারবে! দরকার শুধু ইচ্ছাশক্তি আর উদ্যোগ!

-সরি ম্যাম! এই ইচ্ছাশক্তি আর উদ্যোগটুকু আমি খরচ করতে চাইনা। এদের সবটুকু আমি জমা রেখেছি মিতু নামের উজ্জ্বল উচ্ছল এক মেয়ের কাছে!

-এবার মিতু আর না হেসে পারলো না। এতক্ষণের ভারি পরিবেশটা তাতে হালকা হয়!

-সেই চিরচেনা হাসি। বিকেলের এক ফালি রোদ এসে পরম সোহাগে জড়িয়ে ধরেছে মিতুর গা্ল আর, গ্রীবার একপাশ! রোদটাকে ভীষণ হিংসে হতে লাগলো ফাহিমের!

-বিকেলের রোদটা নিশ্চয় পুরুষ, নইলে মেয়েদের ওপর এমনভাবে পড়ে কেনো আরো আকর্ষণীয় করে তোলে! ঠিক বলেছি না। পরজন্মে রোদ্দুর হতে চাই। তারপর ইচ্ছেমত তোমাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে থাকবো।

-তুমি না! লজ্জায় নত হলো মিতুর মুখ।

-কী? আমি না, কী? বলো! বলো মিতু! লজ্জামাখা মিতুর মুখটা অনেক বেশি কমণীয় লাগছে! আগের চেয়ে শরীরটা একটু ভারি হয়েছে মিতুর, কিন্তু তা ওর সৌন্দর্য এতটুকুনও হরণ করতে পারেনি। বরং এতে আরো বেশি আকর্ষণীয় লাগছে ওকে। শরীরের বাঁকে এখনো অপূর্ব পেলবতা! মুখে বুদ্ধির প্রখর দীপ্তি। একটু সরে বসতেই রৌদ্রটা কাঁধের বাঁক পেরিয়ে ওর অনুদ্ধত সুশীল বুকে স্থির হয়ে পড়ে আছে! অপলক তাকিয়ে আছে ফাহিম।

-নিঃশব্দে খাওয়া শেষ করলো দুজনে। ঘড়ির কাঁটা প্রায় চারটা ছুঁইছুঁই। ট্রেন সাড়ে এগারোটায়। অনেকটা সময় বাকি।

-চলো, আজ রাস্তায় রাস্তায় হাঁটবো। চট্টগ্রামে সম্ভব না হলেও এখানে খুব সম্ভব।

-মিতুও যেনো তার হারিয়ে যাওয়া প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে পেলো। নিয়তি যখন আজ এতদিন পর ফাহিমের সাথে ওর মিলন ঘটিয়েছে, ক্ষতি কী যদি অন্তত আজকের দিনটি সমস্ত হিসেব-নিকেষের উর্ধ্বে থাকে!

-বিল মিটিয়ে লিফটের সামনে এসে দাঁড়ালো দুজনে। ফাহিম মিতুর হাতটা ধরলো আলতো করে। মিতু ওর মুখের দিকে চেয়ে একটু হাসলো। সমর্পণের ভঙ্গিতে হাতটা ওর হাতে ছেড়ে দিল মিতু।

-লিফটে উঠে হাতের বাঁধনটা আরো শক্ত করলো ফাহিম। একটু চাপ দিলো মিতুর হাতে।কারো মুখে কোনো কথা নেই। দুটো শরীর যখন কথা বলতে শুরু করে মুখের কথা তখন বাহুল্য মনে হয়।

উবারে ফোন করে একটা গাড়ি পেয়ে গেলো সহজেই। শাহবাগের দিকে ছুটে চললো গাড়ি। অল্প সময়েই শাহবাগে পৌঁছে গেলো ওরা। দুজনেই হাত ধরাধরি করে ছিল। খুব বিরক্ত হলো দুজনেই। আজ রাস্তায় জ্যাম হলে কী এমন ক্ষতি হতো! হাতটা ছেড়ে গাড়ি থেকে নামলো। ফুলের দোকানগুলোর দিকে এগিয়ে গেলো ফাহিম। মিতু নিরবে অনুসরণ করলো ওকে। রজনীগন্ধা কিনে মিতুর হাতে দিল। ফুলগুলো নাকে ছুঁইয়ে গভীরভাবে ঘ্রাণ নিলো মিতু। সেদিকে তাকিয়ে সিগারেট ধরালো ফাহিম। জানো, সিগারেট খাওয়ার সময় নিজেকে পৃথিবীর বাদশাহ্ বলে মনে হয়।

-মিষ্টি করে হাসলো মিতু। এবার ও-ই হাত বাড়িয়ে ফাহিমের হাতটা ধরলো। আজকের জন্য তুমি বাদশাহ আর আমি সুলতানা।

-ফাহিমও আঁকড়ে ধরলো মিতুর নরম হাতটা।

হাঁটতে হাঁটতে আজিজ সুপার মার্কেট হয়ে টিএসসি তে গেলো। ফুটপাতে, বেঞ্চিতে, ঘাসের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে জোড়া জোড়া কপোত-কপোতী। মন ভালো হয়ে গেলো ওদের। মনে হতে লাগলো এভাবেই যদি বেঁচে থাকা যেতো অনাদিকাল। বহুদিন পর এক প্লেট চটপটি আর এক প্লেট ফুচকা কিনে দুজনে ভাগ করে খেলো। কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল না কারুরই। চুপচাপ কেটে গেলো অনেকটা সময়।

-ফাহিমের গায়ের সেই চিরচেনা গন্ধটা খুব ভালো লাগছিল মিতুর। আবেশে চোখ বুজে আসছিল। ফাহিমের পৌরুষের কাছে বরাবরই হারতে রাজি মিতু।

-তোমার চুল এতো কমে গেলো কেনো? নিশ্চয় যত্ন নিচ্ছো না একদম! তা নিবে কেনো? ঐ চুলগুলোই যে আমার বেশি পছন্দের!অভিযোগের সুরে বললো ফাহিম।

-আর যত্ন! তুমি রাগ করোনা ফাহিম। আসলে নিজের কথা আমি বেমালুম ভুলে গেছি। মা যখন বলেন, ‘মিতু, তুই আমার মাথায় হাত দিয়ে প্রতিজ্ঞা কর, আমাদের ছেড়ে কখনো কোথাও যাবিনা। আমার কথা না হোক, অন্তত তোর ছোট ভাই-বোনগুলোর কথা ভেবে তুই আমাদের ছেড়ে যাস না মা’। তুমি তো জানো, বাবা স্ট্রোক করে শয্যাশায়ী হবার পর থেকে মা খুব অসহায় বোধ করেন। সবসময় অনিশ্চয়তায় ভোগেন, ছোট ছোট সন্তানদের ব্যাপারে। দীর্ঘশ্বাস ফেললো মিতু।

-আমরা কী পারিনা মিতু এই দায়িত্বটুকু দুজনে ভাগ করে নিতে? মিতুর হাতটি ধরে অসহায়ভাবে বললো ফাহিম।

-না না ফাহিম। আমি চাইনা আমার এই জীবনের সঙ্গে তুমি জড়াও। তোমার জীবনটা সুন্দর করে গুছিয়ে নাও ফাহিম।

-হা হা হা। সুন্দর জীবন! গোছানো জীবন! হাসালে মিতু। এ যে বিরাট প্রহসন!

-বিয়ে করে ফেলো ফাহিম। ফুটফুটে সুন্দর বাবু হবে তোমার। আমি আছি। আজীবন তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে থাকবো। অবুঝ হয়ো না প্লিজ।

-সময়ই বলে দেবে কে অবুঝের মত কাজ করছে। আমাকে নিয়ে ভেবোনা। বেঁচে থাকার জন্য বিয়ে করাটা খুব জরুরী কিছু নয়। জীবন কেটে যাবে জীবনের নিয়মে! তবে আমার দরোজা তোমার জন্য খোলা থাকবে আমৃত্যু! যদি কখনো কাজে আসি, ডাকতে দ্বিধা করো না। গত কয়েক বছরের মত একদম যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে থেকোনা। এতোটা নিষ্ঠুর হয়ো না মিতু! প্লিজ!

-যে সম্পর্কের পরিণতি নেই, কী দরকার তাকে জিইয়ে রাখার? এতে কষ্ট বাড়ে বৈ কমেনা!

-আচ্ছা, আমরা কী এখানে হা-হুতাশ করতে বসেছি? লেট’স মুভ ডিয়ার! চলো।

দাঁড়িয়ে এক হাত বাড়িয়ে দিল মিতুর দিকে। হাত ধরতেই টেনে তুললো মিতুকে।

আটটা বাজতে চলেছে প্রায়। কমলাপুর ষ্টেশনের দিকে রওনা হয়ে গেলো ওরা।

ষ্টেশনের দোতলায় বিরতি রেস্তোরাতে ঢুকলো ওরা। হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে রাতের খাবার সেরে নিল।

-আর কখনো হয়তো এমন দিন আসবেনা। তবে এই দিনটি জীবনের সেরা প্রাপ্তি হয়ে রইলো। বলেই ফাহিমের দিকে তাকালো মিতু।

গাঢ় দৃষ্টিতে মিতুর দিকে তাকালো ফাহিম, কিছুই বললো না।

অনেক ঝামেলা করে শেষ পর্যন্ত ফাহিম দুজনের সিট পাশাপাশি করতে পারলো। বিজয়ের হাসি ওর মুখে। ট্রেন ছাড়ার একটু পরেই ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসলো মিতুর। ঘুমিয়ে পড়লে আলতো করে মিতুর মাথাটা নিজের কাঁধের ওপর নিলো ফাহিম। একটু নড়ে উঠে আবার ঘুমিয়ে পড়লো মিতু, ফাহিমের কাঁধে মাথা রেখে পরম নিশ্চিন্তে নির্ভার হয়ে। একটা সময় দুজনেই ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লো।

ভোরের আলো চোখে পরতেই প্রথমেই ঘুম ভাঙলো মিতুর। ঘুমন্ত ফাহিমের মুখের দিকে তাকিয়ে ভারী মায়া হলো ওর। নিয়তি বড় বেশি নিষ্ঠুর, মনে মনে ভাবলো মিতু।

ধীরে ধীরে ফাহিমও চোখ মেললো। নেমেই রাঙামাটি যেতে হবে ওকে।আজই জয়েন করতে হবে। মিতুর সঙ্গে কাটানো পুরো সময়টা ওর কাছে একটা স্বপ্নের মত মনে হচ্ছিল।

-সত্যিই কী আমি এতোটা সময় তোমার সাথে ছিলাম মিতু? ওর ঘোর যেনো কিছুতেই কাটছেনা।

-মিষ্টি করে হাসলো মিতু। ধরে নাও স্বপ্ন ছিলো সব। বাস্তবতা হচ্ছে তুমি আমি ছুটবো এখন ভিন্ন ভিন্ন পৃথিবীতে। আমাদের ভূবন সমান্তরাল রেললাইনের মত চলবে আজীবন অথচ মিলিত হবে না কখনোই!

ট্রেন থেকে নেমে দুজনে দু’দিকে যাবার আগে বিদায় নিলো ওরা।

-ওই দূর দিগন্তে চেয়ে থেকো মিতু, সমন্তরাল রেখারা যেখানে মিলিত হয়।

আর দাঁড়াল না মিতু। চোখের জল গোপন করতেই পাশে থাকা একটা সিএনজি তে উঠে পড়লো।

ফাহিম ওর চলে যাবার পথের দিকে তাকিয়ে রইলো, অনেক দূর পর্যন্ত, যেখানে সমান্তরাল রেখারা অনায়াসে মিলিত হয়!

লেখক : ফরিদা ইয়াছমিন সুমি, সহকারী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!