_____ড.মুহাম্মদ ওয়ালী উল্লাহ মঈন_____
প্রারম্ভিকা :
আল্লাহর দেয়া জীবন বিধান “ইসলাম” তার বিকাশস্থল মক্কা আল মুর্কারামা থেকে আল-মাদীনা আল-মুনাওয়ারায় পরিপূর্ণতার দ্বারপ্রান্তে দশম হিজরীতে বিদায় হজ্বের শুভক্ষণে জাবালে রহমতের পাদদেশে বাতনে ওয়াদী নামক স্থানে নিআমত হিসেবে পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধানের চুড়ান্ত স্বীকৃতি পেল। রাব্বুল ইজ্জতের পক্ষ থেকে ঘোষণা হলোঃ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দিনকে পূর্ণাঙ্গ করলাম। আর তোমাদের উপর আমার নিয়ামতকে সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জীবন ব্যবস্থা হিসেবে মনোনীত করলাম। (সূরা আল-মায়িদা আয়াত-৩) কিয়ামতের পূর্বমুহুর্ত পর্যন্ত আল্লাহর মকবুল এই দ্বীনের দাওয়াত মানুষের কাছে পৌঁছানো ঈমানদারদের অন্যতম দায়িত্ব। রাসুল (স:) এ দায়িত্ব মূলতঃ আলেমগণের উপর ন্যস্ত করেছেন। যুগে যুগে যোগ্য আলেমগণই দ্বীনের দাওয়াতকে পৃথিবীতে চলমান রাখার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন।
চট্টগ্রামকে ইসলামের প্রবেশদ্বার বলেই আখ্যায়িত করেছে প্রাচীন ইতিহাস। অসংখ্য আল্লাহর অলী, বিশ্বখ্যাত আলেমেদ্বীন, পীর-মাশায়েখ বুকে ধারণ করে ধন্য হয়েছে ইসলামাবাদ খ্যাত আমাদের এই চট্টলা। যার কারণে সারা মুসলিম বিশ্বে চট্টগ্রামের আলাদা মর্যাদা পরিলক্ষিত হয়। যাঁদের পরশে আজ ধন্য চট্টগ্রাম তাদের মিশিলে ১৯৪০ সালের এক শুভক্ষণে যুক্ত হয়েছিলেন প্রখ্যাত আলেমেদ্বীন ফখরুল ওয়ায়েজীন, আশিকে রাসুল (স:) হযরত মাওলানা মুহাম্মদ আহছান উল্লাহ (র:)। তিনি সাতকানিয়া উপজেলার রামপুর মাওলানা পাড়ায় জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর শিশুকাল ও কৈশোর পিতা – মাতার সাথে উক্ত গ্রামেই কাটে।
মাতা-পিতা :
তাঁর মাতার নাম হাবিবা খাতুন ও পিতার নাম মাওলানা মুহাম্মদ ওবাইদুল্লাহ (রঃ)। মাওলানা মুহাম্মদ আহছান উল্লাহ (রঃ) এর দাদা মাওলানা মুহাম্মদ ওয়ালী উল্লাহ (রঃ) তৎকালীন সময়ের একজন বিখ্যাত আলেম ও ওলীয়ে কামেল ছিলেন। কথিত আছে যে, তিনি পায়ে হেঁটে হজ্ব পালন করেছেন। বর্তমান মায়ানমারের বন্দর নগরী আকিয়াবের মসজিদে ইমামতের খেদমতরত অবস্থায় তিনি সেখানে ইন্তেকাল করেন। তারপর মাওলানা ওবাইদুল্লাকে তাঁর খালু সাতকানিয়া রামপুর নিবাসী মাওলানা আফতাব উদ্দীন (রঃ) লালন-পালন করার জন্য রামপুর নিয়ে আসেন। সেখান থেকে মাওলানা ওবাইদুল্লাহ (রঃ) প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে চট্টগ্রাম দারুল উলুম আলীয়া মাদরাসা থেকে উচ্চ শিক্ষা লাভ করে রাজশাহী বিভাগের সিরাজগঞ্জ আলীয়া মাদরাসায় মুহাদ্দিস হিসেবে যোগদান করেন। তারপর চট্টগ্রাম সীতাকুন্ড আলীয়া মাদরাসায় মুহাদ্দিস হিসেবে যোগদান করেন।
পারিবারিক অসুবিধার কারণে উক্ত চাকুরী ছেড়ে তিনি লোহাগাড়ায় নিজ গ্রামে এসে দ্বীনি শিক্ষার প্রসারে নিজেকে নিয়োজিত করেন। তিনি একজন মুহাক্কিক আলেম ছিলেন। বিশেষ করে ইলমে ফারায়েযের একজন পন্ডিত হিসেবে এলাকায় সমাদৃত ছিলেন। উল্লেখ্য যে, মাওলানা ওবাইদুল্লাহ (রাঃ) পরবর্তীতে রামপুর থেকে নিজ জন্মস্থান লোহাগাড়া উপজেলার চরম্বা নোয়ার বিলা গ্রামে চলে আসেন। মাওলানা ওবাইদুল্লাহ ১৯৮৭ সালের ২৭ মার্চ ও হাবিবা খাতুন ১৯৯৬ সালে ইন্তেকাল করেন।
বংশ পরিচয় :
মাওলানা মুহাম্মদ আহছান উল্লাহ (রঃ) এর বংশ পরম্পরা ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর (রাঃ) এর বংশ পরিক্রমার সাথে যুক্ত। যারা হযরত শাহ জালাল ইয়ামেনী (রঃ) এর সাথে ইসলাম প্রচার করার জন্য এদেশে আগমন করেছিলেন তার পূর্ব পুরুষগণ তাদের সফরসঙ্গী ছিলেন। তাদের এ বংশে অনেক ক্ষণজন্মা আলেম জন্ম নিয়েছেন। চুনতী আধুনগরের বিখ্যাত বড় মিয়াজী ও ছুফি মিয়াজী পরিবারের সাথে মাওলানার পরিবারের আত্মীয়তার বন্ধন শত বছরের ঐতিহ্যে পরিবেষ্টিত। তাঁদের পূর্ব বংশের ঐতিহ্য অনুসারে তাদেরকে খলিফার বংশ হিসেবে সবাই চেনে। এ অনুসারে মাওলানা আহছান উল্লাহর গ্রাম খলিফা পাড়া হিসেবে বিখ্যাত।
শিক্ষা জীবন :
আলহাজ্ব শাহ মাওলানা আহছান উল্লাহ (রঃ) রামপুরে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করার পর তাঁর পিতা তাঁকে গারাঙ্গিয়ার বড় হজুর মাওলানা শাহ মুহাম্মদ আবদুল মজীদ (রঃ) এর হাতে সোপর্দ করেন। তিনি একাধারে গারাঙ্গিয়া আলীয়া মাদরাসা থেকে ১৯৫৮ সালে প্রথম বিভাগে দাখিল, ১৯৬০ সালে প্রথম বিভাগে আলিম ও ১৯৬২ সালে ২য় বিভাগে ফাজিল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি ১৯৬৫ সালে চট্টগ্রাম দারুল উলুম আলীয়া মাদরাসা থেকে ২য় শ্রেণীতে কামিল হাদীস বিভাগের সনদ লাভ করেন।
কর্মজীবন :
কর্মজীবনের শুরুতে তিনি রাঙ্গুনিয়া আলম শাহ পাড়া আলীয়া মাদরাসায় শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তারপর বোয়ালখালী গোমদন্ডী ফাজিল মাদরাসা, নাজিরহাট আহমদিয়া কামিল মাদ্রাসার প্রভাষক ও কলাউজান দারুচ্ছুন্নাহ মাদ্রাসার প্রভাষক হিসেবে খেদমত করেছেন। তিনি চট্টগ্রাম ভেলুয়ার দীঘি জামে মসজিদ ও পাহাড়তলী হাজী ক্যাম্প জামে মসজিদে দীর্ঘ ২১ বছর ইমাম ও খতীব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৮৮ সালে তিনি চরম্বা ইউনিয়নের পশ্চাদপদ এলাকাবাসীকে শিক্ষায় আলোকিত করার মানসে অক্লান্ত পরিশ্রম করে চরম্বা জামেউল উলুম ইসলামিয়া মাদরাসা, শাহ আখতারিয়া এতিমখানা, শাহ মজিদিয়া হেফজখানা ও বায়তুল আমান জামে মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত তিনি অত্র মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ও পরবর্তীতে আমৃত্যু সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
দ্বীনি খিদমাত :
মাওলানা মুহাম্মদ আহছান উল্লাহ (রঃ) দ্বীনের একজন একনিষ্ঠ মুবাল্লিগ (ইসলাম প্রচারক) ছিলেন। শিক্ষা জীবনেই একজন সুবক্তা হিসেবে তিনি সবার নজর কাড়েন। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, পাবর্ত্য চট্টগ্রাম ও আশেপাশের জেলাগুলোর প্রত্যেক মাদ্রাসার মাহফিল, সীরাতুন্নবী (সাঃ) ও বিভিন্ন ইসলামী জলসাগুলোতে তিনি ছিলেন একজন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ওয়ায়েজ (বক্তা)। গারাঙ্গিয়ার বড় হুজুর (রঃ), ছোট হুজুর (রঃ), বায়তুশ শরফের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা মীর মোহাম্মদ আখতার (রঃ) ও শাহ মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল জব্বার (রঃ) ও কুতুবদিয়ার শাহ আব্দুল মালেক মুহিউদ্দিন আল কুতুবী (রঃ) তাঁকে একান্তভাবে ¯েœহ ও তাঁর জন্য দোয়া করতেন। চুনতী সীরাতুন্নবী (সঃ) এর প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা হাফেজ আহমদ (শাহ সাহেব) (রঃ) তাকে সীরাতে প্রায় সময় কিয়াম ও মিলাদের জন্য আলাদা সময় বরাদ্দ দিয়ে সুযোগ করে দিতেন। দ্বীনের প্রচারে বিশেষ অবদান রাখার জন্য দায়রা কমপ্লেক্স, আজিমপুর, ঢাকা -এর তৎকালীন পীর মাওলানা শাহ ছুফী দায়েম উল্লাহ (রঃ) ১৯৮৬ সালে তাঁর সংস্থার পক্ষ থেকে বিশেষ সম্মাননা পুরষ্কারে ভূষিত করেন। তিনি একজন সত্যিকারের আশেকে রাসূল (সঃ) ছিলেন।
তরীকতের খেলাফত লাভ :
পারিবারিকভাবেই মাওলানা আহছান উল্লাহ (রঃ) মুজাদ্দেদীয়া তরীকতের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। তাঁর পিতা মাওলানা ওবাইদুল্লাহ (রঃ) গারাঙ্গিয়ার বড় হুজুর (রঃ) এর প্রথম সারির খলিফা ছিলেন। পরবর্তীতে গারাঙ্গিয়ার ছোট হুজুরও (রঃ) তাঁকে খিলাফাত প্রদান করেন। মাওলানা আহছান উল্লাহ (রঃ) মুজাদ্দেদীয়া তরীকতের উজ্জ্বল নক্ষত্র মাওলানা আবদুচ ছালাম আরকানী (রঃ) এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন। ছোট হুজুর (রঃ) তাঁকে তরীকতের খিলাফাত প্রদান করেন।
পারিবারিক জীবন :
মাওলানা মুহাম্মদ আহছান উল্লাহ (রঃ) চার ভাই ও তিন বোনের মধ্যে দ্বিতীয়। ১৯৬৭ সালে তিনি চরম্বা ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান আলহাজ্ব সুলতান আহমদ সওদাগরের প্রথম কন্যা মুছাম্মৎ নাছিমা সুলতানার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি চার ছেলে, ছয় মেয়ে সন্তানের জনক। পাঁচ মেয়ে বিবাহিত ও ছোট মেয়ে খুলনা মেডিক্যাল কলেজে এমবিবিএস শেষ বর্ষের ছাত্রী। বড় দুই ছেলে যথাক্রমে মাওলানা মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ও মাওলানা মুহাম্মদ ছলিম উল্লাহ বেলাল দারুল উলুম কামিল মাদ্রাসা ও বায়তুশ শরফ কামিল মাদরাসা থেকে কামিল (¯œাতকোত্তর) পাস করার পর বর্তমানে সৌদি প্রবাসী। ৩য় ছেলে ড. মুহাম্মদ ওয়ালী উল্লাহ, তামিরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসা ও মাদ্রাসা-ই-আলিয়া, ঢাকা থেকে ১ম শ্রেণিতে কামিল পাস করেন। তিনি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া এর আল-কুরআন এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ থেকে ১ম শ্রেণিতে ¯œাতক ও ¯œাতকোত্তর ডিগ্রী এবং ২০১০ সালে পি-এইচ.ডি. ডিগ্রী অর্জন করেন। বর্তমানে চট্টগ্রাম সরকারী মডেল কলেজের প্রভাষক। ছোট ছেলে মুহাম্মদ আমান উল্লাহ মিনহাজ বায়তুশ শরফ আদর্শ কামিল মাদরাসা থেকে দাখিল পাশ করে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়াররিং এ ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেছে।
চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য :
মাওলানা মুহাম্মদ আহছান উল্লাহ (রঃ) অত্যন্ত ভদ্র ও নম্র স্বভাবের লোক ছিলেন। মুসকি হাসিমাখা নূরানী চেহারায় মানুষকে সহজেই তিনি আপন করে নিতে পারতেন। একজন আলেম হিসেবে তিনি রাসূলের (সঃ) সুন্নাতের অনুসারী ছিলেন। মাদরাসার ছাত্রদের মাথায় টুপি, দাঁড়ি ও সুন্নাতী পোশাক না থাকলে তিনি উপদেশ দিতেন। সর্বস্তরের মানুষের কাছে তিনি একজন গ্রহণযোগ্য আলেম ছিলেন। তার জানাযায় হাজার হাজার আলেম ওলামা, রাজনীতিবীদ, ব্যবসায়ী ও সাধারণ জনতা উপস্থিতিই একথার জলন্ত প্রমাণ বহন করে।
ইন্তেকাল :
দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিখ্যাত এই আলেমে দ্বীন নাতিদীর্ঘ সময় রোগভোগের পর ২০১০ সালের ৬ সেপ্টেম্বর, ২৬ শে রমজান কদরের দিন রোজ সোমবার রাত ২.৩০ মিনিটের সময় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে আলামে বরযখের পথে রওয়ানা দেন। তাঁর নিজ গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে পিতা-মাতার পাশে তাঁকে কবরস্থ করা হয়। তারপুত্র মাওলানা ড. মুহাম্মদ ওয়ালী উল্লাহ মঈন নামাযে জানাযার ইমামতি করেন। ০৬/০৯/২০১৮ইং তারিখে তার অষ্টম মৃত্যু বার্ষিকীতে রুহের মাগফেরাত কামনা করছি।
লেখক- প্রভাষক, চট্টগ্রাম সরকারি মডেল কলেজ, খুলশী, চট্টগ্রাম।