ব্রেকিং নিউজ
Home | দেশ-বিদেশের সংবাদ | ভূমিকম্পে বেশি ঝুঁকিতে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার

ভূমিকম্পে বেশি ঝুঁকিতে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার

নিউজ ডেক্স : রিখটার স্কেলে সাত দশমিক পাঁচ থেকে আট দশমিক পাঁচ মাত্রার ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশ। এ ভূমিকম্পের উৎপত্তি হতে পারে বাংলাদেশ-মিয়ানমার, বাংলাদেশ-ভারত এবং মিয়ানমার-ভারত (পার্বত্য চট্টগ্রামের পূর্বে) সীমান্ত এলাকা। পূর্বাভাস দেয়া মাত্রায় ভূমিকম্প হলে অবস্থানগত কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকিতে আছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার। এর মধ্যে নগরের ৮০ ভাগ আবাসিক ভবন সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা এ তথ্য জানিয়েছেন।

সাত দশমিক পাঁচ থেকে আট দশমিক পাঁচ মাত্রার ভূমিকম্প হলে সম্ভাব্য ক্ষতি এড়াতে এখন থেকেই প্রস্তুতি নেয়ার পরামর্শও দিয়েছেন বিশেষজ্ঞগণ। এক্ষেত্রে ভূমিকম্প সহনীয় নয় এমন ভবন চিহ্নিত করে শক্তি বৃদ্ধির প্রকল্প গ্রহণের উপর জোর দিয়েছেন তারা। এছাড়া কক্সবাজার বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্প, মহেশখালী-মাতারবাড়িতে বিদ্যুৎ প্রকল্প, গভীর সমুদ্রবন্দর, চট্টগ্রামের আনোয়ারা ইকনমিক জোন, মীরসরাই শিল্পাঞ্চলে অবকাঠামো ভূমিকম্প সহনীয় করার পরামর্শ দেন তারা। এছাড়া ভূমিকম্প পরবর্তীতে ‘লাইফ লাইন’ অর্থাৎ পানি, বিদ্যুৎ যেন সচল থাকে ওসবেরও এসসমেন্ট করে শক্তি বৃৃদ্ধির পরামর্শ দিয়েছেন।

বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন : ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি চট্টগ্রাম (ইউএসটিসি) এর উপাচার্য ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্ত, ভারত-মিয়ানমার সীমান্ত এবং বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত এলাকা হচ্ছে আমাদের ভূমিকম্পের মূল উৎস। এসব এলাকা থেকে ৭ দশমিক ৫ থেকে ৮ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প সৃষ্টি হবে। আজকে (গতকাল) যেটা হয়েছে তার উৎপত্তি মায়ানমার-ভারত সীমান্ত। তিনি বলেন, ৭ দশমিক ৫ থেকে ৮ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে প্রথম আঘাতটা আসবে আমাদের ট্যুরিজম সিটি কঙবাজারে। সেখানে তো প্রাইভেট হোটেল-মোটেল বেশি। সেখানে বিদ্যমান ভবনের এসেসমেন্ট করে শক্তি বৃদ্ধি করার প্রকল্প হাতে নিতে হবে। তা নাহলে ট্যুরিজম ধ্বংস হয়ে যাবে। কঙবাজার বিমানবন্দর কিন্তু সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রানওয়ে হচ্ছে সমুদ্রের ভেতর। সেটা ভূমিকম্প প্রতিরোধী নকশা দিয়ে করা হচ্ছে কী না দেখতে হবে।

চুয়েটের সাবেক এ ভিসি বলেন, মাতারবাড়ি-কঙবাজারও কিন্তু খুব কাছে। সেটা মিনি সিঙ্গাপুর হয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী অথরিটিও ঘোষণা করেছেন। ওখানে যে স্থাপনা হচ্ছে, পাওয়ার স্টেশন ও ডিপ সি পোর্ট সেগুলো ভূমিকম্প প্রতিরোধী কনস্ট্রাকশন দিয়ে হচ্ছে কী না নিশ্চিত করতে হবে। না হলে কিন্তু বিশাল আঘাত আসবে। বঙ্গবন্ধু শিল্প নগরী ও দক্ষিণ চট্টগ্রামে যে শিল্পাঞ্চল হচ্ছে সেখানেও প্রপার ওয়ে’তে হচ্ছে কীনা দেখতে হবে।

তিনি বলেন, চট্টগ্রামে যে আবাসিক ভবন সেখানে এসেস করে দেখা গেছে, ৭ দশমিক ৫ থেকে ৮ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ৮০ শতাংশ ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এসেসমেন্ট করে ভবনের শক্তি বৃদ্ধি করার প্রকল্প হাতে নিতে হবে। এক্ষেত্রে শক্তি বৃদ্ধি করতে গেলে টাকার দরকার। এজন্য ব্যক্তি মালিকানাধীন ভবনের জন্য সরকার শূন্য পার্সেন্ট ইন্টারেস্টে লোন দিতে পারেন। তাহলে সবাই আগ্রহী হবেন। লাইফ লাইন তথা হাসপাতাল ভবন, পাওয়ার লাইন, পানির লাইনে নজর দিতে হবে, শক্তি বৃদ্ধি করতে হবে। যেন ভূমিকম্পের পর এসব সচল থাকে।

তিনি বলেন, এসেসমেন্ট করার ম্যানুয়েল সরকার করে দিয়েছে। শক্তিবৃদ্ধি করার ম্যানুয়াল গাইডলাইনও দেয়া হয়েছে। এখন প্রকৌশলী ও পরিকল্পনাবিদদের উচিত ম্যানুয়েল অনুসরণ করে শক্তি বৃদ্ধির প্রকল্প নেয়া। বিগত সময়ে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় একটা গাইডলাইন দিয়ে দিলে লোকাল অথরিটি সেটা পালন করতে বাধ্য হবে।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইনস্টিটিউট অব আর্থকোয়েক ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চের পরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, বাংলাদেশে ১৮৯৭ সালে রিখটার স্কেলে ৮ মাত্রার অধিক ভূমিকম্প হয়েছিল। এরপর বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়নি। ভূমিকম্পের জন্য যে ক’টি ঝুঁকিপূর্ণ ফল্টলাইন তার বেশ কয়েকটা বাংলাদেশের আশেপাশে আছে। সে প্রেক্ষাপটে আমাদের দেশ অবশ্যই ভূমিকম্পন প্রবণ এলাকা। বিশেষ করে চট্টগ্রাম এবং সিলেট ঝুঁিকপূর্ণ এলাকা। বর্তমানে যে জুরিখ ম্যাপ সেখানে কিন্তু তৃতীয় অ্যাক্টিভ জোনে আছে চট্টগ্রাম, সিলেট ভেরি অ্যাক্টিভ। তিনি বলেন, আজকে (গতকাল) যে ভূমিকম্প হয়েছে তার উৎপত্তি চট্টগ্রাম থেকে ১৮৫ কিলোমিটার দূরে। রিখটার স্কেলে তা ছিল ৬ দশমিক ১। ভবিষ্যতে এসব এরিয়া থেকে আরো বড় মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে। যদি হয় ক্ষয়ক্ষতির দিক থেকে অবস্থা খারাপ হবে।

ভবিষ্যতে বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে করণীয় কি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ক্ষয়ক্ষতি যেন কমানো যায়, মানুষের জীবন যেন বাঁচাতে পারি, অবকাঠামোগত এবং অর্থনৈতিক লস যেন কমাতে পারি তার জন্য এখন থেকেই ব্যবস্থা নিতে হবে। চট্টগ্রামে স্পেশাল কেয়ার নিতে হবে। বিদ্যমান ভবনের যেগুলো ভূমিকম্প সহনীয় নয় সেগুলোকে ভূমিকম্প সহনীয় করতে হবে। সরকারি-বেসরকারিভাবে নতুন যেসব ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে সেগুলোতে ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড অনুসরণ করতে হবে।

কতটা ঝুঁকিতে চট্টগ্রাম : ভূমিকম্পের উৎপত্তির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ মিয়ানমার-ভারত সীমান্ত চট্টগ্রাম থেকে ১৫০ থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরে। গত সাত বছরে ২০০ এর অধিক ভূমিকম্প রেকর্ড করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকম্প বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইরএরএস (ইনকরপোরেটর রিচার্স ইনস্টিটিউশন ফল সিসমোলজি)।

ভূমিকম্প বিষয়ক বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনে তথ্য অনুযায়ী, পৃথিবীর ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চল তথা হিমালয় বেল্টে অবস্থান করায় ঝুঁকিতে আছে চট্টগ্রাম। ১৯৭৯ সালে জিওলজিক্যাল সার্ভে অব বাংলাদেশ সিসমিক জোনিং ম্যাপেও চট্টগ্রামকে সবচেয়ে বিপদসংকুল অঞ্চল ঘোষণা করা হয়। দেশের সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির (সিডিএমপি) বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামালও ২০১৫ সালে তাঁর গবেষণায় চট্টগ্রামের ঝুঁকির বিষয়টি তুলে ধরেন। বর্তমানে জুরিখ ম্যাপেও তৃতীয় সক্রিয় জোনে অবস্থান করছে চট্টগ্রাম।

২০০৮ সালের নভেম্বর থেকে ২০২০ সালের ২২ জুন পর্যন্ত ভারত, বাংলাদেশ, মিয়ানমার, চীন, নেপালসহ আশেপাশের দেশগুলোতে হওয়া দেড় হাজার ভূমিকম্পের তথ্য সংরক্ষিত আছে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে। এ তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ভারত-মিয়ানমার সীমান্ত অঞ্চল থেকে ৪১টি এবং বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে উৎপত্তি হয়েছে ১০টি ভূমিকম্প। এছাড়া বাংলাদেশে উৎপত্তি হয় ১৭টি। এরমধ্যে ২০১৬ সালের ২৭ জুন ৪ দশমিক ৭ মাত্রার একটি ভূমিকম্পের উৎপত্তি স্থল ছিল চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলা থেকে ২৪ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে।

ভূমিকম্প বিষয়ক প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকায় ১৭৬২ সালে ৮ দশমিক ৮ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়েছিল। সাধারণত এক’শ বছর পর একই এলাকায় আবারও বড় আকারের ভূমিকম্প হয়। তবে গত ১৫৮ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামের পূর্ব পাশ দিয়ে যাওয়া ফল্টলাইন ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় বড় ধরনের কোনো ভূমিকম্প হয়নি। ফলে মিয়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকায় যেকোনো সময় বড় ধরনের ভূমিকম্প হতে পারে।

জানা গেছে, ১৯৯৭ সালের ২১ নভেম্বর ভূমিকম্পে নগরের হামজারবাগে পাঁচ তলা বিশিষ্ট সওদাগর ভিলা ধসে পড়ে ২৩ জন নিহত হন। বর্তমানেও শহরে অসংখ্য বহুতল ভবন আছে যেগুলো বিল্ডিং কোড মেনে নির্মাণ করা হয়নি। ফলে ভবিষ্যতেও বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে ভবন ধসের ঝুঁকি আছে এখানে। কয়েক বছর আগে চুয়েটের এক গবেষণায় চট্টগ্রাম শহরের ১ লক্ষ ৮২ হাজার ভবনের মধ্যে ১ লক্ষ ৪২ হাজার ভবনকে ভূমিকম্পের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলা হয়েছিল।

কয়েক বছর আগে করা চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) ভূমিকম্প গবেষণা কেন্দ্রের সার্ভে রিপোর্ট সূত্রে জানা গেছে, ভূ-স্তরের ইউরোশিয়ান ও ইন্দো- অস্ট্রেলিয়ান প্লেটের ভূ-অবস্থানগত ভূমিকম্প জোনের মধ্যেই রয়েছে চট্টগ্রাম। এই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, ইউরোশিয়ান ও ইন্দো-অস্ট্রেলিয়ান প্লেট দুটি অতি মাত্রায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে। ফলে ঘন ঘন ভূমিকম্প দেখা দিচ্ছে।

কাছাকাছি সময়ে ডেভেলপমেন্ট ডিজাইন কনসালটেন্ট (ডিডিসি) নামের একটি প্রতিষ্ঠানের জরিপে বলা হয়, চট্টগ্রামের গভীর তলদেশে ভূ-স্তরে বিপজ্জনক ৪টি প্লেট চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। প্লেটগুলো ভূ-ত্বকের অভ্যন্তরে সচল হয়ে উঠলে ভূমিকম্প সৃষ্টি হয়। তাদের মতে, চট্টগ্রাম বন্দর, শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর সবচেয়ে বিপজ্জনক।

বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ভূমিকম্প প্রকৌশল ও গবেষণা কেন্দ্রের একটি গবেষণা সূত্রে জানা যায়, মীরসরাই থেকে টেকনাফ পর্যন্ত দীর্ঘ ভূ-স্তরের ফাটলটি উত্তর থেকে উত্তর পশ্চিম, দক্ষিণ থেকে দক্ষিণ পূর্ব দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের উপর দিয়ে সমান্তরালভাবে অবস্থিত। যা বন্দর এলাকা হয়ে টেকনাফ পর্যন্ত বিস্তৃত। এ এলাকার স্থানচ্যুতিজনিত কারণেও ভূমিকম্প হতে পারে। দৈনিক আজাদী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!