ওমর ফারুক : সাপের মত এঁকেবেঁকে চলা ইসহাক মিয়া সড়ক ধরে আগাতে আগাতে একটা বান্দরবান বান্দরবান অনুভূতি পেয়ে বসে আমাকে। লাল পাহাড়ের বুক চিরে কিংবা সবুজ বিলের পেটের উপর দিয়ে চলা রাস্তা ধরে মোটরসাইকেল চালাতে চালাতে আচানক চোখে পড়ে বঙ্গবন্ধুর তর্জনী উঁচু করা সেই বিখ্যাত ছবিটি। মোটরসাইকেলের গিয়ার এবং ব্রেকে খেয়াল রাখতে রাখতে ভাবছি সবুজের অভয়ারণ্যে বঙ্গবন্ধু আসল কিভাবে? আরো একটু কাছে গেলে ভুল ভাঙ্গে এবং সেটা করেছেন জনাব হামিদুল ইসলাম। ছোট ছোট শিক্ষার্থীদের কাছে বঙ্গবন্ধুকে পরিচিত করতে, মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের বীরশ্রেষ্ঠদের পরিচয় করিয়ে দিতে কিংবা বইয়ে পড়া বিভিন্ন ছবি গুলো আরো জীবন্ত করতে হামিদুল ইসলাম তিলে তিলে পুরো বিদ্যালয়টিকে আর্ট গ্যালারির মত সাজিয়েছেন।
হামিদুল ইসলামের বিদ্যালয়ের নামটিও কাব্যিক। সবুজ বিল ও আশেপাশে ছোট ছোট দ্বীপের মত সবুজাভ পাহাড়ের কোলে গড়ে উঠা চাঁন্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টিতে গেলে একটা স্বর্গীয় অনুভূতি হয়। গাড়ি থেকে নেমেই চোখে পড়েএকটা ফুলের বাগান। বাহারি রঙের ফুল স্বাগত জানায় আমাকে। ছোট একটা মাঠ বিদ্যালয়ের সামনে। টিফিন পিরিয়ডে শিক্ষার্থীদের কেউ ক্রিকেট খেলে, কেউ রশি খেলে। নিচতলার একেবারে পূর্ব পাশের কক্ষটি প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণিকক্ষ। একটা শিশু এই কক্ষে প্রবেশ করার সাথে নিশ্চিত তার শিক্ষাভীতি প্রীতিতে রূপান্তরিত হবে। পুরো কক্ষটি বিভিন্ন আকর্ষণীয় ছবি দ্বারা সজ্জিত। এর পাশের রুমটি অফিসকক্ষ। কক্ষে প্রবেশ করার সাথে সাথে দক্ষিণ থেকে আসা একটা হিমশীতল হাওয়া বয়ে যায়। দেওয়ালে জুড়ে দেওয়া বিভিন্ন আকর্ষণীয় ছবি দেখতে দেখতে নিচ তলা থেকে উপরে উঠার সময় একটা মুগ্ধতা পেয়ে বসে। প্রতিটা শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকরা বিভিন্ন বাস্তব, অর্ধবাস্তব ও বস্তু নিরেপক্ষ উপকরণ দিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছেন। শিক্ষার্থীদের দু একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে বুঝেছি, তারা প্রত্যন্ত চাঁন্দাতে থাকলেও স্বপ্ন দেখে ডাক্তার হওয়ার, বিজ্ঞানী হওয়ার। তাদের আধো শুদ্ধ, আধো অশুদ্ধ স্বপ্নের কথা আমায় ভাবায়, আমায় স্বপ্ন দেখায়। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে জিজ্ঞেস করি কিভাবে পারলেন এতকিছু? তিনি বলেন
– স্যার, চাকরি আছে আর এক বছর। আমি তো এই প্রত্যন্ত গ্রামেই জীবনটা কাটিয়ে দিলাম। এখন যে সুন্দর রাস্তা দেখছেন সেটা কয়েক বছর আগে স্বপ্নেও ভাবি নাই। আমি চাই গ্রামে থেকেও আমার শিক্ষার্থীরা বড় বড় স্বপ্ন দেখুক। তারা দেশের কথা জানুক, ইতিহাসের কথা জানুক এমনকি পৃথিবীর কথাও।
-আপনার বিদ্যালয়ে আসলে আমার মন জুড়ে যায়। ইচ্ছে করে প্রতিদিন আসি। তো আপনারা চারজন শিক্ষক এতকিছু কিভাবে করলেন?
-আমাদের বিদ্যালয়টাকে এলাকাবাসী খুব ভালোবাসে। এইবারের স্লিপে যে টাকা পেয়েছি তা দিয়ে হয়নি। এলাকাবাসী স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এসেছে বিদ্যালয়কে সাজাতে। আপনার সাথে মতবিনিময় করে আসলে যে পরিকল্পনা করেছিলাম তা করতে অনেক টাকার প্রয়োজন ছিল। আমার সহকর্মীদের মানসিক সহযোগিতা এবং এলাকাবাসীর আর্থিক সহযোগিতায় সেটা সম্ভব হয়েছে।
-আগামীতে আপনার আর কি স্বপ্ন আছে?
-ছাদে একটা বাগান করার ইচ্ছে আছে। আমার তো চাকরি শেষ। আমি চাই আমার শিশুরা বড় বড় জায়গায় যাক। তাদের সফলতার কথা শুনে অবসরে গেলেও আমি শান্তি পাবো।
জনাব হামিদুল ইসলামের স্বপ্ন ঘুড়ি বাস্তবতার নাগাল পাক, বিদ্যালয়টি সত্যিকার মডেল হয়ে উঠুক।
লেখক : সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার, লোহাগাড়া, চট্টগ্রাম।