Home | দেশ-বিদেশের সংবাদ | ‘দোজখ’ থেকে ওরা পালিয়ে এসেছেন

‘দোজখ’ থেকে ওরা পালিয়ে এসেছেন

Arkan

নিউজ ডেক্স : শিশুটি চাঁদের মতো ফুটফুটে। বয়স মাত্র ২১ দিন। ওই শিশুকে কোলে নিয়ে চার দিন হেঁটে পাহাড়, জঙ্গল, খাল পেরিয়ে প্রতিবেশীদের সাথে গতকাল মঙ্গলবার সকালে কুতুপালং এসেছেন ১৭ বছরের হুসনেমা। সকাল ১০টার দিকে কথা হয় তার সঙ্গে। কথা বলতে গিয়েই কেঁদে দেন তিনি। কাঁদতে কাঁদতে বলেন, মা–বাবা, স্বামী কোথায়, কেমন আছে জানি না। চার দিন ধরে পেটে ভাতের দানা পড়েনি। বলেন, একুশ দিনুর দুধর মাছুমও দুধ ন পার। অ বাজি আঁরে কনে চাইব, আর পোয়ারে কি খাবাই বাঁচাইয়ুম। হুসনেমার চোখে–মুখে আতংক। ভয় কাটছে না। মিয়ানমারের রাখাইনের ফকিরা বাজার থানার সিতা মংচি বা মিজ্জা আলী পাড়ার কাদির হোছেনের মেয়ে পার্শ্ববর্তী রেইক্কা পাড়ার ইমাম হোছনের ছেলে আব্দুস শুক্কুরের সাথে ১০ মাস আগে বিয়ে হয়। সন্তান প্রসবের সময় হওয়ায় কুতুপালংয়ে আসার এক মাস পূর্বে স্বামীসহ বাপের বাড়ি বেড়াতে আসেন হুসনেমা। ২১ দিন আগে শিশুর জন্ম দেন।

তিনি জানান, ১৪ দিন আগে স্বামী বাড়ি চলে গেছে। এর মধ্যে মিলিটারিরা হেলিকপ্টার থেকে গুলিবর্ষণ করে পাড়ার অনেকের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। স্বামীর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ হয়নি। মা বৃদ্ধ, বাবাও বৃদ্ধ ও পঙ্গু। তারা কেউ আসতে পারেননি। মিলিটারি ও মগদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে বাবা–মা ও ভাই–বোনেরা তাকে প্রতিবেশীদের সাথে পাঠিয়ে দিয়েছে।

হুসনেমা জানান, গত শনিবার বিকেলে রওনা দেন তারা। আমতলী পাহাড়ি সীমান্ত দিয়ে উঁচু পাহাড়, জঙ্গল, ছড়া, খাল–বিল পেরিয়ে ৪ দিনে প্রায় ১৪ কিলোমিটার পথ হেঁটে আমতলী রেজু খালের পাড়ে আসেন। ওখান থেকে ইজি বাইকে করে গতকাল সকালে কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে আসেন।

হুসনেমার মতো পালিয়ে আসা অনেকে জানান, ওখানে বাড়িঘরে আগুন দেওয়া হচ্ছে, যুবকদের ধরে নিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। অনেক নারী–পুরুষের লাশ পড়ে থাকতে দেখেছেন তারা। তাদের দাফন–জানাজাও হচ্ছে না। তাদের কাছে মনে হচ্ছে, তারা এক দোজখ থেকে পালিয়ে এসেছেন।

গতকাল দুপুর ২টার দিকে পাহাড়ি আমতলী সীমান্ত দিয়ে উত্তর মংডুর ফকিরাবাজার থানার লেমচি গ্রাম থেকে আসা লায়লা খাতুনের (২২) সঙ্গেও কথা হয়। আমতলী রেজু খালের মুখ এলাকায় ইজি বাইকে করে কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে যাওয়ার পথে চার দিন বয়সী শিশুর মা লায়লার সঙ্গে ছিলেন স্বামী পেঠান আলী। উভয়ের চোখে–মুখে ক্লান্তি।

সন্তান জন্মের একদিনের মাথায় শনিবার সকালে সেনাবাহিনী ও মগদের নির্যাতনে ঘরবাড়ি ফেলে পালিয়েছেন লায়লা। প্রায় ১৫ কিলোমিটার পাহাড়ি সীমান্ত পেরিয়ে এসেছেন।

তারা একই পাড়ার ১৫ জন একসাথে এসেছেন। সাথে ছিল চিড়া, গুড়। খাল ও ছড়ার পানি খেয়েছেন। লায়লার শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা। লায়লা ও তার স্বামী জানেন না, তাদের সন্তানকে শেষ পর্যন্ত বাঁচাতে পারবেন কিনা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবার রাখাইন থেকে আগতদের প্রায় ৮০ শতাংশ নারী ও শিশু।

ফকিরা বাজার এলাকা থেকে এসে গতকাল কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া ওমর মিয়া (৮০) বলেন, ‘অ পুত এবারর মত মিলিটারি আর মগর নির্যাতন জীবনত ন দেখি। তিনি জানান, পাড়ার চারপাশ ঘিরে ফেলে মগ ও নাসাকা (বিজিপি) বাহিনী। উপর থেকে হেলিকপ্টারে বোমা মেরে ঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে। মগ–নাসাকা আসার আগেই পাড়ার লোকজন পাহাড়ে লুকিয়ে ছিলেন। ওরা চলে যাওয়ার পর ঘরে ফিরে হাতের কাছে যা পেয়েছেন তাই নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন।

এদিকে আমতলী ও রহমতের বিল সীমান্ত দিয়ে আসার পথে বাংলাদেশি এক শ্রেণীর লোকের হাতে নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন রোহিঙ্গারা। বিশেষ করে আমতলী পাহাড়ি সীমান্ত দিয়ে আসার পথে বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকা, উখিয়ার ডেইলপাড়া, কড়ই বনিয়া, গয়ালমারা, হাতিমোরা, তুলাতুলি, দরগাহবিল এলাকার বিভিন্ন পয়েন্টে ৪/৫জন করে যুবক সংঘবদ্ধ হয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ভয়–ভীতি, পুলিশ ও বিজিবির হুমকি দিয়ে ছিনতাই করছে।

ভুক্তভোগী কয়েকজন রোহিঙ্গা জানান, তারা এদেশে নতুন এসেছেন। কোনো কিছু জানেন না, চিনেন না। পথে বিভিন্ন পরিচয়ে হুমকি ধমকি দিয়ে যা পারছে ছিনিয়ে নিচ্ছে। গত সোমবার রাত ৩টার দিকে পাহাড়ি সীমান্তের বটতলী ঝিরি থেকে অনুপ্রবেশকারী ১ রোহিঙ্গা কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগে উখিয়া তুলাতুলী গ্রামের আবুল কালামের ছেলে বেলাল হোসেনকে (২১) আটক করেছে আতমলী বিজিবি। তাকে গতকাল নাইক্ষ্যংছড়ি থানায় সোপর্দ করা হয়েছে।

কুতুপালং ও বালুখালী রোহিঙ্গা শিবিরে প্রবেশ করা অনেক রোহিঙ্গা দুর্দশার মাঝে দিন কাটাচ্ছেন। সেখানে দেখা দিয়েছে খাদ্য, ওষুধ, চিকিৎসা ও আবাসন সংকট। ৩/৪ দিন পায়ে হেঁটে, পাহাড়, জঙ্গল পেরিয়ে নদী, খাল, সাঁতরিয়ে আসা প্রায় অভুক্ত নারী ও শিশুদের অবস্থা কাহিল। এছাড়া উখিয়ার সীমান্ত এলাকা নাফ নদীর তীর রহমতের বিল, আঞ্জুমানপাড়া, ধামনখালী, ঘুমধুমের জলপাইতলী, তুমব্রু পশ্চিম কুলের নোম্যান্সল্যান্ডে আশ্রয় নেওয়া ৭/৮ হাজার নারী ও শিশু দুর্দশায় দিন কাটাচ্ছে। বিজিবি তাদের আটকে রেখেছে। ওরা খাদ্য, পানীয় জলের সমস্যায় ভুগছে। তাছাড়া আছে ল্যাট্রিনের সমস্যা। এদের অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ছে।

ওরা মেরে ফেলবে : টেকনাফ প্রতিনিধি জানান, টেকনাফের দমদমিয়া এলাকায় অবস্থান নেওয়া মিয়ানমারের জামবনিয়া এলাকার আব্দুর রহমান জানান, জীবন বাঁচাতে স্ত্রী, দুই সন্তান নিয়ে তিনি বাংলাদেশ চলে এসেছেন। কিন্তু এখানে বিজিবির হাতে আটক হয়ে এখন দমদমিয়া সীমান্তে অবস্থান করছেন। তাকেসহ ৩২জন নারী–পুরুষ ও শিশুকে সন্ধ্যার মধ্যে মিয়ানমারে ফেরত যেতে হবে। তিনি উৎকণ্ঠায় আছেন, মিয়ানমারে গেলে সেনাবাহিনী বা সে দেশের পুলিশ তাদের হত্যা করবে। নির্যাতন করবে স্ত্রীকে। তিনি বলেন, রাতের অন্ধকারে বিকট শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। কে বা কারা এসব শব্দ করে তা জানা না থাকলেও সকালে এসে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ঘর থেকে যুবকদের ধরে নিয়ে হত্যা করছে। বাড়িঘরে আগুন দিচ্ছে।

একই নৌকায় এসেছেন রমিদা বেগম। সঙ্গে আছেন স্বামী ও এক সন্তান। রমিদা বলেন, এখানে এসে শান্তি লাগছে। এখান থেকে মিয়ানমারে ফিরে গেলে হত্যা করবে মিয়ানমার বাহিনী। তার চেয়ে বাংলাদেশে মেরে ফেললে অন্তত দাফন–কাফন হবে। মুসলিম হিসেবে জানাজা পড়াবে। ওখানে ঘরে তালা দিয়ে আগুন ধরিয়ে হত্যা করছে। লাশ পর্যন্ত পাওয়া যায় না। নারীদের নির্যাতন করছে, ধর্ষণ করে হত্যা করছে।

৪৫ বছরের খতিজা বেগম বলেন, তার ৩ ভাই আগুনে পুড়ে মারা গেছে। বাবা–মা কোথায় আছেন কে জানে। দুদিন খাল–বিল, পাহাড়, নদী পাড়ি দিয়ে এখানে এসেছেন। ভাত দেখেননি পাঁচ দিন। শুক্রবার ভোর থেকে রাতে হেঁটেছেন, দিনে কোনো বাড়ি, ধানক্ষেত বা পাহাড়ে সময় কাটিয়ে মঙ্গলবার ভোরে দমদমিয়া সীমান্তের নাফ নদী পার হয়ে বিজিবির হাতে ধরা পড়েন। নৌকায় নাফ নদী পেরিয়ে আসার সময় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী গুলি ছোঁড়ে। আলহ্মাহ বাঁচিয়েছেন। অপর একটি নৌকায় গুলি লেগেছে। ওই নৌকায় বেশিরভাগই ছিল শিশু ও নারী। এদের ভাগ্যে কী ঘটেছে তা তিনি জানেন না। তবে তার ধারণা, অনেকে মারা যেতে পারেন।

ছেলেকে পানিতে ডুবিয়ে রেখে রক্ষা : মফিজের বয়স আড়াই বছর। গুলিবিদ্ধ হওয়ার শংকায় তাকে কয়েক মিনিট পানিতে ডুবিয়ে রেখেছিলেন তার পিতা ফজল হক। এতে রক্ষা পায় ছেলে।

তার মতো মিয়ানমারের রোহিঙ্গা পরিবারের বেশিরভাগ শিশুই এভাবে ঝুঁকি নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করছে। স্ত্রী জাহেদা বেগম গর্ভবতী। মংডু বুড়া সিকদার পাড়ায় তাদের ছিল সুখী সংসার। বাজারে মুদির দোকান ছিল। রাখাইনরা গত শুক্রবার দোকানে আগুন ধরিয়ে দেয়।

অক্টোবরে অনেক ঝড়–ঝাপটা গেছে, তবুও মাতৃভূমি ছাড়েননি। এবার কিন্তু ছাড়তে হয়েছে। গতকাল সকাল সাড়ে ৬টার দিকে বাংলাদেশে পৌঁছেছেন। এর আগে রাত ৩টার সময় নাফ নদীতে হ্নীলা রঙ্গিখালী পয়েন্টের বিপরীতে একটি দ্বীপে পৌঁছেন। পরে নাফ নদী পেরিয়ে সোজা লেদা অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নেন। ক্যাম্পেই কথা হয় তাদের সঙ্গে।

ফজল হক জানান, না এলে মিলিটারির গুলিতে মরতে হত। সোমবার রাতে সীমান্তের কাছাকাছি এলে হঠাৎ কেঁদে ওঠে ছেলে। পাশে ছিল মিয়ানমার বর্ডার গার্ড পুলিশের ক্যাম্প। শুরু হয় গুলি বর্ষণ। স্ত্রী পানিতে পড়ে রক্ষা যায়। এ অবস্থায় আড়াই বছরের সন্তানকে কয়েক মিনিট পানিতে ডুবিয়ে রেখে শান্ত করেন। এ সময় বেশ কিছু পানি পান করে শিশু পুত্র মফিজ। বাংলাদেশে আসবেন, তাই পথে যাতে কান্নাকাটি না করে সেজন্য ছেলেকে দুটি ঘুমের ট্যাবলেট খাওয়ান।

ফজল হকের স্ত্রী জাহেদা বেগম (২৪) বলেন, এখানে এসে ভালো লাগছে। লেদা আইওএম হাসপাতালে ডাক্তার আমাকে দেখে ঔষধপত্র দিয়েছেন। রাতে পানিতে ভিজা ও নদীর পানি পান করার কারণে ছেলে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তারপরও মিয়ানমারের রাখাইন জালেমদের হাতে না মরে এখানে মরলে শান্তি আছে। অন্তত মুসলিম হিসেবে মরতে পারব। তিনি জানান, ওখানে অনেক মুসলিম নারী–পুরুষের লাশ পড়ে আছে। দাফন জানাজা কিছুই হচ্ছে না। সে এক দোজখ।

-আজাদী প্রতিবেদন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!