নিউজ ডেক্স : কিশোরী তাসফিয়ার হত্যাকারী কে? সে কি নিজেই আত্মহনন করেছে; নাকি অন্য কেউ খুন করেছে? ১৬ বছরের একটি মেয়ে কেনইবা নিজেকে শেষ করে দেবে? তবে কি প্রেমিক আদনান এক বা একাধিক জনের সহায়তায় তাসফিয়াকে খুন করলো? তাসফিয়ার পরিধানের কাপড়েইবা কেন এত গরমিল? আত্মহত্যাই যদি করবে, তবে অত দূরে যাওয়ার কী প্রয়োজন ছিল? তাকে খুন করে কি তবে লাশ নেভালে ফেলে আসা হয়েছে? এখানেই শেষ নয়, এধরনের অসংখ্য প্রশ্ন উঠছে তাসফিয়ার মৃত্যুকে ঘিরে। যে যার মতো রায়ও জানিয়ে দিচ্ছে। তর্ক–বিতর্কও চলছে সমান তালে।
তবে রহস্য উদঘাটনের মধ্য দিয়ে এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে একমাত্র পুলিশই। এ ঘটনায় গতকাল তার পিতা মো. আমিন বাদী হয়ে পতেঙ্গা থানায় একটি হত্যা মামলা (নং ৩) দায়ের করেছেন। মামলায় তাসফিয়ার ‘প্রেমিক’ আদনানসহ ছয়জনের নামোল্লেখ এবং অজ্ঞাতনামা আরো পাঁচ–ছয়জনকে আসামি করা হয়েছে। মামলার অন্য আসামিরা হলো, সৈকত মিরাজ, আশিক মিজান, ইমতিয়াজ সুলতান ইকরাম, মো. মোহাইমিন ও মো. ফিরোজ। প্রসঙ্গত: গত ২ মে বুধবার সকালে নগরীর পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতের ১৮ নম্বর ব্রিজঘাটে পাথরের ওপর থেকে সানসাইন স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্রী তাসফিয়া আমিনের মরদেহ উদ্ধার করে পতেঙ্গা থানা পুলিশ। পরে একইদিন সন্ধ্যায় নগরীর খুলশী থানার জালালাবাদ হাউজিং সোসাইটি এলাকা থেকে পুলিশ অভিযান চালিয়ে তাসফিয়ার বন্ধু আদনান মির্জাকে (১৬) জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে যায়। মামলা হওয়ার পর তাকে গ্রেফতার দেখিয়ে গতকাল বিকেলে আদালতে চালান করা হয়। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানায়। এ বিষয়ে অতিরিক্ত উপ–পুলিশ কমিশনার
(প্রসিকিউশন) নির্মলেন্দু বিকাশ চক্রবর্তী জানান, আদনানকে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আবু সালেম মোহাম্মদ নোমানের আদালতে হাজির করা হয়েছে। পুলিশ ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেছে। আগামী রোববার ৬ মে রিমান্ড শুনানির দিন ধার্য করেছে আদালত। পরে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। আদনান মির্জা বাংলাদেশ এলিমেন্টারি স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র এবং ব্যবসায়ী ইস্কান্দার মির্জার ছেলে।
সিএমপির এডিসি (বন্দর) আরেফিন জুয়েল এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমরা দুটো বিষয় নিয়ে কাজ করছি। প্রথমটি হলো, তাসফিয়া নেভাল কীভাবে গেল? আর দ্বিতীয়টি হলো, সে বাসায় যাওয়ার পর তার মা–বাবা এমন কোনো আচরণ করেছিল কিনা, যার ফলে সে বাসা থেকে বের হয়ে নেভাল চলে যায়। এজন্য তার পরিবারের সদস্যদের আমরা আলাদা আলাদা ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করবো। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ মর্গে তাসফিয়ার ময়নাতদন্ত শেষে আজ (গতকাল বৃহস্পতিবার) দুপুরে তার মরদেহ পরিবারের সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তাসফিয়ার লাশ নিয়ে তারা সবাই গ্রামের বাড়ি টেকনাফ গেছে। সেখান থেকে এলে আমরা কথা বলবো।’
একই প্রসঙ্গে সিএমপির এসি (কর্ণফুলী) মো. জাহেদুল ইসলাম বলেন, আমরা তাসফিয়ার মৃত্যুকে ঘিরে বেশ কিছু তথ্য পেয়েছি। এসব তথ্য যাচাই বাছাই চলছে। মধ্যে মধ্যে কয়েকটা স্থানে গ্যাপ আছে। সেগুলো ফিলআপ করতে পারলে আমরা ক্লিয়ার হয়ে যাবো। কী ধরনের গ্যাপ জানতে চাইলে তিনি বলেন, যেমন তাকে নেভালে দেখেছে এমন কয়েকজনকে আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। আদনানকেও রাতভর জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। সে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একই ধরনের বক্তব্য দিয়ে গেছে। মধ্যরাতে আদনানকে নিয়ে তার বাসায় গেছি। আদনানের মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়েছে। তার মোবাইলের কললিস্ট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, হোয়াইটসঅ্যাপসহ অন্যান্য অ্যাপসের মাধ্যমে তথ্য আদান–প্রদানের তথ্য সংগ্রহ করছি। আমরা আরো জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডের আবেদন করেছি। তারপর ধরুন, তার কাছে তো টাকাপয়সা ছিল না। সে কোনো বান্ধবীর বাসায় গিয়ে টাকা ধার নিয়েছিল কিনা, সেটা নিশ্চিত হতে তার বান্ধবিদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তার পোশাকের ভিন্নতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা আজ (গতকাল বৃহস্পতিবার) আবারো নিশ্চিত হয়েছি, কাপড় একই। তিনি আরো বলেন, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন না পাওয়া পর্যন্ত এটি হত্যাকাণ্ড না আত্মহত্যা সে বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলা যাবে না।
এদিকে মামলার অন্য আসামিদের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এসি জাহেদ জানান, এরা আদনানের সিনিয়র। পাড়ার বড় ভাই। রাতভর তারাও খোঁজাখুঁজি করেছিল। এখন বাদী যেহেতু এজাহারে তাদের নাম উল্লেখ করেছে সেহেতু আমরা তাদের সম্পৃক্ততার বিষয়টি নিয়েও কাজ করছি।
তবে ভিন্ন একটি সূত্র থেকে জানা যায়, তাসফিয়ার বন্ধু আদনান মুরাদপুর এলাকার জনৈক যুবনেতা ফিরোজের অনুসারী, তিনিও এই মামলার এজাহারভুক্ত আসামি। বেশ কিছুদিন আগে তাসফিয়ার সাথে আদনান মির্জার সম্পর্কের বিষয়টি জানতে পেরে তাসফিয়ার মাধ্যমে আদনানকে তাদের বাসায় ডেকে আনেন তার বাবা। আদনান আসার পর তাকে বলা হয় তার বাবাকেও ডেকে আনতে, না হলে তাকে (আদনানকে) ছাড়া হবে না। পরে আদনান ফোন করে স্থানীয় কিছু ছেলে এনে তাসফিয়ার বাবাকে হুমকি ধমকি দিয়ে তাদের বাসা থেকে চলে যায়। সেদিন এজাহারভুক্ত আসামিরাও ছিল। গত মঙ্গলবার তাসফিয়ার সন্ধান না পাওয়ায় তার মা বাবা ফিরোজের দ্বারস্থ হন। ফিরোজ তাঁদের বলেন, দুই ঘণ্টার মধ্যে তাসফিয়াকে খুঁজে এনে দেবেন। কিন্তু তা পারেন নি তিনি। পরে ফিরোজ ও আদনান আত্মগোপন করেন। এরপর গতকাল প্রথমে ফিরোজকে খুঁজে বের করে পুলিশ। তার মাধ্যমে আদনানের খোঁজ পায়। তবে এ বিষয়টি সঠিক নয় বলে জানিয়েছে পুলিশ।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আদনান পুলিশকে জানিয়েছে, মঙ্গলবার তারা প্রথমে সিআরবি যায়। সেখান থেকে স্টেডিয়াম সংলগ্ন গ্রিডিগার্টস রেস্টুরেন্টে বসে। সেখানে কিছু খায়নি তারা। অর্ডারও দেয় নি কোনো খাবারের। পরে দু’জন সিএনজি অটোরিকশা করে গোলপাহাড় মোড়ের চায়না গ্রিল রেস্টুরেন্টে যায়। সেখানে সোহেল নামে তাদের আরেক বন্ধু ছিল। কিছুক্ষণ পর তাসফিয়ার মা সোহেলকে ফোন করে তাসফিয়াকে দ্রুত বাসায় যেতে বলেন। এসময় আদনানের কাছ থেকে ১০০ টাকা নিয়ে তাসফিয়া রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে সিএনজি টেক্সিতে উঠে। সন্ধ্যা ৭টার দিকে তাসফিয়ার মা আবার আদনানকে ফোন করে তাসফিয়া কোথায় সেটা জানতে চান। তখন তাসফিয়ার বাসায় যায় আদনান। রাত ১২টা পর্যন্ত আদনান এবং তাসফিয়ার পরিবারের সদস্যরা তাকে বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ করেন। এরপর বুধবার সকালে তাসফিয়ার মরদেহ পাওয়া যায়। আদনান মির্জাকে জিজ্ঞাসাবাদ, ভিডিও ফুটেজ, সৈকতে স্থানীয়দের সঙ্গে কথোপকথন, লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন এবং সর্বোপরি আদনানের কল লোকেশনের তথ্য বিশ্লেষণ করে তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা নিশ্চিত যে প্রেমঘটিত কারণেই তাসফিয়ার মৃত্যু হয়েছে। প্রশ্ন হলো সে নেভালে কেন গিয়েছিল?
তাসফিয়ার পারিবারিক সূত্র জানায়, ওই কিশোরী ঘর থেকে বের হওয়ার সময় তার মা বিশ্রামে ছিলেন। তাদের বাসার নিরাপত্তারক্ষী জানিয়েছেন, ঘটনার দিন অর্থাৎ মঙ্গলবার বিকেল পৌনে পাঁচটায় তাসফিয়ার বাবা মসজিদে নামাজ পড়তে যান। এর কয়েক মিনিটের মধ্যে তার ছোট ভাই ও চাচাতো ভাইও বাইরে যায়। তারা বের হওয়ার দুই–আড়াই মিনিট পর তাসফিয়া বাসা থেকে বের হয়। এরপর থেকে তার সন্ধান আর পাওয়া যায় নি।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট অপর একটি সূত্র জানায়, তাদের হাতে কয়েকটি ভিডিও ফুটেজ এসেছে। মঙ্গলবার রাতে গোলপাহাড়ের মোড়ে অবস্থিত রেস্টুরেন্ট চায়না গ্রিল থেকে সিসিটিভির একটি ভিডিও ফুটেজ উদ্ধার করা হয়। সেখানে দেখা যায়, মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টা ১৫ মিনিটে প্রবেশ করে তাসফিয়া ও আদনান। সন্ধ্যা ৬টা ৩৭ মিনিটে তাসফিয়া ও আদনানকে একসঙ্গে বের হতে দেখা যায়। এ সময় আদনানকে বিল দিতেও দেখা যায়। ওই রেস্টুরেন্টের কর্মচারী উজ্জ্বল দাস আইসক্রিম সার্ভ করেছিলেন। গতকাল তিনি জানান, তাসফিয়া ও আদনান ২০–২২ মিনিট দোকানে ছিল। তারা দুটি আইসক্রিম অর্ডার করেছিল। দুটি আইসক্রিমের দাম আসে ভ্যাটসহ ৩৭৫ টাকা। তারা বিল দিয়ে বের হয়ে যাওয়ার পর উজ্জ্বল ওই টেবিলে গিয়ে দেখতে পান তারা আইসক্রিম খায়নি।
এদিকে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত এলাকার ছিনতাইকারিদের হাতে তাসফিয়া নিহত হতে পারে– এমন সন্দেহও উড়িয়ে দিচ্ছে না পুলিশ। চায়না গ্রিল থেকে বের হয়ে সিএনজি টেক্সি করে রওনা দেওয়ার সময় তাসফিয়ার হাতে একটি দামি মোবাইল ফোন ও স্বর্ণের আংটি ছিল। তাসফিয়ার লাশ উদ্ধারের পর সেই মোবাইল ফোন ও আংটি পাওয়া যায়নি। পারিবারিক সূত্র জানিয়েছে, তার হাতে মোবাইল থাকলেও সেটিতে সিম ছিল না। স্কুলে যাতায়াত ছাড়া তার মোবাইলে সিম দেওয়া হতো না। তবে বাসায় ওয়াইফাই সংযোগ আছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে সে বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করত।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তাসফিয়ার লাশ খুঁজে পাওয়ার স্থানটিতেই বসে থাকতে দেখেছিল এক তরুণ। সে সময় তার পাশে একটি ক্যান এবং ফায়ার বক্স দেখতে পায়। এসময় নিচে নেমে পাথরের কাছে গিয়ে তাসফিয়াকে হাঁটাহাঁটি করতেও দেখে সে। একইভাবে রাত দশটার দিকে গাড়ি নিয়ে সৈকতে ঘুরতে যাওয়া তিনটি ছেলে তাসফিয়াকে নেভালে পাথরের উপর বসে থাকতে দেখেছিল। তারা একবার ভাবে যে মেয়েটির সাথে কথা বলবে। পরে এটা কোনো ফাঁদ হতে পারে ভেবে গাড়ি ঘুরিয়ে চলে আসে। কিছুদূর আসার পর তারা নিজেরাই মনস্থির করে মেয়েটির কোনো বিপদ হলো কিনা তা জানার চেষ্টা করবে। এই ভেবে স্থানীয় কয়েকজনসহ সেখানে গিয়ে দেখে মেয়েটি নেই। তারা ভেবে নেয় মেয়েটি বুঝি চলে গেছে।
সূত্র : দৈনিক আজাদী