Home | দেশ-বিদেশের সংবাদ | ঋণগ্রহীতা থেকে দাতা বাংলাদেশ

ঋণগ্রহীতা থেকে দাতা বাংলাদেশ

নিউজ ডেক্স : একটি বিস্ময়ের প্রকাশ। একটি ইতিহাস। ৫০ বছরের বাংলাদেশ আজ পরিপূর্ণ সত্তার এক ভূখণ্ড। যেখানে দাঁড়িয়ে মানুষ স্বপ্ন বুনছে রোজ। বুনছে এগিয়ে যাওয়ার গল্প।

এখানে বিভাজন আছে। ধর্ম-জাতিসত্তার প্রশ্নে হিংসাও আছে। দেশ-বিদেশের নানা ষড়যন্ত্রও বাঙালির চলার পথকে পিচ্ছিল করে তুলেছে বহুবার। তবু থেমে থাকেনি এখানকার স্বপ্নবাজ মানুষের অগ্রযাত্রা। রক্ত দিয়ে কেনা বাংলাদেশকে ঘামে-শ্রমে তিল তিল করে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে মেহনতী মানুষ।

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব, অর্থনীতিবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক ড. আকবর আলি খান বলছিলেন, ‘বাঙালি জাতির প্রধানতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বারবার হেরেও ঘুরে দাঁড়ানো। এখানে রাজনীতিতে যত প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে, তা অন্য কোনো দেশ বা অঞ্চলে হয়নি। এরপরও আমাদের অর্জন কম নয়।’

স্বাধীনতাযুদ্ধে জয়লাভের পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার। সেই বাংলাদেশকে ২০২১ সালে জাতিসংঘের তরফ থেকে ‘উন্নয়নশীল দেশ’ স্বীকৃতির চূড়ান্ত সুপারিশ করা হয়েছে।

উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার সব শর্ত পূরণ করেছে বাংলাদেশ; বিজয়ের ৫০ বছরে এর চেয়ে বড় অর্জন আর কী হতে পারে! আগে যেখানে দুর্যোগে-দুর্বিপাকে বাংলাদেশকে অন্য দেশের প্রতি সাহায্য-ঋণের জন্য হাত পাততে হতো, এখন সেই বাংলাদেশ অন্য দেশকেও সহায়তা করতে পারে, ঋণ দিতে পারে শ্রীলঙ্কা-মালদ্বীপের মতো প্রতিবেশী দেশকে।

বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে যে দেশের জন্ম, সে দেশকে দুর্বার গতিতে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধুরই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অর্থনীতি-উন্নয়ন প্রশ্নে বাংলাদেশ এখন নিজস্ব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে পারে। বিশ্বব্যাংককে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পদ্মাসেতু নির্মাণ করে অন্তত সেটাই প্রমাণ করেছে বাংলাদেশ।

সরকারি তথ্য মতে, ১৯৭৩-১৯৭৪ অর্থবছরে এ দেশের রপ্তানি আয় ছিল ২৯৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর ২০২০-২১ অর্থবছরে রপ্তানি আয় এসেছে প্রায় ৩৯ বিলিয়ন ডলার। ১৯৭৩-১৯৭৪ সালে মাথাপিছু আয় ছিল ১২৯ ডলার। এখন মাথাপিছু আয় দুই হাজার ৫৫৪ ডলার। করোনা মহামারি সত্ত্বেও বিদায়ী অর্থবছরে (২০২০-২১) বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ। ১৯৭৩-১৯৭৪ অর্থবছরে দারিদ্র্যের হার ছিল ৭০ শতাংশ। দারিদ্র্যের সেই হার কমে এখন দাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক ৫ শতাংশে। শুধু তাই নয়, হেনরি কিসিঞ্জারের সেই ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ তত্ত্বকে ধুলোয় মিশিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চমক দেখাচ্ছে বাংলাদেশ। গত আগস্টের হিসাব অনুসারে, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৮ দশমিক ০৪ বিলিয়ন ডলার।

জাতিসংঘের দেওয়া শর্ত মেনে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকাভুক্ত হয় ১৯৭৫ সালে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ তিনটি শর্তই পূরণ করে। সেই শর্ত পূরণের স্বীকৃতি জাতিসংঘের তরফ থেকে মিলেছে এ বছর। জাতিসংঘের শর্ত পূরণে ন্যূনতম মাথাপিছু আয় এক হাজার ২৩০ ডলার দরকার হয়। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এখন দুই হাজার ৫৫৪ ডলার। অর্থনৈতিক ঝুঁকি নির্ধারণ করা আছে, ১০০ এর মধ্যে ৩২ এর নিচে স্কোর হতে হবে। বাংলাদেশের স্কোর ২৫.২। আর মানবসম্পদ উন্নয়ন যোগ্যতায় বাংলাদেশের স্কোর ৭৩.২ এর কোটায়। যেখানে নির্ধারণ করা আছে ৬৬।

ঋণগ্রহীতা থেকে দাতা বাংলাদেশবাঁ থেকে ড. আকবর আলি খান, ড. এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম ও ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ

ড. আকবর আলি খান বলেন, ‘বাংলাদেশের আজকের যে অর্জন, তা মূলত তিন শ্রেণীর মানুষের কল্যাণে। প্রথমত, এ দেশের কৃষক-উদ্যমী মানুষের শ্রম। দ্বিতীয়ত, অশিক্ষিত, স্বল্প-শিক্ষিত পোশাক শ্রমিকের আয়। তৃতীয়ত, কোটির অধিক প্রবাসী শ্রমিকের পাঠানো রেমিট্যান্স। এই মানুষগুলোই বাংলাদেশের অর্থনীতির রূপকার।’

বর্ষীয়ান এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘রাজনীতি এবং রাজনীতি প্রভাবিত অর্থনীতি এদেশের সাধারণ মানুষের এগিয়ে চলার পথে অন্তরায়। রাজনীতির হিংসা বাংলাদেশকে সঠিক জায়গায় যেতে বারবার বাধা দিয়েছে। তবু আমাদের অর্জন ঈর্ষণীয়।’

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘অর্থনীতিতে বাংলাদেশের গুণগত উন্নয়ন ঘটেছে, এটি সহজেই দৃশ্যমান। বিভিন্ন সূচক তার প্রমাণ। আমরা এই সময়ে একটি ল্যান্ডমার্ক অতিক্রম করেছি। উন্নয়নশী দেশের তালিকায় বাংলাদেশ, এটি অবশ্যই আনন্দের কথা। কিন্তু চ্যালেঞ্জগুলোও আমলে নিতে হবে। সংকটগুলোও দেখতে হবে। আমাদের কোথায় যাবার কথা ছিল, আর কোথায় যেতে পারলাম, তার হিসাবটাও গুরুত্ব দিতে হবে। বেসরকারি বিনিয়োগে স্থবিরতা, রপ্তানি তুলনামূলক না বাড়া, রেমিট্যান্স কমে যাওয়া, মানবসম্পদ না বাড়া, শিক্ষার মানোন্নয়ন না হওয়া, শিক্ষিত বেকার বেড়ে যাওয়া, দারিদ্র্য, আয় বৈষম্যের মতো বিষয়গুলো আমাদের নিয়মিত চ্যালেঞ্জ। এর সঙ্গে শুল্কমুক্ত সুবিধা না পাওয়া এবং ব্যাংক সুদের হার বৃদ্ধি পাওয়ার মতো চ্যালেঞ্জগুলো নতুন করে যোগ হচ্ছে।’

অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘৫০ বছরে বাংলাদেশ অবশ্যই অগ্রযাত্রার কথা বলে, উন্নয়নের কথা বলে। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের যোগ্যতা অর্জন করেছে বলে জাতিসংঘ যে ঘোষণা দিয়েছে, তা অবশ্যই এ দেশের মানুষের শ্রমের স্বীকৃতি বলে মনে করি। তবে বাংলাদেশের এই অর্জন বিশেষ কোনো সরকারের নয়। সরকারগুলোর নীতি এবং মানুষের চেষ্টার ফলেই আজকের বাংলাদেশ। ১৯৯০ সাল থেকে একটা ফ্লো তৈরি হয়েছে। নানা সরকারের সময়ে একটু একটু করে এগিয়ে এটাকে গতিশীল করেছে। এই গতি হয়ত কখনো কমেছে, কখনো বেড়েছে। তবে সাধারণ মানুষের এগিয়ে যাওয়ার ধারাবাহিকতা ছিল।’

এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘আমাদের অর্জন নিয়ে বসে থাকলেই চলবে না। বরং নানা কারণে চ্যালেঞ্জ সামনে এসেছে এখন। দক্ষতার সঙ্গে এগুলো মোকাবিলা করতে না পারলে অর্জনগুলো ম্লান হয়ে যেতে পারে। সংকটগুলো কোথায়, তা বের করতে হবে। সুশাসন-গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা না থাকলে অর্থনীতি ভেঙে পড়ার ঝুঁকি থেকেই যায়। আমরা এই প্রশ্নে এখন কোথায় আছি, তার সমাধান টানতে হবে।’ -জাগো নিউজ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!