
নিউজ ডেক্স : অবৈধ অস্ত্রের বাজারে হাত বাড়ালেই মিলছে দেশি এলজি ও একনলা বন্দুক। স্থানীয়ভাবে এলজি ও একনলা বন্দুক তৈরি হওয়ায় এবং দামে সস্তা হওয়ায় তা খুব সহজেই চলে যাচ্ছে সন্ত্রাসীদের হাতে।
আগের তুলনায় এখন বিদেশি অস্ত্রের ব্যবহার কমেছে, বেড়েছে দেশি অস্ত্রের ব্যবহার। সীতাকুণ্ড, মহেশখালী, সন্দ্বীপে বেশ কয়েকটি দেশি অস্ত্র তৈরির কারখানা বিগত কয়েক বছরে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। তবে নতুন করে গড়ে উঠেছে কারখানা। এ সব কারখানায় এলজি, একনলা ও পাইপগান তৈরি হচ্ছে। তা চলে যায় স্থানীয় সন্ত্রাসী ও অস্ত্র ব্যবসায়ীদের হাতে। বিদেশি যেসব পিস্তল ও রিভলবার সন্ত্রাসী-অস্ত্র ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে পাওয়া যাচ্ছে, তার গায়ে মেইড ইন ইন্ডিয়া লেখা।

আবার বিদেশি অস্ত্রের অনুকরণে চট্টগ্রামের লেদ মেশিনের কারখানায় তৈরি হচ্ছে অত্যাধুনিক অস্ত্র। নামও রাখা হচ্ছে বিদেশি অস্ত্রের নামে। অনেক ক্ষেত্রে এ অস্ত্রের কার্যকারিতা আরো বেশি। ইতালি, জাপান কিংবা অন্য দেশের অস্ত্র ধরা পড়ার সংখ্যা হাতে গোণা। র্যাব-পুলিশের অভিযানে প্রায়ই ধরা পড়ছে অস্ত্র-গোলাবারুদ। কিছু অস্ত্রবহনকারীও ধরা পড়ছে মাঝে মধ্যে। তবে অবৈধ অস্ত্রের কারবারিরা আড়ালে থেকে যাচ্ছে। সিন্ডিকেটের মূলহোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাওয়ায় অক্ষত থেকে যাচ্ছে তাদের নেটওয়ার্ক। ঠেকানো যাচ্ছে না অবৈধ অস্ত্রের ব্যবসা।

র্যাব-পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, অস্ত্র চোরকারবারি চক্রের মূলহোতারা আড়ালে থেকেই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে। অস্ত্র বহনকারী কিংবা ব্যবহারকারী অস্ত্রসহ ধরা পড়লেও মামলা তদন্তে মূলহোতাদের নাম আসে না। চট্টগ্রাম রেঞ্জ ডিআইজি আনোয়ার হোসেন স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছেন এ অঞ্চলে অস্ত্র ব্যবসার সাথে যারা জড়িত তাদের ব্যাপারে কঠোর অবস্থান পুলিশের।
প্রতিনিয়ত অভিযান চলছে। খোঁজখবরও নেয়া হচ্ছে। অস্ত্রধারী এবং অস্ত্র ব্যবসায়ীদের তালিকাও হালনাগাদ করা হচ্ছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক মামলার আসামি অস্ত্র তৈরির এক কারিগর আজাদীর সাথে আলাপকালে জানান, একটি এলজি তৈরি করতে ছয় থেকে সাত ঘণ্টা সময় লাগে। বাজারে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি করা যায়। একনলা বন্দুক ও পাইপগান বাজারে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকায় বিক্রি করা যায়। দাম কম হওয়ায় দেশি অস্ত্রের চাহিদা এখন বেশি। বিদেশি অস্ত্র এখন শুধু ভারত থেকে চোরাই পথে দেশে আসে। চট্টগ্রাম অঞ্চলে এখন ভারতীয় পিস্তল ও রিভলবার ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকায় মিলছে। দাম বেশি হওয়ায় বিদেশি অস্ত্রের চাহিদা কম।
সাগরের পাশে ও পাহাড়ঘেরা দুই উপজেলা সীতাকুণ্ড ও বাঁশখালী। দুই উপজেলার পাহাড়ে দেশি অস্ত্রের কারখানা বানিয়ে নিরাপদে এলজি তৈরি করছিল সন্ত্রাসীরা। এ ছাড়া মহেশখালীর কালারমারছড়া, হোয়ানক, শাপলাপুর, ছোট মহেশখালী ও বড় মহেশখালী- এ পাঁচ ইউনিয়নের দুর্গম পাহাড়ে থাকা অস্ত্র কারখানায় তৈরি করা এলজিসহ বাঁশখালীতে একাধিক সন্ত্রাসী ধরা পড়েছে সাম্প্রতিক সময়ে আইনশৃক্সখলা বাহিনীর হাতে।
দেশি অস্ত্র তৈরির কারিগরদের অন্যতম সন্দ্বীপের সাইফুল। সে এলজি, একনলা বন্দুক, পাইপগান খুব সহজেই তৈরি করতে পারে। ২০১৮ সালের ২৫ অক্টোবর সন্দ্বীপের রহমতপুর এলাকায় তার অস্ত্র তৈরির কারখানার সন্ধান পায় পুলিশ। সাইফুল ছাড়াও চট্টগ্রামে অস্ত্র তৈরির কারিগর হলো- সন্দ্বীপের মো. মনির ওরফে কালা মনির, বাঁশখালীর জাফরুল ইসলাম, মো. খলিলুর রহমান, আবদুল করিম, উমর মাদু ওরফে মাইদ্যা, রাউজানের আলমগীর ওরফে আলম ডাকাত, পটিয়া- বোয়ালখালীর বেলাল হোসেন। এ অস্ত্র তৈরির কারিগর ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে জেলার বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে।
গত ৩০ মার্চ আনোয়ারা উপজেলায় একটি চায়ের দোকান থেকে একটি ওয়ান শুটার গানসহ একজনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। ২২ ফেব্রুয়ারি পিবিআই চট্টগ্রাম জেলার পুলিশ সুপার নাজমুল হাসানের সার্বিক তত্ত্বাবধানে আশরাফুল ইসলাম (২২) ও রাহাদ হোসেনকে (২৪) গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের থেকে দেশিয় তৈরি রাইফেল ১টি, থ্রি নট থ্রি রাইফেলের গুলি ২ রাউন্ড, কার্তুজের খোসা, হ্যান্ড ফ্লেয়ার, ২টি লোহার কিরিচ উদ্ধার করা হয়।
এরই মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়, গত ২০ ফেব্রুয়ারি ইতালি থেকে আসা চারটি বিদেশি পিস্তল নিয়ে। একসময়ের ‘যুবদল ক্যাডার’ হিসেবে পরিচিত রাজীব বড়ুয়া চট্টগ্রাম কাস্টমসে বিদেশি ডাকের চালানে অস্ত্রগুলি পাঠান। ওই চালানে দু’টি ইতালিতে তৈরি এইট এমএম পিস্তলের সঙ্গে আসে ৬০ রাউন্ড কার্তুজ। বাকি দু’টি খেলনা পিস্তল। সেই চালানের আগেই রাজীব দেশে পৌঁছেছেন। হঠাৎ কেন রাজীবের দেশে ফেরা এবং কেনই বা অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র দেশে নিয়ে আসা- সেই তথ্য বের করতে মরিয়া নগর পুলিশ। নিছক কেনাবেচার উদ্দেশ্যে অস্ত্রগুলো ইতালি থেকে দেশে এনেছিলেন নাকি এর সঙ্গে যুবদল ক্যাডারের আগামী সংসদ নির্বাচন পূর্ববর্তী কোনো পরিকল্পনা আছে, এগুলো এখন বড় প্রশ্ন হয়ে উঠেছে নগর পুলিশের কর্মকর্তাদের কাছে। দেশে ফেরার তথ্য পেয়ে রাজীবকে গ্রেপ্তারের জন্য এখন হন্যে হয়ে খুঁজছে পুলিশ। ১৩ ফেব্রুয়ারি বাঁশখালী থেকে দেশিয় আগ্নেয়াস্ত্র, গুলি ও রামদাসহ মোঃ সাহাব উদ্দিন নামে এক যুবককে আটক করেছে র্যাব-৭।
সীতাকুণ্ড জঙ্গল সলিমপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়েছে বলে দাবি করছে র্যাব। এ ঘটনায় পাঁচ জনকে আটক করা হয়েছে। র্যাব-৭-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম এ ইউসুফ জানান, জঙ্গল সলিমপুর এলাকার মশিউরের আস্তানায় অভিযান চালিয়ে পাঁচজনকে দেশিয় তৈরি বিভিন্ন আকারের ১০টি অস্ত্র, একটি বিদেশি অস্ত্র, ২২টি গুলি, নগদ অর্থসহ বিভিন্ন সামগ্রী উদ্ধার করা হয়। -আজাদী প্রতিবেদন