Home | দেশ-বিদেশের সংবাদ | আবেগের কেন্দ্রবিন্দু এভারকেয়ার

আবেগের কেন্দ্রবিন্দু এভারকেয়ার

নিউজ ডেক্স: রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় অবস্থিত এভারকেয়ার হাসপাতালের সামনের সড়কটি এখন আর সাধারণ কোনো পথ নয়, তা পরিণত হয়েছে এক আবেগের কেন্দ্রবিন্দুতে। গত ২৩ নভেম্বর থেকে এই হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) চিকিৎসাধীন বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তার শারীরিক অবস্থা সংকটাপন্ন।

লিভার সিরোসিস, হৃদরোগ, ফুসফুস ও কিডনি জটিলতায় আক্রান্ত এই নেত্রীর চিকিৎসায় গঠিত হয়েছে দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সমন্বয়ে মেডিকেল বোর্ড। চীন ও যুক্তরাজ্য থেকে আসা বিশেষজ্ঞ দল, লন্ডন থেকে জ্যেষ্ঠ পুত্র তারেক রহমানের সার্বক্ষণিক তদারকি এবং পুত্রবধূ ডা. জোবাইদা রহমানের তত্ত্বাবধানে চলছে তার বেঁচে থাকার লড়াই।

কিন্তু হাসপাতালের চার দেয়ালের বাইরের দৃশ্যটি সম্পূর্ণ ভিন্ন এক গল্পের অবতারণা করছে। গত ২৮ নভেম্বর দুপুরে বেগম খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার অবনতির খবর ছড়িয়ে পড়লে সেদিন সন্ধ্যা থেকেই হাসপাতালের সামনে শুরু হয় মানুষের ঢল। এই ভিড় কোনো রাজনৈতিক শো-ডাউন নয়, সেখানে নেই কোনো স্লোগান। আছে কেবল আবেগ, সম্মিলিত দোয়া আর উৎকণ্ঠা।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বেগম খালেদা জিয়ার আজকের এই অবস্থান একদিনে তৈরি হয়নি। ১৯৮১ সালে স্বামী রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর তিনি যখন ভাঙা দল আর এতিম দুই সন্তান নিয়ে রাজনীতিতে পা রাখেন, তখন অনেকেই তাকে অবজ্ঞা করেছিলেন। তারা বলেছিলেন, সাধারণ এক গৃহবধূ রাজনীতির কী বুঝবেন! কিন্তু স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী ৯ বছরের আন্দোলনে তিনি প্রমাণ করেছিলেন, তিনি কেবল শহিদ জিয়ার বিধবা স্ত্রী নন, তিনি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী। আপসহীন নেত্রী হিসেবে তখন থেকেই তিনি জনগণের মনে স্থান করে নিলেন, যা আজও অমলিন।

রাজনৈতিক কৌশলের এবং বিরোধীদের নানা প্রচার-অপপ্রচারের কারণে অতীতে অনেক সময় তার উন্নয়নমূলক কাজগুলো আড়াল করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ইতিহাসের নির্মোহ দৃষ্টিতে তাকালে দেখা যায়, আধুনিক বাংলাদেশের ভিত্তি গঠনে তার অবদান অনস্বীকার্য। ১৯৯১ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি এমন কিছু সংস্কার হাত দিয়েছিলেন, যা ছিল তৎকালীন সময়ের চেয়ে অনেক বেশি অগ্রসর সিদ্ধান্ত। তার শাসনামলের সবচেয়ে বড় সাফল্য ধরা হয় নারী শিক্ষার প্রসারকে। তিনি দশম শ্রেণি পর্যন্ত মেয়েদের জন্য অবৈতনিক শিক্ষা চালু করেন এবং মেয়েদের স্কুলে ধরে রাখার জন্য ‘উপবৃত্তি প্রথা’ও চালু করেছিলেন। গ্রামের যে বাবা আগে মেয়েকে বোঝা মনে করতেন, খালেদা জিয়ার এই পদক্ষেপের কারণে সেই মেয়েরাই স্কুলে যাওয়া শুরু করে। আজকের বাংলাদেশে যে তৈরি পোশাক শিল্পে বা সরকারি চাকরিতে নারীদের জয়জয়কার, তার বীজ রোপিত হয়েছিল বেগম জিয়ার সেই যুগান্তকারী সিদ্ধান্তে।

বাংলাদেশের রাজস্ব আয়ের প্রধান উৎস ‘মূল্য সংযোজন কর’ বা ভ্যাট প্রবর্তন করেছিলেন বেগম খালেদা জিয়াই। ১৯৯১ সালে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের মাধ্যমে তিনি এই সাহসী পদক্ষেপ নেন। শুরুতে ব্যবসায়ীদের প্রবল আপত্তি থাকলেও, এই ভ্যাট ব্যবস্থা আজ বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। এছাড়া মুক্তবাজার অর্থনীতির দুয়ার খুলে দেওয়া এবং বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করার নীতি তার আমলেই বেগবান হয়। পলিথিন শপিং ব্যাগ নিষিদ্ধ করার মতো দুঃসাহসী সিদ্ধান্ত তার আমলেই নেওয়া। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর পলিথিন নিষিদ্ধ করা এবং ঢাকার বাতাস পরিষ্কার করতে টু-স্ট্রোক অটোরিকশা তুলে দিয়ে সিএনজি চালিত অটোরিকশা ও পরিবেশবান্ধব যানচলাচলের সূচনা তার আমলেই হয়। সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির মাধ্যমে তিনি পরিবেশ রক্ষায় এক নতুন জাগরণ সৃষ্টি করেছিলেন।

এছাড়া বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের অন্যতম উজ্জ্বল অধ্যায় হলো সংসদীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রবর্তন। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর, ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে তিনই রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ধরে না রেখে ১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট জাতীয় সংসদে এক ঐতিহাসিক বিল পাসের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনেন। এই পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে নির্বাহী ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয় এবং সংসদকে সকল কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করা হয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই সিদ্ধান্ত ছিল বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রায় এক মাইলফলক। এছাড়া নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে (ত্রয়োদশ সংশোধনী) তিনি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ সুগম করেছিলেন, যা পরবর্তীতে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হলেও, সেই মুহূর্তে ছিল জনদাবি।

বর্তমানে বেগম খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা সংকটাপন্ন, তাকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করেও বিদেশে নিয়ে যাওয়ার মতো ঝুঁকি নেওয়াও সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক এবং দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. এ জেডএম জাহিদ হোসেন। যদিও সৌদি আরব ও চীনসহ বিশ্ব বহু উন্নত দেশ তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য নিজেদের দেশে নিয়ে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে এবং কাতার তার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্স প্রস্তুত রাখারও প্রস্তাব দিয়েছে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও তার চিকিৎসার ব্যাপারে সর্বোচ্চ আন্তরিকতা প্রদর্শন করছে। সরকারের উপদেষ্টারা নিয়মিত খোঁজ রাখছেন এবং বিদেশ যাত্রার মতো পরিস্থিতি তৈরি হওয়া মাত্রই সব ধরনের সহায়তা দেওয়ারও আশ্বাস দিয়েছেন।

ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বেগম খালেদা জিয়াকে ‘রাষ্ট্রের অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’ বা ভিভিআইপি হিসেবে ঘোষণা করে বিশেষ প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। তার নিরাপত্তার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সে (এসএসএফ) সদস্যদের। বাংলাদেশের ইতিহাসে রাষ্ট্রপতির ও প্রধানমন্ত্রী অথবা প্রধান উপদেষ্টা পদের বাইরে থাকা কোনো ব্যক্তিকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রজ্ঞাপন জারি করে এমন ‘অতি গুরুত্বপূর্ণ’ মর্যাদা ও এসএসএফ সুরক্ষা দেওয়ার নজির বিরল। অতীতে সাধারণত কেবল ক্ষমতাসীন রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানরাই এই প্রটোকল পেয়ে ছিলেন। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এটি কেবল একটি প্রটোকল নয়, বরং দীর্ঘ বঞ্চনার পর একজন জাতীয় নেত্রীর প্রাপ্য সম্মানের স্বীকৃতি।

সরেজমিনে এভারকেয়ারের গেটের বাইরে দেখা গেছে, হাসপাতালের প্রধান ফটকে মানুষ জটলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের হাতে কোনো ব্যানার নেই, কিন্তু চোখেমুখে আছে গভীর উদ্বেগ।

রাজধানীর বাড্ডা থেকে আসা রিকশাচালক মফিজুল ইসলাম (৫০) গত দুই রাত ধরে হাসপাতালের উল্টো দিকের ফুটপাতে বসে আছেন। তিনি বলেন, “আমি কোনো দল বুঝি না, শুধু জানি এই বেডি দেশের জন্য অনেক কষ্ট করছেন। তার জন্য দোয়া চাইতে আসছি। আল্লাহ যেন তারে ফিরাইয়া দেন।”

গুলশানের বাসিন্দা গৃহিণী সালমা বেগম তার দুই সন্তানকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন হাসপাতালের বাইরে। তিনি বলেন, “টিভিতে খবর দেখে আর ঘরে থাকতে পারলাম না। সিসিইউতে তো ঢুকতে পারব না জানি, কিন্তু এই হাসপাতালের সামনে এসে একটু দোয়া করতে এসেছি, হয়তো আল্লাহ কবুল করবেন।”

রিকশাচালক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, মাদরাসার ছাত্র থেকে শুরু করে কোট-টাই পরা কর্পোরেট চাকরিজীবী, সমাজের এমন কোনো শ্রেণি নেই যার উপস্থিতি সেখানে নেই। প্রবাসী বাংলাদেশি জামিল আহমেদ যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফিরেছেন দুইদিন আগে। বিমানবন্দর থেকে সোজা মা-বাবাকে দেখতে না গিয়ে তিনি এসেছেন এভারকেয়ারের সামনে। জামিল বলেন, “বিদেশে বসে যখন খবর পেতাম এই মানুষটাকে বিনা চিকিৎসায় মেরে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে, খুব কষ্ট হতো। আজ যখন তিনি মৃত্যুর দুয়ারে, তখন হাসপাতালের বাইরে এসে তার খোঁজটা নিতে ইচ্ছে করলো খুব। দেখতে তো পাবো না, দোয়া করি, আল্লাহ তাকে সুস্থ করে দিক।”

হাসপাতালের সামনে অসংখ্য মানুষ দাঁড়িয়ে দোয়া করছেন, প্রতীক্ষায় রয়েছেন- তিনি সুস্থ হয়ে উঠছেন, এই সংবাদ শোনার অপেক্ষায়। এমন দৃশ্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে কোনো নেতার অসুস্থতার সময় অতীতে দেখা গেছে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। অতীতে বরেণ্য নেতাদের অসুস্থতায় মানুষ উদ্বিগ্ন হয়েছে সত্য, কিন্তু একজন নেত্রীর জন্য দিনের পর দিন হাসপাতালের বাইরে এভাবে সাধারণ মানুষের দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্য নজিরবিহীন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ঘটনাই প্রমাণ করে, বেগম খালেদা জিয়া আজ আর কেবল বিএনপির নেত্রী নন, তিনি আপামর জনসাধারণের আবেগের প্রতীকে পরিণত হয়েছেন।

গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার ও তাদের দোসররা বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে যে পরিমাণ ব্যক্তিগত আক্রমণ ও কুরুচিপূর্ণ অপপ্রচার চালিয়েছে, তা সভ্য সমাজের অকল্পনীয় বলে মনে করেন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা। শেখ হাসিনা ও তার দলের নেতারা নিয়মিত বেগম জিয়াকে ‘মেট্রিক ফেল’ বা ‘এইট পাশ’ বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতেন। ১৯৭১ সালে তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে বন্দি ছিলেন। এই স্পর্শকাতর বিষয়টি নিয়েও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা বিভিন্ন সময়ে অত্যন্ত অশালীন ও কুরুচিপূর্ণ ইঙ্গিত করেছেন।

এছাড়া জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় তাকে ‘এতিমের টাকা আত্মসাৎকারী’ হিসেবে চিত্রিত করার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রের সবটুকু ব্যবহার করা হয়েছিল। শেখ হাসিনা জনসভায় দাঁড়িয়ে তাকে ‘চোর’ বলে সম্বোধন করতেন। অথচ মামলার নথিপত্র বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সেই ট্রাস্টের টাকা ব্যাংকে গচ্ছিত থেকে সুদে-আসলে কয়েকগুণ বেড়েছিল, আত্মসাতের ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু এই মিথ্যা অপবাদ দিয়েই তাকে বছরের পর বছর জেলে রাখা হয়েছিল। এসব অপপ্রচার বা কুরুচিপূর্ণ বক্তব্যের জবাবে বেগম খালেদা জিয়া কখনো একটি কটু কথা বলেননি। তার এই পরিমার্জিত বোধ ও সহনশীলতাই আজ তাকে সাধারণ মানুষের চোখে শ্রদ্ধার পাত্রে পরিণত করেছে বলে মত দিয়েছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

শেখ হাসিনার শাসনামলে বেগম জিয়ার ওপর নির্যাতনের মাত্রা ছিল মধ্যযুগীয়। পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় বিশ্বব্যাংক যখন অর্থায়ন বন্ধ করে, তখন খালেদা জিয়া এর সমালোচনা করেছিলেন। এর জবাবে শেখ হাসিনা এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, “খালেদা জিয়া বলেছিল জোড়াতালি দিয়ে পদ্মা সেতু বানানো হচ্ছে… ওনাকে ধরে এনে পদ্মা সেতু থেকে টুস করে ফেলে দেওয়া উচিত।”

সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ঘটনা ছিল বেগম খালেদা জিয়াকে ৪০ বছরের স্মৃতিবিজড়িত মঈনুল রোডের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ। এক কাপড়ে তাকে সেই বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। এরপর গুলশান কার্যালয়ে তাকে বালুর ট্রাক দিয়ে অবরুদ্ধ করে রাখা হয় দিনের পর দিন। সেখানে বিদ্যুৎ, পানি ও খাবার সরবরাহও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ২০১৫ সালে ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো মালয়েশিয়ায় নির্বাসিত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করার সময় বেগম জিয়া গুলশান কার্যালয়ে অবরুদ্ধ। সন্তানের লাশ যখন কার্যালয়ে আনা হয়, তখন এক মা হিসেবে তিনি সেই লাশ দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু সেই মুহূর্তটি ছিল মর্মান্তিক। এছাড়া দীর্ঘ ১৭ বছর বড় ছেলে তারেক রহমান লন্ডনে নির্বাসিত থাকায় বেগম খালেদা জিয়া আওয়ামী লীগ আমলের সকল জেল-জুলুম আর নির্যাতন-নিপীড়ন একাকী সহ্য করে গেছেন।

২০০৭ সালের ১/১১-এর সময় সেনা সমর্থিত সরকার যখন ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলা বাস্তবায়ন করতে চাইলে শেখ হাসিনা চিকিৎসার নাম করে বিদেশে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়াকে শত চাপ দিয়েও দেশত্যাগে রাজি করানো যায়নি। তাকে দেশের বাইরে যাওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করলে তিনি স্পষ্টভাবে জানিয়েছিলেন- “আমি দেশ ছেড়ে, দেশের মানুষকে ছেড়ে কোথাও যাব না। এই দেশই আমার একমাত্র ঠিকানা। দেশের বাইরে আমার কিছু নেই, কোনো ঠিকানাও নেই।” তার এই একটি সিদ্ধান্তই তাকে রাজনীতিবিদ থেকে দেশপ্রেমিক রাষ্ট্রনায়কে উন্নীত করেছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

৫ আগস্টের প্রেক্ষাপটকে তারা ভাগ্যের নির্মম পরিহাস হিসেবে উল্লেখ করছেন। বেগম খালেদা জিয়াকে প্রতিনিয়ত অপদস্ত করা শেখ হাসিনা গণরোষের মুখে লাঞ্ছিত হয়ে এখন দেশ থেকে পালিয়ে ভিনদেশে আশ্রিত জীবন যাপন করছেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে, নিজ দেশের মাটিতে পা রাখার সাহসটুকুও তিনি হারিয়েছেন। পক্ষান্তরে, যে খালেদা জিয়াকে তিনি নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিলেন, তিলে তিলে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিলেন, তিনি আজ হাসপাতালের বিছানায় শুয়েও দেশের কোটি মানুষের প্রার্থনায় সিক্ত হচ্ছেন। একজন পালিয়ে গিয়ে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন, আর অন্যজন মাটি কামড়ে পড়ে থেকে, মৃত্যুশয্যায় শুয়েও গণমানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় স্থান করে নিয়েছেন। ক্ষমতার মসনদ থেকে শেখ হাসিনার এই লজ্জাজনক পলায়ন আর হাসপাতালের করিডোরে খালেদা জিয়ার জন্য মানুষের এই হাহাকার, প্রকৃতি যেন এভাবেই তার প্রতিশোধ নেয় বলে কেউ কেউ মন্তব্য করছেন।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর বেগম খালেদা জিয়া মুক্তি পান। দীর্ঘ কারাবাস ও অসুস্থতা নিয়ে তিনি হাসপাতাল থেকেই জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। সবাই আশঙ্কা করেছিল, এত বছরের নির্যাতনের পর তিনি হয়তো প্রতিশোধের হুঙ্কার দেবেন। কিন্তু তিনি বললেন, “ধ্বংস নয়, প্রতিশোধ নয়, প্রতিহিংসা নয়, ভালোবাসা, শান্তি ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলি।” সেসময় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার গুজব এবং নানা ধরনের অরাজকতা সৃষ্টির আশঙ্কা থেকে তিনি দলের নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন মন্দির ও গির্জা পাহারা দিতে। তার এই ধীরস্থির, অভিজ্ঞ ও প্রতিহিংসামুক্ত নেতৃত্ব ৫ আগস্ট পরবর্তী বাংলাদেশকে এক বড় গৃহযুদ্ধ থেকে রক্ষা করেছে বলে মনে করেন রাজনীতি সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে জনপ্রিয়তার শীর্ষে শেখ মুজিবুর রহমানের নাম উচ্চারিত হয়। কিন্তু ১৯৭২ পরবর্তী সময়ে বাকশাল গঠন, রক্ষীবাহিনীর অত্যাচার এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণের কারণে তার জনপ্রিয়তা হ্রাস পেয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তিনি সপরিবারে নিহত হলে কথিত আছে দেশের কোনো কোনো স্থানে স্বস্তির আবহাওয়া বিরাজ করেছিল এবং কিছু এলাকায় মিষ্টি বিতরণের মতো ঘটনাও ঘটেছিল। মৃত্যুর পর শেখ মুজিব সেই সময়ে জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হতে পারেননি। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়া মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে যে ভালোবাসা পাচ্ছেন, তা এক কথায় অভূতপূর্ব বলে মনে করেন রাজনীতি সংশ্লিষ্টরা। জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), জাতীয় পার্টি, এমনকি চরম বামপন্থী দলগুলোও তার সুস্থতা কামনা করছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসও জাতির কাছে তার জন্য দোয়া চেয়েছেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্রনায়ক বা রাজনৈতিক নেতাই ভুলের ঊর্ধ্বে নন। বেগম খালেদা জিয়ার শাসনামলেও নানা ভুল-ত্রুটি, সীমাবদ্ধতা এবং প্রশাসনিক ব্যর্থতা ছিল। ২০০১-২০০৬ মেয়াদে জঙ্গিবাদের উত্থান, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মতো নিরাপত্তা ব্যর্থতা, হাওয়া ভবনের কথিত দুর্নীতির অভিযোগ এবং দলের কিছু নেতার ক্ষমতার অপব্যবহার তার শাসনামলকে সমালোচিত করেছিল। এসব ঘটনা তার জনপ্রিয়তায় একসময় ভাটা ফেলেছিল, কিন্তু গত দেড় দশকে তিনি যে চরম মূল্য দিয়েছেন, ব্যক্তিগতভাবে এবং দলীয়ভাবে যতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তা মানুষের মনে তার জন্য আলাদা স্থান তৈরি করেছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, মানুষ যখন দেখে একজন ৮০ বছর বয়সী সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে চিকিৎসার অভাবে ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, মিথ্যা মামলায় বছরের পর বছর জেলে রাখা হচ্ছে, তখন অতীতের প্রশাসনিক ভুলগুলো গৌণ হয়ে যায়। তার ত্যাগ এবং আপসহীনতা সেই সব ত্রুটিকে ছাপিয়ে তাকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে বলে তারা মনে করেন।

মানুষের মনে আজ এই বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়েছে যে, রাষ্ট্র পরিচালনায় তার হয়তো কিছু কৌশলগত ভুল ছিল, কিন্তু দেশপ্রেম ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে তিনি ছিলেন ইস্পাতকঠিন। ভারতের সাথে নতজানু পররাষ্ট্রনীতি না থাকা, দেশের স্বার্থ বিকিয়ে না দেওয়া এবং ১/১১-এর সময় ও পরবর্তীকালে দেশের মাটি কামড়ে পড়ে থাকার যে নজির তিনি স্থাপন করেছেন, তা তাকে সাধারণ রাজনীতিক থেকে জাতীয় অভিভাবকের আসনে বসিয়েছে।

রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, এভারকেয়ারের বাইরের এই ভিড় প্রমাণ করে, জনগণ বেগম জিয়াকে আর তার অতীত ভুলের জন্য বিচার করছে না, বরং তাকে সম্মান জানাচ্ছে তার ত্যাগের জন্য। ভুল-ত্রুটি মিলিয়েই মানুষ, কিন্তু যখন কেউ নিজের জীবন দিয়ে দেশের ও দলের জন্য প্রায়শ্চিত্ত করেন, তখন তিনি আর সাধারণ নেতা থাকেন না, হয়ে ওঠেন ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বেগম খালেদা জিয়া আজ সেই উচ্চতায় পৌঁছেছেন, যেখানে নিন্দা বা সমালোচনা পৌঁছাতে পারে না, পৌঁছায় কেবল শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা। -বাংলানিউজ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*

error: Content is protected !!