ব্রেকিং নিউজ
Home | দেশ-বিদেশের সংবাদ | বাংলাদেশে কর্মস্থলে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে, সবচেয়ে বেশি পরিবহন খাতে

বাংলাদেশে কর্মস্থলে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে, সবচেয়ে বেশি পরিবহন খাতে

বিশ্লেষকরা বলছেন, চালকদের মধ্যে বেপরোয়া মনোভাব দেখা যায়, কারণ তারা প্রতিযোগিতা করে বেশি ট্রিপ দিতে চায়। এটা দিনদিন আরও বাড়ছে।

নিউজ ডেক্স : কয়েক বছর আগে বাস চালানোর সময় মুখোমুখি আসা আরেকটি বাসের সঙ্গে সংঘর্ষ হলে গুরুতর আহত হন বাবুল মিয়া। সেই দুর্ঘটনায় তার সহকারী নিহত হন।

এরপর দীর্ঘদিন চিকিৎসা এবং মামলা মোকদ্দমার পর তিনি মুক্তি পান। কিন্তু এখনো তিনি সেই দুর্ঘটনার ধকল পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেননি। ”প্রায় এক মাস বিছানায় ছিলাম। কোন ক্ষতিপূরণ কিছু পাই নাই। আমার হেলপার মারা গেছে, সেও কিছু পায় নাই। এখনো আমার মাথায় সেই ঘটনার দাগ আছে,” বলছিলেন বাবুল মিয়া।

শ্রমিক অধিকার নিয়ে কাজ করে, বাংলাদেশের এমন একটি বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব লেবার স্টাডিজ বা বিলস এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, গত এক বছরে কর্মক্ষেত্রে মৃত্যু হয়েছে এক হাজার ৫৩ জনের, যা আগের বছরের চেয়ে প্রায় ৪৪ শতাংশ বেশি। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মারা গেছেন পরিবহন খাতের শ্রমিকরা, ৫১৩ জন।

সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে এই পরিসংখ্যান তৈরি করেছে বিলস। ২০২০ সালে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ৭২৯ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছিল। এসব মৃত্যুর পেছনে সড়ক দুর্ঘটনা, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়া, অগ্নিকাণ্ড, বজ্রপাত, উপর থেকে পড়ে যাওয়া, পড়ন্ত বস্তুর আঘাত, বিষাক্ত গ্যাস, নৌ দুর্ঘটনা, দেয়াল বা ছাদ ধসে পড়া বা সিলিন্ডার বিস্ফোরণের মতো ঘটনা রয়েছে।

বিলস জানিয়েছে, ২০১৫ সালে কর্মস্থলে মারা গিয়েছিল ৩৬৩ জন। ২০১৭ সালে ৬৯৯ জন, ২০১৮ সালে ৭৮৪ জন এবং ২০১৮ সালে ১০২০ জন এবং ২০১৯ সালে ১২০০ জনের মৃত্যু হয়েছিল।

বাসে উঠতে চাওয়া যাত্রী
ছবির ক্যাপশান,বাংলাদেশে সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর দেশটিতে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ছয় হাজার ২৮৪ জন। বিলসের প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, সড়ক দুর্ঘটনায় যাত্রী ও পথচারীদের পাশাপাশি পরিবহন শ্রমিকরাও ব্যাপক হারে হতাহত হয়েছেন।

পরিবহন খাতে সবচেয়ে বেশি কর্মীর মৃত্যু

বাংলাদেশে সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর দেশটিতে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ছয় হাজার ২৮৪ জন। বিলসের প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, সড়ক দুর্ঘটনায় যাত্রী ও পথচারীদের পাশাপাশি পরিবহন শ্রমিকরাও ব্যাপক হারে হতাহত হয়েছেন।

দুর্ঘটনায় পরিবহন খাতের এতো শ্রমিক-কর্মীর মৃত্যুর কারণ ব্যাখ্যা করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের পরিচালক ড. মোঃ হাদিউজ্জামান বলেছেন, ”যখন সড়ক দুর্ঘটনা হয়, তখন সাধারণ যাত্রী যেমন মারা যায়, কর্মীরাও কিন্তু হতাহত হয়। ভারী যানবাহনের ফিটনেসের অভাব রয়েছে। চালকদের মধ্যে বেপরোয়া মনোভাব দেখা যায়, কারণ তারা প্রতিযোগিতা করে বেশি ট্রিপ দিতে চায়। এটা দিনদিন আরও বাড়ছে। সেই সঙ্গে মাদকাসক্তির একটা প্রভাব রয়েছে।”

তিনি মনে করেন, এর বড় কারণ চালক ও সহকারীদের অতিরিক্ত ঘণ্টা ধরে গাড়ি চালানোর প্রবণতা। কারণ গাড়ির মালিকরা গাড়ির ভাড়া হিসাবে নির্দিষ্ট অংকের টাকা নিয়ে নেন। ফলে চালক-সহকারীরা চেষ্টা করে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বেশি ট্রিপ দিয়ে, বেশি যাত্রী নিয়ে মুনাফা করার। এসব কারণে দুর্ঘটনা হয়।

গার্মেন্ট কারখানা
ছবির ক্যাপশান,ভয়াবহ কয়েকটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর বিদেশি ক্রেতাদের চাপে গার্মেন্টস কারখানাগুলোতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নত হয়েছে। কিন্তু অন্য কারখানার ব্যাপারে নজর কম।

শুধু দুর্ঘটনা নয়, নির্যাতনেও মৃত্যু

কর্মক্ষেত্রে শুধুমাত্র দুর্ঘটনা নয়, নির্যাতনে শ্রমিকদের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এরকম নির্যাতনে পরিবহন খাতেই ৭৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। ব্যক্তিগত শত্রুতা, দলবদ্ধ হামলা বা সহিংসতা এ জন্য দায়ী বলে বিলস জানিয়েছে। অনেক সময় হামলায় আহত হলেও পরে তাদের মৃত্যু হয়েছে।

বিলসের তথ্য অনুযায়ী, কর্মক্ষেত্রে মৃত্যুর তালিকায় আরও রয়েছে নির্মাণ, কৃষি, দিনমজুরের মতো পেশার মানুষ। অন্যদিকে যেসব পেশার কর্মীরা কাজ করতে গিয়ে আহত হয়েছে, সেসব পেশার মধ্যে রয়েছে মৎস্য, পরিবহন, নির্মাণ ও জাহাজ ভাঙ্গার মতো শিল্প।

বিলস বলছে,গত কয়েক বছর ধরেই কর্মক্ষেত্রে হতাহতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। আর পরিবহন ও নির্মাণ খাত সবসময়েই এই তালিকার শীর্ষে থাকছে। কাজের পরিবেশ নিরাপদ করে তুলতে কয়েকটি সুপারিশ তুলে ধরেন বিলসের একজন পরিচালক নাজমা ইয়াসমিন।

”আমরা যদি গত সাতবছরের তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখা যাবে ক্রমান্বয়ে এসব হতাহতের ঘটনা বাড়ছে। আমরা মনে করি, এগুলো বন্ধ করতে আইন প্রণয়ন এবং আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন খুবই জরুরি।” বলছেন নাজমা ইয়াসমিন।

তিনি বলছেন, কর্মস্থলে দুর্ঘটনার দিক থেকে পরিবহন খাত এক নম্বরে রয়েছে। এরপরেই রয়েছে নির্মাণ খাত। চালকদের প্রশিক্ষণ আর নির্মাণ খাতের সুরক্ষা সরঞ্জাম ব্যবহারে সচেতনতার অভাব এজন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী বলে তিনি মনে করেন।

বিশ্লেষকদের অভিযোগ, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের নিরাপত্তা নিয়ে অনেক কাজ হলেও বাকি খাতগুলো এখনো নজরের বাইরে রয়ে গেছে।

কারখানায় আগুন
ছবির ক্যাপশান,কর্মস্থলে মৃত্যুর পেছনে সড়ক দুর্ঘটনা, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়া, অগ্নিকাণ্ড, বজ্রপাত, উপর থেকে পড়ে যাওয়া, পড়ন্ত বস্তুর আঘাত, বিষাক্ত গ্যাস, নৌ দুর্ঘটনা, দেয়াল বা ছাদ ধসে পড়া বা সিলিন্ডার বিস্ফোরণের মতো ঘটনা রয়েছে। (ফাইল ফটো)

কর্তৃপক্ষ কী বলছে

বাংলাদেশের শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ এহসানে এলাহী বলছেন, সীমাবদ্ধতা থাকলেও কাজের পরিবেশ নিরাপদ করতে তারা চেষ্টা করছেন।

মি. এলাহী বলছেন, নিরাপদ কর্ম পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য আমরা প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের কলকারখানা পরিদর্শন দপ্তর সবসময় পরিদর্শন করছে, যেখানে ত্রুটি পাওয়া যাচ্ছে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। কমপ্লায়েন্স করার জন্য নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে। কেউ সেটা পালন না করলে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হচ্ছে। কিন্তু তারপরেও কেন কর্মস্থলে নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা যাচ্ছে না? কেন এতো বেশি হতাহতের ঘটনা ঘটছে?

এই প্রশ্নের জবাবে মোঃ এহসানে এলাহী বলছেন, ”আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। অনেকগুলো খাতে আমরা পৌঁছাতে পারিনি। জনবল বৃদ্ধির জন্য আমরা লিখেছি, অর্গানোগ্রাম চেঞ্জ করেছি। জনবল বৃদ্ধি হলে তখন আমরা সব ক্ষেত্রে আগাতে পারবো।”

তবে শ্রমবাজার নিয়ে কাজ করেন, এমন বিশ্লেষকরা বলছেন, কর্মক্ষেত্রে নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি করতে হলে একদিনে যেমন আইনের কার্যকর প্রয়োগ করতে হবে, তেমনি মালিক ও কর্মীদের মধ্যে সচেতনতাও বৃদ্ধি করতে হবে। -বিবিসি বাংলা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!