নিউজ ডেক্স : চট্টগ্রামে জামায়াতে ইসলামীর আলোচিত দুই নেতা মাওলানা আ ন ম শামসুল ইসলাম এবং শাহজাহান চৌধুরী। শামসুল মহানগর জামায়াতের সাবেক আমির এবং শাহজাহান চৌধুরী সাবেক নায়েবে আমির। দুই নেতাই চট্টগ্রামের সাতকানিয়া-লোহাগাড়া থেকে নির্বাচিত সাবেক সংসদ সদস্য। রাজনীতিতে আধিপত্য এবং আগামী নির্বাচনে সাতকানিয়া-লোহাগাড়া থেকে প্রার্থী হওয়াকে কেন্দ্র করে দুই নেতার বিরোধ তুঙ্গে উঠেছে, যার খবর পৌঁছেছে পুলিশের গোয়েন্দা ইউনিটের কাছেও।
সূত্রমতে, বিরোধ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, পরিস্থিতি সামলাতে একজন নেতাকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্তও জামায়াতের কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে নেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে পুলিশকে তথ্য দিয়ে দুই নেতার অনুসারীরা একে অপরকে গ্রেফতার করাতেও দ্বিধাবোধ করছে না।
একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত দলটি নিজেদের ভেতরে কঠোর শৃঙ্খলা চর্চার জন্য আলোচিত। তবে দুই নেতার মধ্যে বিরোধ নিয়ে বেসামাল অবস্থায় পড়েছে ক্যাডারভিত্তিক সহিংস রাজনীতির জন্য সমালোচিত জামায়াতে ইসলামী।
জামায়াতপন্থী বুদ্ধিজীবী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড.মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান বাংলানিউজকে বলেন, যেখানে জামায়াতের নিবন্ধন নেই, দলের প্রতীক নেই, সেখানে নির্বাচন নিয়ে বিরোধের কথা হাস্যকর। এটা কিছুটা অতি প্রচারণা, কিছুটা দু’নেতার অনুসারীদের অতি উৎসাহী কর্মকাণ্ড।
‘তবে আমি মনে করি, জামায়াতের নির্বাচনে যাওয়া উচিৎ হবে না। যদি যেতেই হয়, তখন পার্লামেন্টারি বোর্ডের সিদ্ধান্ত যে নেতা মানবেন না তার বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তিনি যত বড় নেতাই হোন, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে জামায়াতের কোন ক্ষতি হবে না। আমি দুই নেতাকেই খুব সম্মান করি। তাদের এই মুহূর্তে এসব বিষয়ে দ্বন্দ্বে জড়ানো উচিৎ নয়। ’
২০০১ সালে শাহজাহান চৌধুরী সাতকানিয়া-লোহাগাড়া থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। দুর্নীতি মামলায় দণ্ডিত হয়ে নির্বাচনের অযোগ্য হলে ২০০৮ সালে সেই আসন থেকে নির্বাচিত হন শামসুল ইসলাম। তখন থেকেই তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়।
জামায়াতের সাংগঠনিক অবস্থা নিয়ে তথ্য সংগ্রহকারী নগর পুলিশের গোয়েন্দা ইউনিটের সূত্রে জানা গেছে, কেন্দ্র থেকে একাধিকবার উদ্যোগ নিয়েও দু’নেতার বিরোধ সামলাতে না পেরে চলতি বছরের জানুয়ারিতে চট্টগ্রাম মহানগর জামায়াতের আমির পদে পরিবর্তন আনা হয়। শামসুল ইসলামকে কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির করে কক্সবাজার জেলা জামায়াতের আমির ও ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ শাহজাহানকে দেওয়া হয় চট্টগ্রামের আমিরের দায়িত্ব। শামসুলের ঘনিষ্ঠ শাহজাহান কক্সবাজারের উখিয়ার বাসিন্দা এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র।
আমির শাহজাহান দায়িত্ব নিয়ে দু’নেতার বিরোধ মীমাংসার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এই অবস্থায় কেন্দ্র থেকে নির্দেশনা আসে শাহজাহান চৌধুরীকে চট্টগ্রাম-১০ (ডবলমুরিং ও হালিশহর) আসনে এবং শামসুলকে সাতকানিয়া-লোহাগাড়া আসন থেকে প্রার্থী হতে রাজি করানোর জন্য। কিন্তু আমির শাহজাহান একাধিকবার বৈঠক করেও সমঝোতায় আসতে ব্যর্থ হন। শাহজাহান চৌধুরী কোনভাবেই ডবলমুরিং থেকে নির্বাচন করতে রাজি নন। তার দাবি সাতকানিয়া-লোহাগাড়া। অন্যদিকে শামসুলও সেটা ছাড়তে রাজি নন।
সূত্রমতে, দুই নেতার বিরোধের প্রভাব পড়েছে চট্টগ্রামে জামায়াতের রাজনীতিতে। মহানগর এবং দক্ষিণ জেলায় সাংগঠনিক পদ-পদবি আছে এমন সব নেতা আছেন শামসুলের পক্ষে। ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি ইয়াসির আরাফাতসহ সংগঠনটির চট্টগ্রামের বড় অংশও শামসুলের পক্ষে সরব। আর পদবিহীন নগর ও দক্ষিণের নেতাকর্মী এবং শিবির ক্যাডারদের বড় অংশ আছে শাহজাহানের পক্ষে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নগর জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত এক নেতা বলেন, অবস্থা এমন হয়েছে কোন কর্মসূচি দিলে যদি শাহজাহান চৌধুরী উপস্থিত থাকার কথা থাকে সেই তথ্যও চলে যাচ্ছে পুলিশের কাছে। শামসুল ইসলাম সাহেব থাকলে সেই তথ্যও চলে যাচ্ছে পুলিশের কাছে। দুজন না থাকলে কোন সমস্যা হচ্ছে না। কিন্তু দুজনই আধিপত্য ছাড়তে চান না।
সূত্রমতে, স্থানীয়ভাবে বিরোধ মীমাংসার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় দুই নেতা এবং নগর জামায়াতের আমির শাহজাহান ও সেক্রেটারি নজরুল ইসলামকে গত ৯ অক্টোবর কেন্দ্র থেকে তলব করা হয়। ঢাকার উত্তরার একটি বাসায় বৈঠকের আয়োজন করা হয়। বৈঠক শুরুর আগে শাহজাহান চৌধুরীর কাছে খবর পৌঁছে, তিনি সাতকানিয়া-লোহাগাড়া আসন ছাড়তে রাজি না হলে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হবে। এরপর বৈঠকের খবর পৌঁছে যায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে।
ওইদিন উত্তরার বাসা থেকে জামায়াতের আমির মকবুল আহমেদ, কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির মিয়া গোলাম পরওয়ার, সেক্রেটারি জেনারেল শফিকুর রহমান, চট্টগ্রাম মহানগরের আমির মোহাম্মদ শাহজাহান ও সেক্রেটারি নজরুল ইসলাম, দক্ষিণ চট্টগ্রামের আমির জাফর সাদেক, সেক্রেটারি জেনারেলের ব্যক্তিগত সহকারী নজরুল ইসলামসহ ৯ জনকে আটক করা হয়।
শামসুল ইসলাম ও শাহজাহান চৌধুরী বৈঠকে হাজির না হয়ে গ্রেফতার এড়াতে সক্ষম হন। মূলত বহিষ্কার ঠেকাতে শাহজাহান চৌধুরীই বৈঠকটি ভণ্ডুল করে দেন বলে সূত্র জানিয়েছে।
জানতে চাইলে সিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) সালেহ মো.তানভীর বলেন, সামনে নির্বাচন আসছে। জামায়াতে ইসলাম আবারও তাদের ক্যাডারদের নিয়ে মাঠে নেমে নাশকতা করতে পারে। এজন্য দলটির সব ধরনের খবর আমরা রাখছি। জামায়াতের সাংগঠনিক সব তথ্যই আমাদের কাছে আছে। -বাংলানিউজ