ব্রেকিং নিউজ
Home | দেশ-বিদেশের সংবাদ | চট্টগ্রামসহ সারা দেশে বেড়েছে অনলাইন প্রতারণা

চট্টগ্রামসহ সারা দেশে বেড়েছে অনলাইন প্রতারণা

identity-theft-13

নিউজ ডেক্স : নামে-বেনামে বিভিন্ন ফেইসবুক পেইজ বা ভুঁইফোড় ওয়েবসাইট থেকে পণ্য ডেলিভারির নামে সংঘবদ্ধ চক্রের প্রতারণা বর্তমানে বহুগুণে বেড়েছে। বিভিন্ন সময় এসব প্রতারণা হয়ে এলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে চট্টগ্রামসহ সারা দেশে সক্রিয় দেশি-বিদেশি এজেন্টদের চক্রটি। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব এজেন্ট একে অপরকে ভালোভাবে চেনে না। অনলাইনে আইডির মাধ্যমে তাদের যোগাযোগ হয়। সংঘবদ্ধ এজেন্টগুলো প্রতিটি কাজের জন্য ১০ ভাগ করে কমিশন পেয়ে থাকে। বিটিআরসির তথ্যে জানা গেছে, চট্টগ্রামসহ সারাদেশে ৯ কোটি ১৪ লাখ ২১ হাজার ইন্টারনেট গ্রাহক রয়েছে। এরমধ্যে ৮ কোটি ৫৬ লাখ ৩০ হাজার গ্রাহক মোবাইলের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। ই-কমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের তথ্যে জানা গেছে, ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের একটি বিরাট অংশ এখন অনলাইনে পণ্য বেচা-কেনা করছে। দিনদিন ই-কমার্সের বাজারও বিস্তৃতি পাচ্ছে। দেশে বর্তমানে ই-কমার্স বাজারের আকার বছরে ৭০০ কোটি টাকার মতো। প্রতিদিন গড়ে ৩০ হাজার ক্রেতা অনলাইনে পণ্যের অর্ডার দেন। বৃহৎ এই বাজারটি নিয়ন্ত্রণ করতে সরকার গতবছর ‘জাতীয় ডিজিটাল কমার্স নীতিমালা-২০১৮’ অনুমোদন করে।

এদিকে ই-কমার্সের বাজার প্রসারের সাথে সাথে অনেকেই প্রতারণারও শিকার হচ্ছেন। অভিযোগ আছে, গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত প্রতারক চক্রটির ফাঁদে পড়ে অনেকেই টাকা খুঁইয়েছেন। সম্প্রতি এর হার বেড়েছে। নগর গোয়েন্দা পুলিশ সম্প্রতি দেশি-বিদেশি একটি প্রতারক চক্রের ১০০ জন এজেন্টের তথ্য পেয়েছে। চক্রটির মূল হোতা হিসেবে নাইজেরিয়ার ক’জন বিদেশি নাগরিকের সম্পৃক্ততা পেয়েছে তারা। কিন্তু চক্রের হোতা তো দূরে থাক, চক্রটির এজেন্টদের ধারে কাছেও যেতে পারছে না তারা।

নগর গোয়েন্দা পুলিশের একটি তথ্য বলেছে, গত বছর বিভিন্ন সময় ফেইসবুকে যোগাযোগের মাধ্যমে পণ্য ডেলিভারি নেওয়ার সময় প্রতারণার শিকার হন চট্টগ্রামে ডাক্তার, চাকরীজীবি, ব্যবসায়ীসহ অন্তত দশজন ভুক্তভোগী। সংঘবদ্ধ একটি বড় চক্র তাদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এদের মধ্যে একজন খ্রিস্টান নাগরিকের ৫১ লাখ টাকা ও একজন ডাক্তারের ২৮ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে যায় ওই চক্রটি। প্রায় সমপরিমাণের টাকা অন্যদেরও খোঁয়া যায়। এসব ঘটনা নিয়ে তদন্তে নামেন নগর গোয়েন্দা পুলিশ।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার আসিফ মহিউদ্দিন  বলেন, এসব ঘটনার তদন্তের পর আমরা দেশি-বিদেশি সংঘবদ্ধ একটি চক্রের খোঁজ পেয়েছি। চক্রটিতে কাজ করছে এমন বহু এজেন্টের তথ্য আমরা পেয়েছি। মূল হোতা হিসেবে নাইজেরিয়াসহ বিভিন্ন বিদেশি নাগরিক এ চক্রটিতে রয়েছে। এদের মধ্যে পাঁচজনকে সম্প্রতি ঢাকা ও রাজশাহীতে অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। মূল হোতা বিদেশি নাগরিক হওয়ায় তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে।

ওইসময় গ্রেপ্তারকৃতদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা এজেন্টদের ভালো করে তারা চেনেন না বলে আমাদের জানায়। বিভিন্ন আইডির মাধ্যমে তাদের যোগাযোগ হয়ে থাকে। এরা শুধু কমিশন হিসেবে প্রতি হাজারে ১০০ টাকা পেয়ে থাকে। এতে করে বাকি সদস্যদের ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি। এ ঘটনাটি নিয়ে বর্তমানে ঢাকার সিআইডি তদন্ত করছে বলে জানান এ গোয়েন্দা কর্মকর্তা।

আসিফ মহিউদ্দিন বলেন, চক্রটি প্রথমে ফেক আইডি বানিয়ে নিজেদের বাইরের বিভিন্ন দূতাবাসের কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে দেশে বিভিন্ন জনের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলে। পরে সুসম্পর্ক তৈরি হলে উপহার বা নানা অজুহাতে একটি পর্যায়ে বিদেশ থেকে পণ্য পাঠানোর নামে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তারা। তিনি বলেন, ফেইসবুকে যোগাযোগের মাধ্যমে বিদেশ থেকে বিভিন্ন দামি পণ্য পাঠাচ্ছে বলে ভিকটিমকে প্রথমে জানিয়ে দেওয়া হয়। পরে একই চক্রের অন্য সদস্যরা নিজেদের কাস্টমস কমকর্তা পরিচয় দিয়ে ভিকটিমকে ফোন করে বলে, আপনার নামে বন্দরে বিদেশ থেকে মালামাল পৌঁছেছে। এ সময় ভিকটিমকে বলা হয়, বাইরে থেকে আসা মালামালের দাম অর্ধ লাখ টাকা বা কোটি টাকা। এ সময় আমদানিকৃত মালামালগুলোর ব্যাপারে একটি অজুহাত তৈরি করে তা ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য একটি বড় অংকের টাকা দাবি করে থাকে ওই ভূয়া কাস্টমস কর্মকর্তা। এভাবে বিভিন্ন সময় অনেকেই তাদের ফাঁদে পড়ে লাখ লাখ টাকা হারিয়েছেন বলে জানান তিনি।

গত বছর ওই ঘটনার পর অনলাইনে পণ্য ডেলিভারি দেওয়ার নামে প্রতারণার শিকার আরও ৩-৪টি অভিযোগ গোয়েন্দা পুলিশের হাতে এসেছে বলে জানান অতিরিক্ত উপ পুলিশ কমিশনার আসিফ মহিউদ্দিন। এগুলো নিয়ে কাজ করা হচ্ছে বলে জানান তিনি। একই বছর অনলাইনে আরও একটি প্রতারক চক্রের সন্ধান পেয়েছে ডিবি পুলিশ। চক্রটি অনলাইনে নামীদামি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ইলেকট্রনিঙ পণ্যের ছবি সংগ্রহ করেন। এরপর জনপ্রিয় অনলাইন শপিং সাইটে ওইসব পণ্যের চটকদার বিজ্ঞাপন দেন। এসব পণ্য কিনতে গিয়ে অনেকেই যোগাযোগ করেন। এ সময় চক্রটি নিজেদের আমদানিকারক হিসেবে পরিচয় দেয়। পরে ক্রেতারা ওই পণ্য কিনতে আগ্রহ দেখালে তারা ক্রেতার কাছে ওইসব পণ্য বাবদ উচ্চ মূল্য ধার্য করেন। এক পর্যায়ে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে তাদের কাছে পাঠিয়ে থাকে নষ্ট কিংবা নিম্নমানের পণ্য। গত বছর অক্টোবরে ডবলমুরিং থানার পাঠানটুলি এলাকা থেকে চক্রটির দুই হোতা গ্রেপ্তার হন। এরা হলেন- সুমন খন্দকার রিফাত (২২) ও সাজ্জাদ নেওয়াজ খান (৩২)।

নগর গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, বিক্রয় ডটকম’র মতো অনলাইন শপিং সাইটে ‘অনলাইন শপ’ ও ‘২৪ ডটকম’ নামে দুইটি আইডি তাদের আছে। এসব আইডিতে অরজিনাল ব্র্যান্ডের পণ্যের ছবি দিয়ে বিজ্ঞাপন দেয় তারা। ক্রেতাদের কাছ থেকে বিকাশে টাকা হাতিয়ে নিয়ে নিম্নমানের ও নষ্ট পণ্য কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেয়। তিনি আরও জানান, তাদের কাছ থেকে পণ্য কিনে ঠকেছেন এমন সাত ব্যক্তির খোঁজ পাওয়া গেছে।

চলতি বছর ফেব্রুয়ারিতে আরেক ঘটনা ঘটেছে এক স্কুল ছাত্রের সাথে। ৩ বছর ধরে জমানো টাকা দিয়ে ‘সিটিজি সেলবাজার’ নামক একটি ফেসবুক পেইজ থেকে দরদাম করে ১২ হাজার টাকায় একটি স্মার্টফোন কেনেন স্কুল ছাত্র আরাফাত। পরে সে জানতে পারে তার কেনা মোবাইল ফোনটি চোরাই। মোবাইলটি ঢাকার শাহবাগ চত্বর থেকেই চুরি হয়েছিল। এটা এক সেনা কর্মকর্তার। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি আচমকা মতিঝিল থানার এসআই ফিরোজ আলীর ফোন আসে তার কাছে। পরে চোরাই মোবাইলটি হালিশহর বড়পোল এলাকাস্থ সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ঢাকায় পুলিশের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এ অবস্থায় যার কাছ থেকে মোবাইলটি কিনে নেয়া হয় তার নম্বর ও ফেসবুক পেইজটিও উধাও হয়ে যায়।

একই মাসে নগরীর বোয়ালখালীর বাসিন্দা সামজাদ নামে আরও এক ব্যক্তি প্রতারক চক্রের ফাঁদে পড়েন। কিন্তু ওইসময় সে তাৎক্ষনিক আইনি সহায়তা নেওয়ায় ওই প্রতারক চক্র থেকে তার টাকাটি উদ্ধার হয়। তবে এ চক্রের কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।

নগরীর কোতোয়ালী থানায় দায়ের করা এ অভিযোগের ব্যাপারে জানা গেছে, প্রথমে তিনি অপ্পো ব্রান্ডের একটি মোবাইল সেট বিক্রয়ের একটি বিজ্ঞাপন ফেইসবুকে দেখতে পান। এ সময় তিনি তখন দুইটি মোবাইল সেট অর্ডার দেন ‘নিউজ টেল’ নামে একটি ভুঁইফোড় প্রতিষ্ঠানের কাছে।

এ সময় সে তাদের প্রথমে শর্ত হিসেবে একটি মোবাইল নাম্বারে সে ৩০০ টাকা বিকাশ করেন। পরে খাতুনগঞ্জ শাখার একটি কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তার কাছে ফোন আসে সেট দুটির জন্য। এক পর্যায়ে ৮ হাজার টাকা পেমেন্ট করে তিনি টেপ মোড়ানো একটি বাঙ পেয়েছেন। পরে সে প্যাকেট খুলে অপ্পো ব্রান্ডের মোবাইলের বদলে দুইটি চায়না সেট দেখতে পান। এক পর্যায়ে সে ওই প্রতিষ্ঠানের নাম্বারে ফোন করলে সেখান থেকে উল্টো গালিগালাজ করা হয়।

এ ঘটনায় কোতোয়ালী থানার উপ-পরিদর্শক সজল কান্তি দাশ বলেন, ফেইসবুকে পণ্য কিনতে গিয়ে প্রতারণা শিকার হওয়া ওই ভুক্তভোগীর অভিযোগ পাবার পর পুলিশ দ্রুত এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিয়ে তার টাকাটি উদ্ধার করে দেন। পুলিশ খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, নিউজটেল নামে একটি ভুঁইফোড় প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্যটি ডেলিভারি দেওয়া হয়েছে।

গত ১৩ ফেব্রুয়ারি একই থানায় আরেক ভুক্তভোগী অভিযোগ দেন। পরিতোষ দত্ত নামে আন্দরকিল্লার এক বাসিন্দা অনলাইনে একটি মোবাইল সেট অর্ডার দিয়ে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পণ্য ডেলিভারি নেওয়ার সময় একটি অকেজো সেট প্যাকেট খুলে পান।

ক্যাবের কেন্দ্রীয় ভাইস প্রেসিডেন্ট নাজের হোসাইন বলেন, তথ্য প্রযুক্তির কল্যাণে আজকে সবকিছুই আমাদের হাতের নাগালে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারেও আমরা এগিয়ে। কিন্তু এখানে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স নিশ্চিত করার জন্য আরো তদারকি দরকার। এটার ঘাটতি থাকার কারণে সুযোগটিকে কাজে লাগাচ্ছে প্রতারক চক্রগুলো।

গোয়েন্দা কর্মকর্তা আসিফ মহিউদ্দিন বলেন, বর্তমানে সাইবার ক্রাইম বহুগুণে বেড়ে গেছে। চট্টগ্রামসহ সারাদেশে অনলাইনে সক্রিয় আছে বহু এজেন্ট। যারা প্রতারণার মাধ্যমে মানুষের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এক্ষেত্রে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। বিশেষ করে যারা ফেইসবুক ব্যবহার করছে কোন নতুন বন্ধুর সাথে সম্পর্ক গড়া কিংবা ট্রানজেকশনের ক্ষেত্রে খুবই সতর্ক থাকতে হবে।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলেছেন, যারা ফেসবুক পেইজ খুলে বা অনলাইনে বিভিন্ন ধরনের রকমারি পণ্য বিক্রির জন্য আকর্ষণীয় ছাড়ের কথা বলে লোভনীয় বিজ্ঞাপন দেয়। এগুলো ভুঁইফোড় প্রতিষ্ঠান। কুরিয়ার সার্ভিসগুলোকে তারা অপরাধের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। এক্ষেত্রে ক্রেতাকে অনলাইনে পণ্য কেনার ব্যাপারে অধিক সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।

সূত্র : দৈনিক আজাদী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!