আন্তর্জাতিক ডেক্স : প্রাণঘাতী ক্যানসারের চিকিৎসায় নতুন আশার আলো দেখছেন যুক্তরাজ্যের একদল চিকিৎসাবিজ্ঞানী। ইমিউনোথেরাপি যেসব ক্যানসার রোগীর শরীরে কাজ করে না, তাদের শরীরে এই রোগের বিস্তার থামাতে সক্ষম নতুন এক চিকিৎসাপদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন তারা।
ইমিউনোথেরাপি সাধারণত মানবদেহের প্রতিরোধী ক্ষমতাকে ব্যবহার করে ক্যানসার কোষকে লক্ষ্যবস্তু বানায় এবং ধ্বংস করে। সার্জারি, রেডিওথেরাপি বা কেমোথেরাপির মতো বিকল্পগুলো ব্যর্থ হলে ইমিউনোথেরাপির ব্যবহারে রোগীর জীবন বেঁচে যায়। তবে ইমিউনোথেরাপি অনেক সময় সব রোগীর শরীরে কাজ করে না। এমনকি ইমিউনোথেরাপি প্রয়োগের পরও অনেক রোগীর টিউমার বড় হয়ে যায়।
এখন যুক্তরাজ্যের ক্যানসার বিশেষজ্ঞরা প্রাণঘাতী এই রোগের নতুন আরেকটি চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কারের দাবি করেছেন। দুই পদ্ধতির মিশ্রণে তৈরি এই চিকিৎসা বিদ্যমান পদ্ধতিতে যাদের আর চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব নয় এবং বিকল্প না পেয়ে যারা মৃত্যুর অপেক্ষা করছেন তাদেরকে আরও বেশি দিন বাঁচার সুযোগ করে দেবে বলে আশা করছেন তারা।
দেশটির ক্যানসার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে সকল ক্যানসার রোগীর শরীরে ইমিউনোথেরাপি কাজ করে না, তাদের জন্য পরীক্ষামূলক ওষুধ গুয়াডেসাইটাবিনের সাথে ইমিউনোথেরাপির সমন্বয়ে তৈরি নতুন একটি চিকিৎসাপদ্ধতি সফল হতে পারে। ইমিউনোথেরাপিতে ব্যবহৃত ওষুধ পেমব্রোলিজুমাব এবং পরবর্তী প্রজন্মের ডিএনএ হাইপোমিথিলেটিং এজেন্ট গুয়াডেসাইটাবিনের মিশ্রণে তৈরি এই চিকিৎসা পরীক্ষামূলকভাবে কয়েকজন ক্যানসার রোগীকে প্রয়োগ করা হয়েছিল।
প্রথম ধাপের পরীক্ষায় দেখা গেছে, নতুন এই চিকিৎসাপদ্ধতি ট্রায়ালে অংশ নেওয়া এক-তৃতীয়াংশ রোগীর শরীরে ক্যানসারের ব্স্তিার প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়েছে। ইমিউনোথেরাপি অব ক্যানসার নামের এক সাময়িকীতে ব্রিটিশ বিজ্ঞানীদের গবেষণার এই ফল প্রকাশিত হয়েছে।
ইনস্টিটিউট অব ক্যানসার রিসার্চ অ্যান্ড রয়েল মার্সডেন ফাউন্ডেশন ট্রাস্টের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দ্বৈত মিশ্রণের এই চিকিৎসাপদ্ধতি বিভিন্ন ধরনের ক্যানসারের বিরুদ্ধে কার্যকর নতুন অস্ত্র হয়ে উঠতে পারে।
রয়েল মার্সডেন এবং ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন হাসপাতালে প্রথম ধাপের এই চিকিৎসাপদ্ধতির পরীক্ষা চালানো হয়েছে। সেখানে চিকিৎসাধীন ফুসফুস, স্তন, প্রোস্টেট এবং অন্ত্রের ক্যানসারের রোগীদের এই চিকিৎসা দেওয়া হয়।
গবেষণার প্রধান তদন্তকারী জোহান দে বোনো বলেছেন, আমি মনে করি—এই ট্রায়ালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম হল, আমরা রোগ প্রতিরোধব্যবস্থায় পরিবর্তন দেখার জন্য একাধিক ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করেছি। তবে এতে মিশ্র চিকিৎসাপদ্ধতিটি সবচেয়ে বেশি কাজ করেছে বলে আমরা দেখেছি।
ইনস্টিটিউট অব ক্যানসার রিসার্চের এক্সপেরিমেন্টাল ক্যানসার মেডিসিনের অধ্যাপক এবং রয়েল মার্সডেনের কনসালট্যান্ট মেডিকেল অনকোলজিস্ট দে বোনো বলেন, আমরা আশা করছি, যদি অন্যান্য রোগীদের শরীরে পরীক্ষা চালিয়ে এবং ভবিষ্যৎ গবেষণায় নতুন এই চিকিৎসাপদ্ধতির কার্যকারিতা দীর্ঘমেয়াদে নিশ্চিত করা যায়, তাহলে গুয়াডেসাইটাবিন এবং পেমব্রোলিজুমাব ব্যবহার করে তা অনেক ধরনের ক্যানসারের চিকিৎসায় ইমিউনোথেরাপিকে কার্যকর করে তুলতে সহায়তা করতে পারে।
ট্রায়ালে ৩৪ জন ক্যান্সার রোগীর চিকিৎসায় পেমব্রোলিজুমাব এবং গুয়াডেসিটাবাইনের দ্বৈত মিশ্রণ ব্যবহার করা হয়েছিল। যাদের ৩০ জনের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা এবং ক্যানসারের বৃদ্ধি বিশ্লেষণ করা হয়েছিল। তিন বছর ধরে চালানো এই ট্রায়ালে প্রত্যেক তিন সপ্তাহ পর টানা চার দিন রোগীদের গুয়াডেসাইটাবিন ইনজেকশন দেওয়া হয়। আর প্রথম দিনে পেমব্রোলিজুমাব দেওয়া হয়েছিল।
পেমব্রোলিজুমাব একটি ইমিউন চেকপয়েন্ট ওষুধ। যা ইতিমধ্যে ফুসফুস এবং ত্বকের ক্যানসারসহ বিভিন্ন ধরনের ক্যানসারের চিকিৎসায় সফল প্রমাণিত হয়েছে। তবে টিউমার কখনো কখনো এই ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে উঠতে পারে এবং কিছু রোগীর ক্ষেত্রে এই চিকিৎসা প্রথম দিকে কার্যকর হলেও পরে অসুস্থ হয়ে পড়েন বলে গবেষণায় দেখা গেছে।
ইনস্টিটিউট অব ক্যানসার রিসার্চের ক্লিনিক্যাল সায়েন্টিস্ট ও রয়েল মার্সডেনের কনসালট্যান্ট মেডিকেল অনকোলজিস্ট গবেষক দলের প্রধান আন্না মিনচম বলেন, গত দশকে ক্যানসারের চিকিৎসায় ইমিউনোথেরাপি চমকপ্রদ কার্যকারিতা দেখিয়েছে। সব ধরনের ক্যানসারে এটি ভালো কাজ করে না এবং কিছু কিছু ক্যানসার এই ওষুধের প্রতিরোধী হয়ে উঠতে পারে। তবে ইমিউনোথেরাপি কার্যকর না হলে নতুন এই মিশ্র চিকিৎসাপদ্ধতি ক্যানসারকে লক্ষ্যবস্তু বানানোর উপায় হতে পারে।
চিকিৎসক, গবেষক এবং ট্রায়ালের সাথে জড়িত বিজ্ঞানীরা বলছেন, ওষুধের বিরুদ্ধে ক্যানসারের এই প্রতিরোধী হয়ে ওঠা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করতে পারে গুয়াডেসাইটাবিন।
ট্রায়ালে অংশ নেওয়া যে ৩০ জন রোগীর ক্যানসারের গতিবিধি বিশ্লেষণ করা হয়েছিল তাদের মধ্যে ৩৭ শতাংশের শরীরে রোগটি থামানো সম্ভব হয়েছিল এবং ২৪ সপ্তাহ বা তারও বেশি সময় ধরে তাদের শরীরে টিউমার আর বাড়েনি। পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার আগে প্রায় তিন-পঞ্চমাংশ (৬০ শতাংশ) রোগী ইমিউনোথেরাপি প্রতিরোধী ছিলেন। অর্থাৎ তাদের শরীরে ইমিউনোথেরাপি কোনও কাজ করতো না। তাদের প্রতি ১০ জনের মধ্যে চারজন (৩৯ শতাংশ) নতুন ওষুধটি নেওয়ার পরও আর অসুস্থ হননি।
নতুন এই চিকিৎসাপদ্ধতি ফুসফুসের ক্যান্সার রোগীদের জন্য বিশেষভাবে উপকারী বলে জানিয়েছেন গবেষকরা। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা ইমিউনোথেরাপি প্রতিরোধী ছিলেন, তাদের অর্ধেকের শরীরে ২৪ সপ্তাহ বা তারও বেশি সময় ধরে ক্যানসার নিয়ন্ত্রণে ছিল।
যুক্তরাজ্যের ডরসেটের ৬১ বছর বয়সী বাসিন্দা আলিসন সোডেন চার বছর ধরে ফুসফুসের ক্যানসারের চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। তাকে বলা হয়েছিল, আর মাত্র এক বছর বাঁচবেন। কিন্তু পরের তিন বছর তিনি পেমব্রোলিজুমাব নিয়েছেন। এখন তিনি পুরোপুরি ক্যানসার মুক্ত।
তিনি বলেন, আমি জানি আমার ক্যানসার আবারও ফিরে আসতে পারে এবং চিকিৎসা প্রতিরোধী হয়ে উঠতে পারে। তাই ইমিউনোথেরাপি প্রতিরোধী ক্যানসারের চিকিৎসার লক্ষ্যে গবেষণার প্রচেষ্টা চলছে জেনে আশ্বস্ত হচ্ছি। আমি আশা করছি, নতুন এই পরীক্ষামূলক ওষুধের মিশ্রণটি শেষ পর্যন্ত হাসপাতালে পৌঁছে যাবে এবং যারা পেমব্রোলিজুমাব নিতে পারছেন না তাদের সহায়তা করবে।
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান।