Home | দেশ-বিদেশের সংবাদ | দোহাজারী-ঘুনধুম রেল লাইনের কাজ দ্রুতগতিতে চলছে

দোহাজারী-ঘুনধুম রেল লাইনের কাজ দ্রুতগতিতে চলছে

নিউজ ডেক্স : দ্রুতগতিতে চলছে দোহাজারী-ঘুনধুম রেল লাইনের কাজ। রেল লাইনটির মাধ্যমে ট্রান্স এশিয়ান রেলের (টিএআর) তিনটি রুটের সাথে যুক্ত হবে বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে ভূমি অধিগ্রহণের কাজ। চলে এসেছে রেল বিট। নির্মাণ চলছে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী ২০২২ সালের মধ্যে চীন ও মিয়ানমারের সেতুবন্ধন হবে ১২৮ কিলোমিটারের এ রেলপথের। এতে এশিয়ার যে কোন দেশে আসা যাওয়া করা যাবে কম খরচে।

প্রকল্প পরিচালক মফিজুর রহমান জানান, দোহাজারী-ঘুনধুম রেল লাইনের ৩৮ শতাংশ কাজ ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। আশা করছি যথাসময়ে এ প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করা যাবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে-পর্যটন শহর কক্সবাজার রেলওয়ের নেটওয়ার্কে আসবে। দেশি-বিদেশি পর্যটকের যাতায়াত বৃদ্ধি পাবে। কক্সবাজার অঞ্চলে উৎপাদিত মাছ, লবণ, রাবারের কাঁচামাল, বনজ ও কৃষি পণ্য সহজে পরিবহণ করা যাবে। – পূর্বকোণ

১২৮ কি.মি. রেললাইনে যা থাকছে : দোহাজারী থেকে রামু ৮৮ কিলোমিটার, রামু থেকে কক্সাবাজার ১২ কিলোমিটার এবং রামু থেকে গুনধুম পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণের কথা রয়েছে। এছাড়া সাতকানিয়া সদর, লোহাগাড়ার আধুনগর, হারবাং, চকরিয়ার বড় ভেওলা, ডুলাহাজারা, ঈদগাহ’র ইসলামাবাদ, রামুর ফতেয়ার কূল, কক্সবাজার, উখিয়া ও গুনদুমসহ ১১টি রেলস্টেশন নির্মাণ এবং কম্পিউটার বেইজড ইন্টারলক সিগনালিং সিস্টেম, ৫২টি মেজর (বড়) ও ১৯০টি মাইনর (ছোট) রেল সেতু এবং ১১৮টি লেভেলক্রসিং ও ২টি আন্ডারপাস নির্মাণ করা হবে। ১২৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে ১ হাজার ৭৪১ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে।

ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে : ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের (টিএআর) তিন রুটে যুক্ত হচ্ছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে টিএআর-১ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের গেদে সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশের দর্শনা স্টেশন হয়ে ঈশ্বরদী-জামটোইল-জয়দেবপুর-টঙ্গী-আখাউড়া-চট্টগ্রাম-দোহাজারী দিয়ে কক্সবাজার হয়ে ঘুনদুম সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমারে সংযুক্ত হবে। মিয়ানমার দিয়ে এ রেলপথ চীনের সাথে বাংলাদেশকে সংযুক্ত করবে। এছাড়া টিএআর-২ ভারতের সিঙ্গাবাদ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশের রহনপুর হয়ে ঈশ্বরদী এবং টিএআর-৩ ভারতের রাধিকাপুর সীমান্ত দিয়ে আসা ট্রেন বাংলাদেশের বিরল ও পার্বতীপুর হয়ে ঈশ্বরদী এসে শেষ হবে। এই দুটি রুট সাবরুটের মাধ্যমে টিএআর-১ সাথে যুক্ত হবে। এরপর বঙ্গবন্ধু সেতু, জয়দেবপুর, টঙ্গী এসে মিলিত হবে। এরপর সাব রুট-১ দিয়ে ঢাকায় প্রবেশ করবে। এছাড়া সাবরুট-২ দিয়ে টঙ্গী হয়ে আখাউড়া দিয়ে কুলাউড়া-শাহবাজপুর হয়ে ভারতের মহিশাসান সীমান্তে প্রবেশ করবে। ট্রান্স এশিয়ান এই রেল রুটে যুক্ত হওয়ার জন্য আখাউড়া-লাকসাম ১৮৪ কিলোমিটার ডাবল লাইন, কুলাউড়া-শাহবাজপুর ৪০ কিলোমিটার রেললাইন পুনর্বাসন এবং চট্টগ্রাম-কক্সাবাজার-গুনদুম পর্যন্ত ১২৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ ছাড়াও বিভিন্ন স্থানে রেললাইন সংস্কার ও আধুনিকায়নের কাজ চলছে।

ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে রুটে যে সব দেশ যুক্ত : ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেলওয়ের কথা শুনেছেন অনেকেই। চীন থেকে শুরু হয়ে রাশিয়ায় গিয়ে শেষ হওয়া এই বিশাল রেল লাইনটি প্রায় দশ হাজার কিলোমিটার লম্বা। দীর্ঘদিন ধরে এই রেললাইনটি বিশ্বের একটানা সবচেয়ে বড় রেলপথ ছিল। তবে সেই দিন শেষ হতে যাচ্ছে খুব শীঘ্র। এশিয়ার ভেতর দিয়ে যে বিশাল ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে চালু হতে যাচ্ছে আগামী ২০২২ সালের মধ্যে। চালু হলে সেটাই হবে একক দীর্ঘ রেলপথ। প্রায় ১৪ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ এই রেলপথটি সিঙ্গাপুর থেকে শুরু হয়ে শেষ হবে তুরস্কের ইস্তানবুলে। এটাকে বলা হচ্ছে সাউদার্ন করিডোর। এর মাঝে থাকবে তুর্কি, ইরান, পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, চীন হয়ে দক্ষিণ কোরিয়া। অন্যদিকে এই রেলওয়ের নর্দার্ন করিডোর হিসেবে যেটাকে বিবেচনা করা হচ্ছে, সেটা ইউরোপে বিস্তার লাভ করবে এবং একই সাথে ইউরোপ এবং এশিয়াকে যুক্ত করবে। নর্দার্ন করিডোরে থাকছে জার্মানি, পোল্যান্ড, বেলারুশ ইত্যাদি দেশ।

বর্তমানে এশিয়ার অনেক দেশে যেতে গেলে স্থলপথে যাওয়া অত্যন্ত কষ্টকর। আবার আকাশপথে অনেক বেশি খরচের বিষয়। ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে হলে এশিয়ার যে কোন দেশে যাওয়া একই সাথে কম খরচ এবং আরমাদায়কও হবে। একটি ট্রেন টিকিট কেটে অনেকগুলো দেশ ঘুরে বেড়ানোও সম্ভব হবে। দোহাজারী-ঘুনধুম রেলপথ তৈরি সম্পন্ন হলেই এটা সম্ভব হবে। বাংলাদেশ এতদিন ছিল মিসিং লিংক, ২০২২ সালের মাঝে এটা তৈরি হলে পুরো এশিয়ার মাঝে বাংলাদেশি পর্যটকরা অত্যন্ত কম খরচে ঘুরতে যেতে পারবেন।

রেলওয়ে সূত্রে জানায়, ১৮৯০ সালে ব্রিটিশ আমলে প্রথম পরিকল্পনা নেয়া হয় এই রেলপথ নির্মাণে। চট্টগ্রাম ও মিয়ানমারের আকিয়াব বন্দরের মধ্যে রেল যোগাযোগ স্থাপনে প্রায় সোয়াশ বছর আগে প্রথম আগ্রহ প্রকাশ করেছিল তৎকালীন ব্রিটিশ কলোনি মিয়ানমার। ১৮৯০ সালে মিয়ানমার রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রাম থেকে রামু ও কক্সবাজার হয়ে রেলপথ নির্মাণের জন্য সমীক্ষা চালানোর উদ্যোগ নেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯০৮-০৯ সালে মিয়ানমার রেলওয়ে সমীক্ষাও চালায়। এরপর ১৯১৭ থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম-দোহাজারী-রামু হয়ে আকিয়াব পর্যন্ত আবারও সমীক্ষা চালানো হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রকল্পের কাজও শুরু হয়। তখন চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী পর্যন্ত ৫০ কিলোমিটারের মতো রেলপথ নির্মাণ করা হয়। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে বাকি রেলপথ নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ভারত, পাকিস্তান ও মিয়ানমার তিনটি পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু রেলপথ আর হয়নি। এরপর ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সরকার একবার উদ্যোগ নিলেও সফল হয়নি। জাপান রেলওয়ে টেকনিক্যাল সার্ভিস (জেআরটিএস) ১৯৭১ সালে এ পথে ট্রাফিক সম্ভাবনা সমীক্ষা করার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ায় তা আর সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আবার উদ্যোগ নেয়া হয় প্রকল্পটি নির্মাণে।

তৎকালীন সরকারের অনুরোধে ১৯৭৬-৭৭ সালে আবার সমীক্ষা করে জেআরটিএস। পরে ১৯৯২ সালে এসকাপ (ইকোনোমিক এন্ড সোস্যাল কমিশন ফর এশিয়া এন্ড দি প্যাসিফিক) কমিশন অধিবেশনে তিনটি ইউরো-এশিয়া রেল নেটওয়ার্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। এর একটি রুট বাংলাদেশ হয়ে মিয়ানমার যাওয়ার পরিকল্পনা নেয়া হয়। এরপর এই রুট নিয়ে আর তেমন আলোচনা করা হয়নি। তবে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর আঞ্চলিক সহযোগিতার অংশ হিসেবে আবারও এ রেলপথটি নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। এরপর ২০১০ সালে ১ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা ব্যয়ে দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে মিয়ানমারের নিকটে ঘুনধুম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প নেয়া হয়।

২০১০ সালের জুলাই থেকে ২০১৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ ধরা হয়। প্রথমে মিটারগেজ রেলপথ নির্মাণের কথা ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে প্রকল্পটি সংশোধন করে ডুয়েলগেজ রেলপথ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। সংশোধনের পর প্রকল্পের ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ১৩ হাজার ২৯ কোটি টাকা। মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছিল ২০২০ সাল পর্যন্ত। কিন্তু দোহাজারী-কক্সবাজার-ঘুনধুম রুটটি ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের রুটভুক্ত হওয়ায় আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক রেল যোগাযোগ চালু করতে এ রেলপথটি উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে। তাই জমি অধিগ্রহণসহ অন্যান্য খরচ বিবেচনায় রেলপথটি নির্মাণে প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি পেয়ে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৬৫ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আগামী ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!