নিউজ ডেক্স : কোভিড সনদ নিয়ে আটকে পড়া প্রবাসীদের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা বাড়ছে। বিদেশ যাত্রার ৭২ ঘন্টার মধ্যে সনদ নেয়ার বাধ্যবাধকতা অনেক প্রবাসীর গলায় ফাঁস হয়ে উঠেছে। রাতভর অপেক্ষা করেও সনদ না পেয়ে গতকাল অন্তত ২৫ প্রবাসী ফ্লাইট মিস করেছেন। আবার কেউ কেউ বিমানবন্দরেই যেতে পারেননি।
অপরদিকে কানেক্টিং ফ্লাইট এবং ঢাকা থেকে যাদের ফ্লাইট তাদের অবস্থা আরো শোচনীয়। ৭২ ঘন্টা সময়ের মধ্যে নমুনা দিয়ে রিপোর্ট হাতে নিয়ে ঢাকায় পৌঁছে বিদেশি ফ্লাইট ধরা শুধু কঠিনই নয়, অসম্ভব হয়ে উঠছে। সার্ভার সংকটের কারণে কোভিড সনদ নিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত সব ঘটনা ঘটছে বলে জানিয়ে সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, লোকবল বাড়িয়ে পরিস্থিতি মোকাবেলার চেষ্টা করা হচ্ছে।
সূত্র জানিয়েছে, বিদেশ যাত্রায় কোভিড নেগেটিভ সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। গত ২৩ জুলাই থেকে বিদেশ যাওয়ার জন্য সকলেরই কোভিড নেগেটিভ সনদ লাগছে। চট্টগ্রামে লক্ষাধিক প্রবাসী নানা সংকট মোকাবেলা করে বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করছেন। এদের প্রত্যেককেই যোগাড় করতে হচ্ছে কোভিড সনদ। চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন কার্যালয়ে পাসপোর্ট ভিসা এবং বিমানের টিকেট দেখিয়ে রেজিস্ট্রেশন করানোর পর একমাত্র জেনারেল হাসপাতালে নমুনা সংগ্রহ এবং ফৌজদারহাটস্থ বিআইটিআইডিতে নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। এর বাইরে চট্টগ্রামের আর কোন ল্যাবের রিপোর্ট গ্রহনযোগ্য নয়। আবার বিআইটিআইডির রিপোর্ট প্রিন্ট কপি নিয়ে বিমানবন্দরে গেলেই হচ্ছে না। এই রিপোর্ট অনলাইনে থাকতে হচ্ছে। যাত্রীর হাতে থাকা প্রিন্ট কপির সাথে ইমিগ্রেশন অফিসার অনলাইনের সনদ মিলিয়ে যথাযথভাবে পেলেই কেবলমাত্র যাত্রীকে বিদেশ যাওয়ার অনুমোদন দিচ্ছে। কোভিড সনদ নিয়ে বিশাল এই কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করতে হচ্ছে ৭২ ঘন্টা সময়ের মধ্যে। যাত্রীর নমুনা দেয়ার দিন থেকে বিমানে উঠা পর্যন্ত ৭২ ঘন্টা হিসেব করা হচ্ছে। এর বেশি হলেও সনদ গ্রহন করা হচ্ছে না। ওই ধরনের যাত্রীদের আবারো নতুন করে সনদ নিয়ে বিমানে চড়তে হচ্ছে।
কোভিড নেগেটিভ সনদ যোগাড় করে বিদেশ যাত্রা একটি কঠিন ব্যাপার হয়ে উঠেছে বলে উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছেন, পুরো বিষয়টি নিয়ে এমন ভয়াবহ এক অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে যে বিদেশ যাত্রীদের ঘুম হারাম হওয়ার উপক্রম হয়েছে। পুরো রাত সিভিল সার্জন অফিসে নির্ঘুম কাটিয়েও রিপোর্ট না পাওয়ার মতো দুঃখজনক ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অনেক প্রবাসী। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে তীব্র ক্ষোভও প্রকাশ করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, রোববার বেলা তিনটার সময় রিপোর্ট দেয়ার নির্ধারিত সময় থাকলেও অধিকাংশ প্রবাসী রিপোর্ট পাননি। ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করে কেউ রাত বারোটায়, কেউ রাত দুইটায়, কেউ ভোর পাঁচটায় এবং সর্বশেষ গতকাল সকাল এগারটায় ওই যাত্রীদের রিপোর্ট দেয়া হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের ২১ ঘন্টা পর্যন্ত বিলম্বে রিপোর্ট দেয়ায় পুরোরাত যাত্রীদের ভোগান্তি চরমে উঠে। পুরো রাত সিভিল সার্জনের অফিসের সামনে লোকজন বসে থেকে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন। কেউ কেউ সিভিল সার্জনের অফিস থেকেই বিমানবন্দর গিয়েছেন। কেউবা ভাই বা বন্ধুকে সিভিল সার্জন অফিসে বসিয়ে রেখে নিজে বিমানবন্দরে চলে গেছেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ রিপোর্ট হোয়াটসঅ্যাপে নিয়ে বিদেশ যেতে পারলেও অনেকেই পথে পথে ঘুরেছেন। গতকাল সকালে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের অন্তত ২৫জন যাত্রী ফ্লাইট ধরতে পারেননি। আবার কেউ কেউ বিমানবন্দরেই যাননি। কয়েকজন গিয়েছেন ফ্লাইট ছেড়ে দেয়ার পর। আবার তিনজনের কোভিড সনদের মেয়াদ ৭২ ঘন্টা পার হয়ে গেছে।
কাজী রবিউল আলম নামের একজন প্রবাসীর সাথে আলাপকালে রোববার রাতের ভোগান্তির কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন যে, এটা অচিন্তনীয়। রেমিটেন্সযোদ্ধা বলা হয় আমাদের। অথচ কোভিড সনদের জন্য যেভাবে ভোগান্তির শিকার হলাম তা কাউকে বলে বুঝানো সম্ভব নয়। বিকেল তিনটায় তাকে রিপোর্ট দেয়ার কথা ছিল। তিনি দুপুর ২টা নাগাদ সিভিল সার্জন কার্যালয়ে পৌঁছান। তখন থেকে শুরু হয় তীর্থের কাকের মতো প্রতীক্ষা। রাত সোয়া দুইটায় তিনি রিপোর্ট পেয়েছেন। ভোর পাঁচটায় তিনি এয়ারপোর্ট পৌঁছেন। তিনি বলেন, আমি যখন রিপোর্ট নিয়ে বের হচ্ছিলাম তখন সিভিল সার্জন কার্যালয়ে দুই থেকে আড়াইশ’ মানুষ অপেক্ষা করছিলেন। যাদের অনেকেই উদ্বেগ এবং উৎকণ্ঠায় অসুস্থ বোধ করছিলেন। কেউ কেউ কান্নাও করছিলেন।
সাতকানিয়ার শাহাদাত হোসেন নামের একজন যাত্রী দুবাই যাওয়ার জন্য কোভিড সনদ নিচ্ছেন। তিনি জানালেন, রোববার বিকেল তিনটায় রিপোর্টের জন্য যাই। কিন্তু রিপোর্ট না পেয়ে অপেক্ষা করতে থাকি। এভাবে পুরো বিকেল সন্ধ্যা এবং রাতভর সিভিল সার্জনের অফিসের সামনে এবং রাস্তায় অবস্থান করি। ভোর পাঁচটা পর্যন্ত থাকি। কিন্তু রিপোর্ট না পেয়ে আমি রিপোর্ট ছাড়াই এয়ারপোর্টে চলে আসি। ওখানে আমার ভাইকে বসিয়ে রাখি। সকাল সোয়া এগারটায় আমার ফ্লাইট ছিল। দশটার দিকে আমার ভাই হোয়াটসঅ্যাপে রিপোর্ট পাঠালে আমি কোনরকমে সেটি নিয়ে বিমানে চড়ি। তিনি রাতভর দুই থেকে আড়াইশ’ মানুষের অপেক্ষা করার কথা উল্লেখ করে বলেন, ভোরে যখন আমি চলে আসি তখনো ওখানে ৪০ জনের মতো লোক রিপোর্টের অপেক্ষা করছিলেন।
মোহাম্মদ কফিল উদ্দিন জাওয়াদ নামের এক ব্যক্তি রাত দুইটায় ফেসবুকে লিখেছেন যে, করোনা রিপোর্ট পাইনি। ভোর পাঁচটায় বিমানবন্দরে যেতে হবে। এই দুঃখ কাকে বুঝাই!সোমবার রাতভর অপেক্ষা করে রিপোর্ট না পেয়ে অনেকেই ফ্লাইট মিস করেছেন। তবে বাংলাদেশ বিমানের এয়ারপোর্ট ম্যানেজার মোহাম্মদ আরিফের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ৮/১০ জন ফ্লাইট মিস করেছেন। কেউ কেউ বিলম্বে এয়ারপোর্টে পৌঁছেছেন। তিনি তিনজনের কোভিড সনদের মেয়াদ ছিল না বলেও উল্লেখ করেন।
যাদের কোভিড সনদের মেয়াদ নেই তাদেরকে আবারো শুরু থেকে সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে নতুন করে কোভিড সনদ সংগ্রহ করতে হবে বলেও সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসীই শুধু নয়, বিশ্বের নানা দেশের বহু ট্রানজিট প্যাসেঞ্জার বিমানে ভ্রমন করছেন। চট্টগ্রাম থেকে ফ্লাইট মিস করায় এদেরকে বড় ধরনের ক্ষতির শিকার হতে হচ্ছে। দুবাই থেকে কানাডা বা আমেরিকায় যাচ্ছেন যেসব যাত্রী তাদের দুবাই থেকে পরবর্তী গন্তব্যের টিকেট নিয়েও সংকট হচ্ছে। অপরদিকে ঢাকা থেকে বিশ্বের নানা দেশে যাবেন যেসব যাত্রী তাদের মধ্যে যাদেরকে চট্টগ্রাম থেকে কোভিড সনদ নিতে হচ্ছে তারাও অনিশ্চয়তায় পড়েছেন। ৭২ ঘন্টা সময়ের বাধ্যবাধকতার মধ্যে কি করে তারা চট্টগ্রাম থেকে কোভিড সনদ নিয়ে ঢাকায় পৌঁছে ফ্লাইট ধরবেন তা নিয়ে ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন অনেকেই।
শুধু সনদ নিয়েই সংকট নয়, করোনাভাইরাস সংক্রমনের শংকাও মাথাছাড়া দিচ্ছে জেনারেল হাসপাতাল এবং সিভিল সার্জন কার্যালয়ে। প্রবাসীসহ বিদেশ যাত্রীদের রেজিস্ট্রেশন এবং নমুনা প্রদান কিংবা অপেক্ষা করার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি বা সামাজিক দূরত্ব মানা হচ্ছে না বলেও যাত্রীদের অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
অপর একজন যাত্রী বলেন, আমার ফ্লাইট ৩০ জুলাই। শনিবার গিয়েছিলাম রেজিস্ট্রেশন করতে। ওখানে বলা হয় যে, রোববার যেতে। রোববার গিয়ে সকাল সাতটা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত চরম আতঙ্ক নিয়ে লাইনে অপেক্ষা করি। অথচ একটার সময় বললো, যাদের ফ্লাইট ৩০ জুলাই তারা মঙ্গলবার সকালে আসবেন। শুধু চট্টগ্রাম মহানগরীর মানুষই নয়, জোরারগঞ্জ কিংবা সাতকানিয়া লোহাগাড়া বাঁশখালী থেকে আসা বহু মানুষকেও দীর্ঘক্ষণ লাইনে থাকার পর ফেরত পাঠানো হয়েছে। প্রবাসীদের এত অনাদর ঠিক নয় বলেও তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, টাকা পয়সা দেয়ার পরও এভাবে হয়রানি অসহ্য।
বিদেশযাত্রীদের ভোগান্তির কথা স্বীকার করে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডাক্তার শেখ ফজলে রাব্বি গতকাল বলেন, বিষয়টি আমাদের নিয়ন্ত্রনে ছিল না। পরীক্ষা করা শেষে আমরা রিপোর্ট পেয়েছিলাম। আমাদের প্রতিবেদনও তৈরি ছিল। কিন্তু ওই রিপোর্ট সার্ভারে না দেয়া পর্যন্ত তা বিদেশযাত্রীদের কোন কাজে লাগবে না। ঢাকায় সার্ভারে আমরা রিপোর্ট দিতে পারছিলাম না। তাই সমস্যা হয়। গতকাল সকাল ১১টার মধ্যে তিনশ’ বিদেশযাত্রীর সকলেরই রিপোর্ট সার্ভারে প্রবেশ করানো সম্ভব হয়েছে বলেও সিভিল সার্জন জানান।
ডাক্তার শেখ ফজলে রাব্বি বলেন, ২০-২৫ জনের মতো যাত্রী ফ্লাইট মিস করেছেন। এদের কেউ কেউ টিকেট পাল্টে নিয়েছেন। আমরা সারারাত কষ্ট করেছি। কাজ করেছি। কিন্তু যান্ত্রিক সমস্যার কারনে কষ্টের রেজাল্ট পাইনি। তিনি আজও (গতকাল সোমবারে) রাত নয়টা পর্যন্ত অফিস করছেন বলে উল্লেখ করে বলেন, আজকের সবার রিপোর্ট আমরা সার্ভারে দিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছি। লোকবল বাড়ানো হয়েছে। যাত্রীদের সংকট সুরাহায় আমরা আন্তরিকভাবে কাজ করছি।
প্রসঙ্গক্রমে তিনি বলেন, চট্টগ্রাম থেকে বিদেশগামীদের অনেকেই কানেক্টিং ফ্লাইটের যাত্রী। তাদের সময়ের প্রয়োজন। তাই তাদেরকে একদিন আগে পরীক্ষা করানো গেলে বাড়তি একদিন সময় হাতে থাকতো। বিষয়টি ঢাকায় বলা হয়েছে বলেও সিভিল সার্জন জানান। তিনি নমুনার জন্য রেজিস্ট্রেশন এবং নমুনা সংগ্রহের বুথ বাড়ানো হয়েছে বলে উল্লেখ করে বলেন, আগে শুধুমাত্র একটি বুথে নমুনা নেয়া হলেও এখন পাঁচটি বুথে নেয়া হচ্ছে। এতে নমুনা দেয়া বা পরীক্ষার ক্ষেত্রে কারো কোন সমস্যা হচ্ছে না। রিপোর্টটি সার্ভারে দেয়ার ক্ষেত্রে যান্ত্রিক সমস্যাটি না হলে অনাকাঙ্খিত এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না বলেও তিনি উল্লেখ করেন। দৈনিক আজাদী