Home | দেশ-বিদেশের সংবাদ | চট্টগ্রামে ৫০ বছরে ৪৯ খাল গায়েব

চট্টগ্রামে ৫০ বছরে ৪৯ খাল গায়েব

নিউজ ডেক্স : অর্ধ শতাব্দীতে চট্টগ্রামে ৪৯টি খাল গায়েব করে দেয়া হয়েছে। মাত্র বছর কয়েকের মধ্যে ভরাট করে বাড়ি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে চট্টগ্রাম মহানগরীর ১২টি খালে। বর্তমানে যে ক’টি খালের অস্তিত্ব আছে সেগুলোরও বড় অংশ দখল হয়ে গেছে। ভরাট হয়ে গেছে খালের দুই পাড়। ময়লা আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হওয়া খালগুলোতে স্বাভাবিক প্রবাহ বলতে কিছু নেই। আর এ খালগুলো অচল হয়ে যাওয়ায় চট্টগ্রাম মহানগরী প্রতি বছরই জলাবদ্ধতার কবলে পড়ছে। ঘণ্টা কয়েকের বৃষ্টিতে ডুবে যাচ্ছে পুরো নগর। নগর বিশেষজ্ঞ মহলের অভিমত খালগুলো উদ্ধারে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হলে চট্টগ্রাম মহানগরীতে আর জলাবদ্ধতা দেখা যাবে না।

তারা বলছেন, দুইটি নদী এবং সাগর পাড়ে গড়ে উঠা এই জনপদে জলাবদ্ধতা পুরোপুরি ‘অস্বাভাবিক’। বঙ্গোপসাগর, কর্ণফুলী নদী এবং হালদা নদী ঘিরে রেখেছে চট্টগ্রাম মহানগরীকে। বৃষ্টির পানি অতি সহজেই কর্ণফুলী ও হালদা হয়ে বঙ্গোপসাগরে চলে যাওয়ার কথা।

তথ্য মতে, চট্টগ্রামে মূল এবং শাখা-প্রশাখা মিলে সর্বমোট ১১৮টি খাল থাকার রেকর্ড রয়েছে। এসব খালের মোট দৈর্ঘ্য ছিল ১৮২.২৫ কিলোমিটার। ক্রমান্বয়ে খাল দখল এবং ভরাট হয়ে বিলুপ্ত হতে থাকে। ১৯৬৮-৬৯ সালে কুমিরা রেল স্টেশন থেকে কালুর ঘাট সেতু পর্যন্ত ৭১টি খালের দৈর্ঘ্য প্রস্থ ও গভীরতার তথ্য উল্লেখ রয়েছে। ২০১৬ সালে এসে পানি উন্নয়ন বোর্ড চট্টগ্রামে মোট ৪০টি মূল খাল এবং শাখা খালের হদিস পেয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নেওয়া মহানগরীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ-জলাবদ্ধতা নিরসন ও নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়নে দেড় হাজার কোটি টাকার প্রকল্পে কর্ণফুলী নদীতে পড়া ২৩টি, হালদায় তিনটি এবং বঙ্গোপসাগরে পড়া ১৪টি খালের কথা উল্লেখ রয়েছে। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং চট্টগ্রাম ওয়াসা নগরীতে ৩৬টি খাল থাকার কথা উল্লেখ করেছে। ৫০ বছরের ব্যবধানে চট্টগ্রামে ৩৫টি খালের অস্তিত্বই বিলীন করে দেয়া হয়েছে।

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম মহানগরীর প্রথম ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যান তৈরি করার সময় আমেরিকান প্রতিষ্ঠান জনস স্নেলস অ্যান্ড কোম্পানি পতেঙ্গার নেভাল একাডেমি থেকে কালুরঘাট সেতু পর্যন্ত ৩৪টি খালের অস্তিত্ব চিহ্নিত করে এবং ম্যাপ তৈরি করে। ২০১৭ সালে চট্টগ্রাম ওয়াসা নতুন করে ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যান তৈরির লক্ষ্যে নেদারল্যান্ডসের একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান জরিপ করে মাত্র ২২ খালের অস্তিত্ব নির্ণয় করে। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কাগজেপত্রে নগরীতে ৩৬টি খাল থাকার কথা বললেও ২০১৯ সালের জরিপে খালের সংখ্যা দাঁড়ায় ২২টি। আর এই ২২টি খালের একটি বড় অংশই সরকারি বেসরকারি স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে বছরের পর বছর দখল হয়েছে। খালের জায়গায় বহুতল ভবন হয়েছে। স্কুল-কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়ও হয়েছে। এছাড়া অবাধে ময়লা-আবর্জনার ফেলার কারণে ভরাটও হয়েছে খালগুলো। এতে করে খালের স্বাভাবিক গতিপথও ব্যাহত হয়েছে। ব্যাহত হয়েছে স্বাভাবিক প্রবাহ। প্রতিটি খালই মরতে বসেছে। স্বাভাবিক প্রবাহ না থাকায় খালগুলো দিয়ে বৃষ্টির পানি সরছে না।

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চিফ ইঞ্জিনিয়ার কাজী হাসান বিন শামস বলেন, কোথাও কোনো খালই অক্ষত নেই। নগরীর শত শত টন বর্জ্য নানাভাবে প্রতিদিনই খালে পড়ছে। খাল খনন করার একটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, একদিকে খাল খনন করলে অন্যদিকে ময়লার ভাগাড় তৈরি হচ্ছে। এভাবে চললে খননের সুফল পাওয়া যাবে না বলে জানান তিনি।

প্রখ্যাত কর্ণফুলী বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মোহাম্মদ ইদ্রিস আলী সমন্বয়হীনতার অভাবকেই জলাবদ্ধতার জন্য দায়ী করে বলেছেন, কারো সাথে কারো কোনো সমন্বয় নেই। কোনো প্রকল্পেও সমন্বয় নেই। যে যেভাবে পারছে প্রকল্প গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করছে। এতে করে একটি খালও ঠিকঠাকভাবে কাজ করছে না। নদী ভরাট হয়েছে। খাল ভরাট হয়েছে। এই অবস্থায় সমন্বিত একটি উদ্যোগ ছাড়া নগরীকে জলাবদ্ধতার কবল থেকে রক্ষা করা অসম্ভব বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

অধ্যাপক ইদ্রিস আলী বলেন, নগরজুড়ে ব্যাপকহারে পাহাড় কাটা হয়েছে। পাহাড় কাটার মাটি খাল ভরাট করছে। পাহাড় কাটা প্রতিরোধে বিভিন্ন সময় নানা কথাবার্তা হলেও কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না।

চট্টগ্রাম মহানগরীকে জলাবদ্ধতার কবল থেকে রক্ষা করতে ক্রাশ প্রোগ্রাম নেয়ার উপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, বৃষ্টির পানি আশি শতাংশই মাটি শুষে নেওয়ার কথা, দশ শতাংশ বাষ্প এবং দশ শতাংশ নদী বা সাগরে যাওয়ার কথা। কিন্তু চট্টগ্রামে হচ্ছে তার উল্টো। সব পাকা করে ফেলা হয়েছে। কোথাও মাটি নেই। ঘরের আঙ্গিনা থেকে শুরু করে সব। এতে করে মাটির সাথে পানির কোনো সম্পর্ক নেই। সব পানি উপচে উঠছে। অথচ আশি শতাংশ পানি যদি মাটি শুষে নিতে পারতো তাহলে এমন বিপর্যয় হতো না।

প্রসঙ্গক্রমে তিনি অবস্থানগত কারণে চট্টগ্রাম মহানগরীতে জলাবদ্ধতাকে ‘অস্বাভাবিক’ বলে মন্তব্য করে বলেন, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এবং সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া হলে চট্টগ্রামে বৃষ্টির পানি নদী এবং সাগরে চলে যাবে। শহরে কোনো পানি আটকাবে না। তবে এজন্য খালগুলো উদ্ধার এবং সচল করতে হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেছেন। দৈনিক আজাদী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!