ব্রেকিং নিউজ
Home | দেশ-বিদেশের সংবাদ | রাতে মশা, দিনেও মশা

রাতে মশা, দিনেও মশা

নিউজ ডেক্স : ব্রিটিশ শাসিত ভারতীয় উপমহাদেশেও মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ ছিল লোকজন। এ জনদুর্ভোগের বিষয়টি তুলে ধরে ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে লেখা ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত লিখেন, ‘রাতে মশা দিনে মাছি, দুই তাড়িয়ে কলকতায় আছি’। এরপর কেটে গেছে ১৯১ বছর। এ জনপদ থেকে বিতাড়িত হলো ব্রিটিশরা। ভারত থেকে পাকিস্তান হয়ে জন্ম হলো স্বাধীন বাংলাদেশের। তাও ৫০ বছর পেরিয়েছে। অথচ দীর্ঘ এ সময়েও মশাজনিত দুর্ভোগ থেকে মুক্তি মিলে নি। বরং বেড়েছে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম শহরে। কারণ এখানে কেবল রাত নয়। দিনেও সমানতালে কামড়াচ্ছে মশা। সম্প্রতি সিটি মেয়র বিষয়টি স্বীকারও করেছেন।

নগরবাসী অভিযোগ করেছেন, মশার উপদ্রব বৃদ্ধির বিষয়টি মেয়র স্বীকার করলেও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মশক নিধনে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। অথচ ‘স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন, ২০০৯ এর তৃতীয় তফসিল ‘জনস্বাস্থ্য’ বিষয়ে যে ক্ষমতা তার আলোকে মশক নিধনে ব্যবস্থা নিতে হবে সংস্থাটিকে। এছাড়া গত বছরের ২৫ আগস্ট স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় ‘জানুয়ারি হতে ডিসেম্বর, মশকনিধন বছরভর’ স্লোগানে দেশে প্রথমবার জাতীয় নির্দেশিকা প্রণয়ন করে। এতে চসিকের জন্য কার্যপ্রণালী ঠিক করা হয়েছে। যা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করছে না সংস্থাটি। সর্বশেষে গত মাসে সারা দেশে মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধে মশক নিধন বিষয়ে অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায়ও চসিকের জন্য করণীয় ঠিক করা হয়। এক মাস পার হলেও তা কার্যকর হয়নি নগরে। ফলে মশার উপদ্রব বাড়ছে শহরে।

কীটতত্ত্ববিদগণ বলছেন, বৃষ্টি হলে ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশার উপদ্রব বাড়বে। তবে শুষ্ক মৌসুম হওয়ায় বর্তমানে কিউলেক্স মশার ঘনত্ব বেড়েছে। এ মশার উপদ্রব নিয়ন্ত্রণে নালা-নর্দমা পরিষ্কারের পাশাপাশি লার্ভা নিধনে ‘লার্ভিসাইড’ ছিটাতে হবে। তবে চসিক পূর্ণাঙ্গ মশা ধ্বংসকারী ‘এডাল্টিসাইড’ ছিটানোর উপর জোর দিচ্ছে। গত পাঁচ মাসে চার হাজার ২০০ লিটার ‘ইনভেন্ট লিকুইড ইনসেকটিসাইড’ নামের এডাল্টিসাইড কিনেছে চসিক। বিপরীতে মাত্র ২৫০ লিটার ‘টেমিফস ফিফটি পার্সেন্ট ইসি’ নামে লার্ভিসাইড সংগ্রহ করে সংস্থাটি। তবে চসিকের পরিচ্ছন্ন বিভাগের কর্মকর্তাদের দাবি, খাল-নালায় কালোতেল (এলডিও) ছিটানো হচ্ছে যা লার্ভা দমনে কার্যকর। বর্তমান মেয়রের মেয়াদকালে ৫৬ হাজার লিটার কলোতেল সংগ্রহ করা হয়েছে।

তবে অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত প্রায় ১৫ দিন ধরে কালো তেলের মজুদ নাই চসিকে। এর কারণ হিসেবে জানা গেছে, কালো তেল হচ্ছে ‘এলডিও’ এবং ‘এএইচএসডি’ নামে দুটি উপকরণের মিশ্রণ। পদ্মা অয়েল কোম্পানি থেকে এ মিশ্রণ সংগ্রহ করে চসিক। তবে ১৫ দিন আগে পদ্মা অয়েল কোম্পানি চসিককে জানিয়ে দেয়, মিশ্রণ সরবরাহ করা হবে না। উপকরণগুলো আলাদা আলাদাভাবে সংগ্রহ করে চসিককে মিশাতে হবে। ফলে এই ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াগত জটিলতার কারণে কালোতেল সংগ্রহ করতে সময় লাগছে।

এদিকে লর্ভিসাইড কম সংগ্রহের কারণ হিসেবে জানা গেছে, ‘টেমিফস ফিফটি পার্সেন্ট ইসি’ নামের লার্ভিসাইডের এর দাম তুলনামূলক বেশি। প্রতি লিটার লার্ভিসাইড এর দাম তিন হাজার ৮৮০ টাকা। বিপরীতে কলোতেলের উপকরণ প্রতি লিটার ‘এলডিও’ ৬৭ টাকা ৬০ পয়সা এবং ‘এএইচএসডি’ এর দাম ৭৭ টাকা ২১ পয়সা।

চসিকের বক্তব্য : চসিকের উপ-প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা মোরশেদুল আলম চৌধুরী বলেন, আমরা পদ্মা অয়েল কোম্পানির সাথে যোগাযোগ করেছি। ‘এলডিও’ এবং ‘এএইচএসডি’ আলাদা আলাদাভাবে সংগ্রহ করবো। লার্ভিসাইডের পরিমাণ কম প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বলেন, পরিমাণে কম সংগ্রহ করা হলেও এখনো যে মজুদ আছে তা দিয়ে আরো দুয়েক মাস যাবে। কারণ লার্ভিসাইডটি প্রতি আট লিটার পানিতে মাত্র পাঁচ এমএল মিশাতে হয়। তাই ২৫০ লিটার কিনলেও এখনো মজুদ আছে।

এ কর্মকর্তা বলেন, পুরো বছরের জন্য ১৫ হাজার লিটার এডাল্টিসাইড এবং দুই হাজার লিটার লার্ভিসাইড সংগ্রহের প্রস্তাবনা দিয়েছি। প্রকিউরমেন্ট শাখা টেন্ডার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ওষুধ সংগ্রহ করবে।

নগরে মশার উপদ্রব বৃদ্ধি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বলেন, আমিও নিজেও ভুক্তভোগী। তবে এর পেছনে কিছু বাস্তবতাও আছে। আমরা তো মশার জন্য কামান দাগাতে পারবো না। তবে আইইডিসিআর (রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট) যেভাবে নির্দেশনা আছে সেভাবে ওষুধ ছিটাচ্ছি। কিন্তু শহরে যেখান থেকে মশা উৎপন্ন হয় সেখানকার ৯০ ভাগ জায়গায় পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে আছে। সিডিএ জলাবদ্ধতা নিরসন মেগা প্রকল্পের কাজের সুবিধার্থে বাঁধ দিয়ে রেখেছে। পানি প্রবাহ যতদিন স্বাভাবিক হবে না ততদিন মশার উপদ্রব কমবে না।

তিনি বলেন, মেয়র মহোদয়ের নির্দেশে আমরা খাল, নালা-নর্দমা পরিষ্কারে জোর দিচ্ছি। প্রতিদিন ৭টি ওয়ার্ডে আমরা স্কেভেটর দিয়ে কাজ করছি। পরিষ্কার থাকলে অন্তত মশার লার্ভা বড়বে না।

কীটতত্ত্ববিদের বক্তব্য : নগরে মশার উপদ্রব বৃদ্ধির কারণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা কীটতত্ত্ববিদ এনতেজার ফেরদৌস দৈনিক আজাদীকে বলেন, এখন তো শুষ্ক মৌসুম। নালা-নর্দমায় পানি প্রবাহ হচ্ছে না। সেখানে পানি জমে আছে। এতে কিউলেঙ মশার লার্ভা বাড়ছে। যদি পানি প্রবাহ থাকতো তাহলে লার্ভাগুলো চলে যেতো। তবে কিউলেঙ মশার কামড়ে যে রোগ হয় তা চট্টগ্রাম শহরে পাওয়া যায়নি। তবে এর কামড়ে অস্বস্তি লাগে। মানুষ বিরক্ত হয়। কিউলেঙ মশার উপদ্রব থেকে বাঁচার উপায় জানতে চাইলে বলেন, ড্রেনগুলো পরিষ্কার রাখতে হবে। এরপর লার্ভিসাইড ছিটাতে হবে।

নগরবাসীর বক্তব্য : মশার উপদ্রব বৃদ্ধির জন্য নগরবাসী চসিককেই দোষারোপ করছে। খুলশী এলাকার বাসিন্দা রওনক জাহান বলেন, আমাদের আবাসিক এলাকার আশেপাশে বড় কোনো ড্রেন নাই, যেখানে বাঁধ দেয়া আছে। আবার এলাকাও শহরের অন্যান্য এলাকার চেয়ে মোটামুটিও পরিচ্ছন্ন। কিন্তু এরপরও মশার অত্যাচারে বাসায় থাকতে পারছি না। রাতদিন যন্ত্রণায় আছি। সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্ন কর্মীরা তাদের বাসার আশেপাশে গত কয়েক মাসে মশার ওষুধ ছিটাতে দেখেননি বলেও জানান তিনি।

ঘাটফরহাদ বেগ এলাকার বাসিন্দা কায়সার আহমেদ। তার বাসার অদূরেই গেছে চাক্তাই খাল। তিনি বলেন, খাল-নালায় নাকি সিটি কর্পোরেশন কালোতেল বা লর্ভিসাইড ছিটায়। কিন্তু আমি কখন দেখেছি মনে নাই। গত এক বছরে অন্তত ছিটাতে দেখিনি। শহরের প্রবীণ এ বাসিন্দা বলেন, যেখানে যেখানে বাঁধ আছে সেখানে বেশি করে তো কালোতেল বা লার্ভিসাইড ছিটাতে পারে। এলাকায় এলাকায় গিয়ে ফগার মেশিন দিয়ে এডাল্টিসাইড ছিটাতে পারে। এতে পুরোপুরি নির্র্মূল না হলেও মশার উৎপাত তো কিছুটা হলেও কমবে। কিন্তু সিটি কর্পোরেশনের তো সেদিকে মনোযোগ নাই।

ষোলকবহর এলাকার বাসিন্দা নজরুল বলেন, দুইদিন আগে কয়েকজন বন্ধুসহ দুই নম্বর গেট বিপ্লব উদ্যানে আড্ডা দিতে গিয়েছিলাম। তখন বিকেল তিনটা। দিনের বেলাও এত বেশি মশার উপদ্রব ছিল ২০ মিনিটও বসতে পারিনি। বাধ্য হয়ে পাশেই এক বন্ধুর বাসায় চলে গেছি। কিন্তু সেখানেও একই অবস্থা। কোথাও শান্তি নাই। তিনি বলেন, সিটি কর্পোরেশন যদি ঠিকমতো ওষুধ ছিটতো মানুষ এত কষ্ট পেতো না। একই বক্তব্য ছিল বাকলিয়ার বাসিন্দা সাইদুলের। তিনি বলেন, গত এক বছরে একবারও ওষুধ ছিটাতে দেখিনি।

উপেক্ষিত জাতীয় গাইডলাইন : স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় প্রণীত জাতীয় গাইডলাইনে ৩৪টি নির্দেশনা আছে। যার বেশিরভাগই বাস্তবায়ন করছে না চসিক। নির্দেশিকা অনুযায়ী, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর হতে ডেঙ্গু রোগীর ঠিকানা সংগ্রহ করে রোগীদের বাড়িতে ও চারপাশের কমপক্ষে ৫০টি বাড়িতে এডিস মশা নিধনে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করতে হবে। পূর্ণাঙ্গ মশা ধ্বংসে অপরাহ্ন হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত এডাল্টিসাইড ও লার্ভা ধ্বংসে সকাল ৮ টা থেকে ১১টা পর্যন্ত লার্ভিসাইড ছিটাতে হবে। পাশাপাশি মশার প্রজননস্থল চিহ্নিত করে ধ্বংসসহ সুনির্দিষ্ট ১০টি বিষয়ে এক বছরের জন্য কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে চসিককে। এছাড়া বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ, পর্যালোচনা ও তদারকির জন্য মেয়রের নেতৃত্বে ১৪ সদস্যের এবং ওয়ার্ড পর্যায়ে কাউন্সিলরদের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের পৃথক দুটি কমিটি গঠন করতে হবে। তবে সাড়ে সাত মাস পূর্ণ হলেও নির্দেশিকা অনুসরণ করেনি চসিক। -দৈনিক আজাদী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!